নিঃশব্দ আর্তনাদ ! সেই সাথে এক সুপ্ত আকুতি । হ্যাঁ , নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এ তার ক্রমশ পিছিয়ে পরার যন্ত্রনাকে বোঝার পর এটাই উপলব্ধি করলাম ।
মাস কয়েক আগের কথা , সোদপুর থেকে মধ্যমগ্রাম যাচ্ছি বাসে চেপে । বাসটি সোদপুর রেলওয়ে ওভারব্রীজের পূর্বে কাঁচকল ছেড়ে যেতেই একজন দৃশ্যত অশীতিপর বৃদ্ধ ভদ্রলোক বাস কন্ডাকটার কে বললেন – বাবা, ‘নদীর পাড়ে নামিয়ে দিও’। প্রথমে কন্ডাকটার পরিষ্কার না বোঝাতে উনি একটু বুঝিয়ে বললেন । খানিক বাদেই বাস টি ওনার বলে দেওয়া স্থানেই থামল। উনি খুব ধীরে ধীরে নেমে চলে গেলেন । সেই সাথেই আমার মনে একটি প্রশ্ন জন্ম নিল । আশেপাশে রাস্তার দুধারে শুধু ভেঙ্গে পড়া নিকাশী ব্যবস্থা়য় উপচে গিয়ে প্রান-ওষ্ঠাগত করা নর্দমা ছাড়া তো আর কিছু ই নেই – ‘ তা হলে উনি যে বললেন নদীর পাড় ! ‘ কাছেপিঠে নদী মানেই তো গঙ্গা , তাও প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে । যাইহোক , খুব বেশী গুরুত্ব না দিয়েই আবার আমার মন গন্তব্যস্থলের কাজের প্রয়োজনীয় ভাবনায় ব্যস্ত হল। কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরে রাতের খাবার সেরে দৈনিক জাবরকাটার সময় আবার ফিরে এল সেই কৌতূহল । ওখানে কী আদোঔ কোনো নদী ছিল ? মানুষের কথ্য ভাষায় এবং চলিত শব্দে তো অনেক লুপ্ত অধ্যায়ের সূত্র থেকেই যায় । তাই সত্যি টা কে জানার আগ্রহে মন আরও ব্যকুল হল । তারপরের বেশ কয়েকদিন কয়েকটি তথ্য ও মানচিত্র ঘেঁটে ও অভিজ্ঞ পরিচিতের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে,ওই অঞ্চল দিয়ে সত্যিই একটি হারিয়ে যাওয়া টলমলে ছোট নদী বয়ে চলত সুদূর অতীতে । নাম তার ‘সোনাই’। ‘সোনাই নদী’ । কিন্তু প্রাচীনকালের এই নদী আজ হারিয়ে গেল কেন ? । এ কি কোনোভাবে মানবজাতির সম্প্রসারন এবং আগ্রাসনের পরিনাম ,না কি প্রকৃতির স্বাভাবিক বিচার ? সেই সময়ের জলে ভরা টইটম্বুর কল্লোলিনী স্রোতা আজকের এই হারানো নদী হয়ে মানুষের মন থেকে প্রায় সম্পূ্র্ণ বিস্মৃত। এই ‘হারানো’ শব্দটিতে লুকিয়ে রয়েছে এক বিছিন্নতার বেদনা যা একটু হলেও আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল । আজ ও ইচ্ছে হয় সময়ের উল্টোদিকে কল্পনার ভেলায় চড়ে চলে যাই সেই নদীর পাড়ে । মনে হয় দেখে আসি কোনো ইতিহাসের নথি তে ঠাঁই না পাওয়া সেই ছোট আঁকাবাকা নদী তার যৌবনের চাঞ্চল্য কেমনই বা ছিল ।
না , অবলুপ্তির পথে হলেও “সোনাই” আজ ও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায় নি । সেই প্রাগঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার ভূমি তে প্রান সঞ্চয় করে একে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে এখানকার অগুনতি নদ-নদী এবং শিরা-ধমনীর মতো ছড়িয়ে পরা তাদের অসংখ্য শাখা , প্রশাখা ও উপশাখা । এই নদ-নদী থেকেই মানুষ সেই প্রাচীন সময় থেকেই খুুঁজে নিয়েছে বেঁচে থাকার রসদ । নদীই ছিল মানবজাতির নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রধান সম্পদ । সংস্কৃতি ,জীবন ও জীবিকা – সবটাই যে ছিল নদী কেন্দ্রিক । চাষাবাদ , খাদ্য ও পানীয় জলের জোগান তো বটেই , এই শাখানদী ও উপনদী গুলিই ছিল আঞ্চলিক বানিজ্যের জন্য বহুল ব্যবহৃত যোগাযোগের পথ। এছাড়াও ছোট ছোট বজড়া ও ডিঙ্গিতে চলত তৎকালীন প্রাচীন সব হাট-বাজার । নৌকায় চড়ে ছোট নদীতে বৈকাল ভ্রমন ছিল সেই সময়কার প্রধান বিলাসিতা । মানুষ তার সমস্ত প্রয়োজনে নদীর দ্বারস্থ হয়েছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং মানবজাতির সার্বিক বিকাশের জন্য । কিন্তু এই বিকশিত মানবসভ্যতা আজ আত্মবিস্মৃত ও নির্বোধ । শ্বাসরুদ্ধ নদীর করুন প্রানভিক্ষা ও কাতর প্রার্থনায় কর্নপাত করা দূরের কথা , নির্দয়ের মতো তার শেষ প্রান টুকুনিয়ে ছিনিমিনি খেলতে মত্ত আপাত-উন্নত ও প্রকৃত-ক্ষয়িষ্ণু এই বর্তমান সমাজ ।
ইচ্ছাপুর এর কাছে গঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া এই সোনাই নদী দক্ষিনে বহুক্রোশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । উত্তর 24 পরগনার ইচ্ছা পুরের লাবন্যবতী নদী ছুঁয়ে বিলকান্দা গ্রাম পঞ্চায়েত ,ব্যারাকপুর, টিটাগর, পানিহাটি ,কামারহাটি ,দমদম থেকে বাগজোলা পর্যন্ত বয়ে চলত এই সোনাই নদী । বলে রাখা প্রয়োজন , বানিজ্যের প্রানকেন্দ্র উল্লিখিত লাবন্যবতী নদী টি আজ ও কোনরকমে অর্ধ-জীবিত মধ্যমগ্রাম খাল বা নোয়াই খাল নামে পরিচিত । এটি যে একটি প্রাকৃতিক নদী তা অনেকেরই হয়ত অজানা । আর জানা থাকলেও তাতে হয়ত কারুর ভ্রূক্ষেপ নেই । দৈনন্দিন অর্থ-উপার্জনে লাবন্যবতীর সরাসরি ভূমিকা যে আজ ফুরিয়েছে , আর তার সেই অতীতে র লাবন্য ও আজ সভ্যতার নোরাং জলে প্রশমিত । একইভাবে বহুযুগ আগে অতীতে আমাদের সোনাই নদী র প্রয়োজনও ফুরিয়ে ছিল । তারপর শুধুই অবহেলা আর অবজ্ঞা । শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উওর চব্বিশ পরগনায় কয়রাপুরের (ইছাপুরে র কাছে) উৎপত্তিস্থল থেকে সোনাই প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বক্র পথে বয়ে যাওয়ার পর অবশেষে বাগজোলা খাল এর সাথে মেশে, যার প্রবাহ কৃষ্ণপুর খাল হয়ে বিদ্যাধরী নদীতে এসে শেষ হয় । বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, ব্রিটিশরা এই নদীর উওরের অবশিষ্টাংশকে বাগজোলা খাল ( গঙ্গার কাছে আড়িয়াদহ থেকে কৃষ্ণপুর খাল হয়ে বিদ্যাধরী নদী পর্যন্ত )খননের সময় এর সাথে যুক্ত করেন। নোয়াই খাল ইচ্ছাপুরে গঙ্গায় মিলিত হওয়ার আগে ইচ্ছাপুর খাল নামে পরিচিত । এই জল ধারা কয়রাপুরের কাছে এসে দুটি ধারায় বয়ে চলে দক্ষিন দিকে । একটি লাবন্যবতী নদী এবং অন্যটি সোনাই নদী । তাহাবেড়িয়া, মোহনপুর , বড় কাঠালিয়া , রুইয়া , পাতুলিয়া , বন্দিপুর , কল্যান নগর , নাটাগর , ঘোলায় আজকের সোদপুর-বারাসাত রোড অতিক্রম করে নিমতা হয়ে বাগজোলা অবধি ছিল এই সোনাই নদীর গতিপথ । আর ঠিক যেই স্থানে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে সোদপুর-বারাসাত রোড টি তৈরী করা হয়েছিল। ঠিক সেই সংযোগস্থল টি আজ ও অল্প সংখ্যক পুরোনো মানুষের কাছে ” নদীর পাড়” নামে পরিচিত । বুঝলাম বাসের সেই বয়স্ক ভদ্রলোক যোগ্য নামেই সম্বোধন করছিলেন ঐ স্টপেজ টি কে ।সোদপুর ঘোলা হতে কল্যাননগর অবধি আজও সোনাই এর নদী পথ বরাবর মোট ৫৬ টি আয়তাকার পুকুর এই নদীর খন্ড হিসাবে পরিচিত । এই অঞ্চল থেকেই নদীর আরও একটি জলধারা খড়দহ রেলস্টেশনের কাছে খড়দহ খালে এসে মেশে, যা ২ কিলোমিটার দূরেই গঙ্গায় মিলিত হয় । নদীর এই ধারাটি উপর্যিপরি ভরাটের ফলে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত । শুধু গতিপথে রয়ে গিয়েছে টুকরো টুকরো পুকুর , যা আজও নদীর অতীতের জীবন্ত দলিল। খড়দহ খালের ঐ অংশটি একটি প্রাকৃতিক জলধারা ছিল যার উৎপত্তিও এই সোনাই নদী ,যা আজ ও আছে ।
সোনাই নদী ছিল বহু মানুষের জীবিকার উৎস – জীবন সমৃদ্ধির ভরসা । চাষীদের সেচকার্যে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হত এর জল ও নদীতে প্রচুর মিষ্টি জলের মাছ ছিল আঞ্চলিক জনবসতির খাদ্যের যোগান। গঙ্গা নদীর ঘোলাটে পলি-মিশ্রিত জলের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ভাবে থিতিয়ে যাওয়া সোনাই এর অপেক্ষাকৃত শান্ত চকচকে জলই পানীয় জল হিসাবে বেশী ব্যবহৃত হত । আজ সবই গেছে সময়ের অতল গভীরে হারিয়ে ।
অনেক আগে থেকে ই নদীর গতিপথ ক্রমশ বেআইনী ভাবে ভরাট হওয়া শুরু হলে ও 1933 সালের পর থেকে আজ অবধি হয়ে চলেছে অসাধু উপায়ে নদী চুরি । অনবরত শুরু হল নতুন জমি পাওয়ার লোভে নদীর গতিপথ ভরাটের উল্লাস। নদী কোথাও এটা পরিণত হল মাঠে কোথাও কংক্রিটের ঘন বসতবাড়িতে । খন্ডিত নদী পরিনত হল ডোবা ,পুকুর বা বিলে । কল্যাননগর হয়ে ব্যারাকপুর থেকে ইচ্ছাপুর পর্যন্ত এই নদীর বৃহত্তর খন্ডাংশ সংকীর্ন খাল রূপে চিরবিদায়ের দিন গুনছে । মোহনপুর থেকে বড় কাঠালিয়ার দিকে এগোলে চোখে পড়বে আরো ভয়ঙ্কর চিত্র। কোথাও নির্বাক সোনাই এর অস্তিত্বের শেষাংশের উপরেও আবর্জনা দিয়ে বাঁধ দিয়ে মরনাপন্ন নদীর সম্পূর্ণ অবলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে মানুষ । ফলে একদা তরুনীর ন্যায় চঞ্চলা এই চলৎশক্তিহীন নদী প্রতিদিন হারিয়ে চলেছে তার প্রাণ ফিরে পাওয়ার সামান্য আশা টুকু ।
একসময় যে নদী ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট চওড়া ছিল এখন কোথাও তা মানুষের অত্যাচারে ৫০ থেকে ৩০ ফুট তো কোথাও আবার বড়জোর ১৫ ফুট বা তার চেয়ে ও কমে গিয়ে আজ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। সোদপুর, নাটাগর, ঘোলা অঞ্চলের বৃষ্টির জল বহন করে দক্ষিন ঢালে বিদ্যাধরী নদীর দিকে নিয়ে যেত এই সোনাই । এ এক প্রকৃতির নিয়মে তৈরী নিকাশী ব্যবস্থা ভূমিরূপের ঢাল অনুযায়ী । গত কয়েকশ বছর ধরে নদীর গতিপথ ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মান করে ফেলায় আজ একটু বৃষ্টিতেই ঘোলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে হাঁটু জল দাঁড়িয়ে যায় তা গোটা পশ্চিমবঙ্গের লোক বোধহয় জানে । সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেগে যায় এই জল নামতে । এই জলের দাবীদার তো ছিল পাশেই বয়ে চলা সোনাই নদী যা আজ ভরাট । রোজনামচা আর ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে আমরা ভুলে যাই এর মূল কারনটিকে । আর হারিয়ে যাওয়া নদীর কথা ভেবে মাথাব্যাথা কে-ই বা করবে তার চেয়ে বরং বছরের পর বছর রাস্তা উঁচু করলেই কিছু লোকের ধারনা আর জল জমবে না । প্রতি বছর রাস্তা উচুঁ করার বরাত টা যে একটা বাৎসরিক আয়ের পথ ও বটে । কাক নামক পক্ষীটিও জানে যে জমে থাকা আবদ্ধ জলে পাথর ফেললে সেই জলস্তর উপরে ওঠে । এই গল্প আমাদের সকলের ই জানা । নিকাশী ব্যবস্থায় তরলের গতিবিদ্যা ও নদীর পথের ভূমিকা নিয়ে সম্যক পর্যালোচনা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তব্যরত মহলের হাতে ছেড়ে ফেরা যাক আমাদের সোনাই এর ইতিবৃত্তে ।
‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে’—- কবিগুরুর এই লাইনটা বারবার ভারাক্রান্ত করে তোলে । যে প্রাণচঞ্চলা তরুনীর ন্যায় ছোট্ট নদীটি একসময় বয়ে চলত নিষ্পাপ লাবন্যে , আজ তার কাটা ছেঁড়া ক্ষতবিক্ষত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচয় হীন ভাবে এদিক-ওদিক পড়ে রয়েছে। তার পাশে গিয়ে মন নিবেশ করে তার কথা একটু ভাবুন । কান পেতে তাকে শুনলেই ষষ্ঠেন্দ্রীয় তে উপলব্ধি করবেন সোনাই এর নিঃশব্দ আর্তনাদ!
অনেক অজানা তথ্য জানা গেল