ঘড়ির কাঁটায় ১টা বেজে৪২ মিনিট, রাত ১:৪২।আর ভালো লাগছে না পড়তে।যা হবে দেখা যাবে।সকাল ৯ টার মধ্যে বেড়াতে হবে না হলে ঠিক টাইমে পরীক্ষার হলে পৌঁছতে পারবে না।অতএব ব্যাগ গুছিয়ে জল খেয়ে ওয়াশ রুমে গেল কুটু।কাল তার B.Sc 2nd year Chemistry পরীক্ষা।আজ বাড়িতে সে একা।মা-বাপি গেছে রুবিদির ছেলের মুখে ভাতের অনুষ্ঠানে-চন্দননগর।রুবিদি কুটুর জেঠতুতো দিদি-বাড়ির বড় মেয়ে তাই মা-বাপি এড়াতে পারেনি,নচেৎ তাকে বাড়িতে একা রেখে কখনো কোথাও যায়নি তারা।বেশি রাতে ঘাট পার হতে অসুবিধা হয় তাই তারা রাতে আসার চেষ্টা করেনি।মা অবশ্য বারবার করে বলেছে–
চিন্তা করিস না কুটু, ভোরের আলো ফোটার সাথেসাথে আমরা চলে আসবো।লঞ্চ চালু হতে যত দেরি….রাগ করিস না মা।
বাবা বরাবর ই কুটুর ব্যাপারে কনফিডেন্ট।
তুমি আমার মেয়েকে কি ভাবো বলোতো? তোমার থেকে শতগুনে সাহসী আর বুদ্ধিমতী আমার মেয়ে, একেবারে ডাকাতরাণী।কি কুটু মা ভয় পাচ্ছ নাকি?
বাবা যখন মেয়েকে ফুলন দেবীর আসনে বসিয়েই ফেলেছে তখন আর কি করা যায়, অগত্যা পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ নিয়েই বুক ফুলিয়ে বলে ফেলল কুটু—
আমার জন্য কোন চিন্তা করতে হবে না।তোমরা সাবধানে যাও।
অত:পর আজ রাতে কুটু বাড়িতে একা।
এতক্ষণ পড়ার খেয়ালে ছিল বলে কিছু মনে হচ্ছিলো না কিন্তু সব বন্ধ করে লাইট অফ্ করে যখন বিছানায় শুয়ে পড়ল কুটু তখন কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না।কোথাও কিছু নেই তবু যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকল।এই প্রথম মায়ের উপর খুব রাগ হলো কুটুর–
বাপি যেত যেত মাকে কে যেতে বলেছিল…..বাড়ির বৌ….নাতির মুখেভাত…..না গেলে অনেক কথা হবে রে কুটু… তুই তো সব বুঝিস মা!!
কথা না হাতি-এই যে এখন কেমন যেন ভয় ভয় করছে…ঘুম আসছে না….কি হবে এখন!!!
গান শুনে বা টিভি দেখে যে রাত কাটাবে সকালে তো পরীক্ষা!হলে গিয়ে যদি ঘুম পায়!!না ঘুমানোর চেষ্টা করতেই হবে… চোখের উপর কুশনটা চাপা দিল কুটু।বাবার কথামতো রান্না ঘরের ছুরি দুটো মাথার কাছে রেখেছে সে।খাটের তলায় বড় শাবল আর মায়ের আম পাড়ার জন্য বড় লাঠিটা রেখেছে।তাও কেমন যেন মনে হচ্ছে কুটুর।
এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে নিধু মাসি যখন প্রায় দরজা পর্যন্ত এসেই পড়েছিল ঠিক তখনই কুটুর মনে হল কোথাও যেন একটা ধম্ ধম্ আওয়াজ হচ্ছে।তড়াক করে খাটে উঠে বসল কুটু।কান পেতে শোনার চেষ্টা করল সে।ঐ তো একটা রিদম-এর মতো ধুম্ ধুম্ আওয়াজ হচ্ছে।কেউ কি তবে হাতুড়ি দিয়ে তালা ভাঙার চেষ্টা করছে।কি হবে এখন?
প্রথমটায় জোরে কাদতে ইচ্ছা করল কুটুর,কিন্ত না কাদলে চলবে না।ভয় পেলে চলবেনা, সাহস সঞ্চয় করতে হবেই তাকে।মনে মনে বলল সে-
যো ডর গেয়া সমঝো মর গেয়া।
ডর কে আগে জিত হে।
জয় বাবা লোকনাথ, জয় মহেশ্বর রক্ষা কর বাবা।কাল তোমায় দশ পয়সা দেব ঠাকুর (বিপদে পড়লে এটাই কুটুর মহামন্ত্র)।
এক হাতে বড় ছুরি আর এক হাতে দাদুর আমলের বড় টচ্ নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বেডরুম থেকে বের হল সে।ডাইনিং রুমের লাইট অন করাই ছিল-চারিদিক ভালো করে দেখে মন দিয়ে আওয়াজটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল কুটু।বারান্দার দিক থেকে নয়,বাথরুমের দিক থেকে আসছে আওয়াজটা।আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সে–একটু একটু করে তীব্র হচ্ছে আওয়াজটা।তবে কি কেউ বাথরুমের জানালাটা ভাঙার চেষ্টা করছে!!
টচ্ অন করে একঝটকায় বাথরুমের দরজা খুলে ছুরি হাতে পুরো বাংলা সিনেমার হিরোর মত দাঁড়িয়ে পরল কুটু।কেউ নেই তো জানালায়,তবে!!হঠাৎ করে জলের কলের দিকে নজর গেল কুটুর।
কলটা লুজ হয়ে গেছে ফলে টপ্ টপ্ করে জল পরছে,আর বাথরুমের দরজা বন্ধ থাকায় আওয়াজটা…..খুব হাসি পেল কুটুর।নিজের অবস্থা আর বুদ্ধির কথা ভেবে খুব লজ্জা পেল সে।মনে হল মা ঠিকই বলে–তুই আর বড়ো হলি না রে কুটু….।বাপি যদি এই অবস্থায় তাকে একবার দেখতো!!
সত্যি সত্যি মা বাপি সাত সকালে চলে এল সঙ্গে রাঙাদাদু।সকালে চায়ের টেবিলে কুটুর সাহসীকতার গল্পে সবাই হেসে কুটিপাটি।বাপি মেয়ের গরবে বুক ফুলিয়ে বলল,
কি,বলেছিলাম না আমার মেয়ে ফুলনদেবী! মিলল আমার কথা হা:হা:হা:।