আমার মা ছিলেন দাদু দিদার একমাত্র সন্তান । তাই নিজের মামা , মাসি বলে যাদের কে জেনেছি ওনারা সবাই ছিলেন মায়ের খুড়তুতো ভাই বোনেরা । কিন্তু এত আন্তরিকতা , এতো ভালোবাসা ছিল যে সেই দূরের সম্পর্ক কোন দিনই আমাদের বুঝতে দেননি । সে কথা অনেক বড়ো হয়ে জেনেছি।
হাওড়ার জেলার পোদড়া , নাজিরগঞ্জ অঞ্চলে গঙ্গা নদীর অদূরেই ছিল মাসির বাড়ি । সুশান্ত , তোতন , বুম্বা , প্রশান্ত , পিনু , রমেন , কমল , ছাড়াও সেখানে আমার অনেক বন্ধু ছিল । স্কূলের বেশির ভাগ ছুটি ছাটার দিন বিশেষত দূর্গা পূজা থেকে শুরু করে কালি পূজা টানা প্রায় দশ বারো বছর ওখানেই কাটিয়েছি ।
রোডের লরি দাঁড় করিয়ে চাঁদা তুলে কতবার কালি পূজা করেছি । চাঁদা পত্তর কম উঠলে মূর্তি কেনার খরচ বাঁচিয়ে নিজেরাই মাটির মূর্তি বানিয়ে পূজা করতাম । পুরানো শাড়ি আর বাঁশের কাঁচা কঞ্চি দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি হতো ।
লিডার ছিল আমার মাসির ছেলে শ্যামল । সে ছিল প্রচন্ড অবাধ্য , একগুঁয়ে , বুদ্ধিমান , ব্যাদড়া , এবং ভয়ডরহীন ডানপিটে ছেলে । মেসোমশাই ছিলেন কড়া ধাতের লোক তা সত্ত্বেও শ্যামলকে আটকানো ছিল অসম্ভব । আর শ্যামল যেখানে আমিও সেখানে । কারোর তোয়াক্কা সে কখনোই করতো না । পূজার সময় পুরুত না পাওয়া গেলে শ্যামল নামাবলী গায়ে চড়িয়ে নিজেই পূজা করতে বসে যেতো ।
মেসোমশাই গার্ডনরীচের উল্টো পাড়ে জাহাজ তৈরির কারখানায় কাজ করতেন । তিনি ছিলেন খর্ব চেহারার মানুষ । প্রচন্ড সাহসী ও তুখোড় মেছুড়ে । মানে খালি হাতেও জল থেকে মাছ তুলে আনার ক্ষমতা ছিল তার , এটা গল্প নয় সত্যি । মেসোমশাই নাকি জলের গন্ধ শুকেই বলে দিতে পারতেন সেখানে কি মাছ আছে । একবার রাত্রি বেলা একটা কচ্ছপ ধরে রেখে বলে গেলেন আরেকটা আছে , আমি গন্ধ পেয়েছি , এটা একটা হাঁড়িতে চাপা দিয়ে রাখ আমি আসছি । বলে কিছুক্ষন পরেই আবার একটা কচ্ছপ ধরে নিয়ে এলেন । এ আমার নিজের চোখে দেখা ।
সমস্ত রকম সরঞ্জাম নিজের হাতেই বানাতেন । খেপলা জাল , ছাঁকনি জাল , ফাঁদিজাল , ঘুনি , আটোন , পোলো , বর্ষা , খোঁচ , হুইল , ছিপ , ছাড়াও আরও অনেক ধরনের মাছ ধরার সরঞ্জাম মেসোমশাই এর ছিল । সেগুলো তাঁর অলক্ষ্যে আমরা সৎব্যবহার করার চেষ্টা করতাম ।
মাসির বাড়ির পাশে অনেক ইট ভাটা ছিল । সারা বছর পলি জমানোর জন্য গঙ্গা সংলগ্ন বিরাট ঝিল বা খাঁড়ি মতো ছিল । মাটি কেটে ইট তৈরি হতো বলে তার গভীরতা ছিল প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট । শুধু মাত্র এডভেঞ্চারের নেশায় আমরা সেখানে মেসোমশাই এর খেপলা জাল নিয়ে দুচার হাত মারতে যেতাম । সেই ঝিলে মামার একটা ছোট নৌকা ছিল । বেশিরভাগ সময় সেটা লাওয়ারিশের মতো পড়ে থাকতো । সেটা চড়ে আমরা মৎস্য শিকারা করতাম । প্রধানত শ্যামল ই ছিল শিকারি । গ্ৰামের ছেলে বলে সাঁতার টা খুব ভালোই জানতাম । ফলে জলে আমাদের সেরকম ভয় ছিলো না ।
শ্যামল আমার থেকে দুই বছরের বড় । মেসোমশাই এর জালটা এত বড় ছিল যে সেটা কায়দা করে শ্যামল বেশ ফেলতে পারলেও আমার দ্বারা সম্ভব হতো না । আমার বয়স তখন মাত্র তেরো বছর । তাই মনে হতো সেটা আমার তুলনায় ওজনে ভারি । তাও চেষ্টা করতাম । দুপুর বেলা খাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমরা বেরিয়ে পড়তাম । কখনো কখনো মামার নৌকার নোঙর খুলে তাতে চড়ে মাছ ধরতাম ।
চিংড়ি , বেলে , গাঙধাড়া , বাটা প্রভৃতি মাছ জালে পড়তো । তবে প্রধান শিকার ছিল তারুই মাছ । এ মাছ সবাই চেনে না । খুব চালাক ,ধরাও খুব মুশকিল । জাল ফেলার সাথে সাথেই এরা সরে পড়তো । সাধারনত পাড়ের দিকেই আমরা জাল ফেলতাম । কারন মাঝে জলের থৈ অনেক গভীর । জালটা দশ হাত লম্বা, রশি সমেত সেটা তিরিশ ফুট । ফলে জাল নীচে পর্যন্ত পৌঁছাতো না।
সেদিন ছিল টৈটম্বুর জোয়ার , দুপুর বেলা দুইজনে লুকিয়ে মাছ ধরতে চলে এলাম । নৌকা খুলে দিয়ে আপন মনে মাছ ধরছি । চালানোর দরকার নেই এমনিই সেটা হাওয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে , নোঙর তোলা ।
জোয়ারের সময় মাছ ধরা কঠিন , নৌকায় দাঁড়িয়ে জাল ফেলতে হয় , তাই শ্যামল অনেকক্ষন জাল ফেলে হাঁফিয়ে উঠে বলল যে এবার তুই পারিস তো একটু চেষ্টা করে দেখ জাল ফেলতে পারিস কিনা । এসব বিষয়ে আমি বিশেষ পারদর্শী নই । রশির ফাঁস টা হাতে জড়িয়ে অপটু হাতে টলমল নৌকা থেকে জাল ফেলতে লাগলাম। কিন্তু কোনোটাই খেলিয়ে পড়লো না । জালে প্রায় দুই কেজির ওপর লোহার কাটি উপরন্তু জলে ভিজে আরোও ভারি হয়ে গেছে । এতবড়ো জাল খেলিয়ে ফেলাটা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর ।
এমন সময় আরেকবার চেষ্টা করে দেখলাম , কিন্তু তখনই ঘটলো বিপত্তি । মাছ ধরার নেশায় নৌকা কখন মাঝখানে চলে এসেছে সে খেয়াল নেই । সেদিকে লক্ষ্য না করে জালটা অপটু হাতে বাগিয়ে ছুড়তেই জাল মাটির দিকে ধাবমান হলো । গভীরতা বেশি তাই জাল মাটি না পেয়ে দড়িতে হেঁচকা টান পড়তেই আমি ভারসাম্য হারিয়ে জলে পড়ে গেলাম । নৌকায় শ্যামল আর হাতে রশি বাঁধা অবস্থায় আমি জলের তলায়।
শ্যামল প্রথমে বুঝতে পারেনি । কিন্তু আমি জল থেকে উঠছি না দেখে বুঝতে পেরেই ও ঝাঁপ দিলো । ওদিকে গভীর জলে আমার মরন বাঁচন লড়াই চলছে , হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় বিশেষ দম নেওয়ার সুযোগ পাইনি । সাঁতার জানলেও জালের রশি হাতে বাঁধা তাই বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না । দম ফুরিয়ে আসছিলো ।
গঙ্গার ঘোলা জল, তিরিশ চল্লিশ ফুট নীচে জলের ভীতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না , এমন সময় জলের তলায় হাতে আরেকটা কিছু ঠেকলো । বুঝলাম ওটা শ্যামলের হাত । শ্যামল নীচ থেকে আমাকে জাল সমেত টেনে উপরে তুলে নিয়ে এলো । নৌকায় উঠে দম ফেললাম ।
ব্যপারটা সবাই হয়তো অনুধাবন করতে পারবে না , গভীর জলে মরন বাঁচনের ঘটনাটা এমনই ভয়ঙ্কর ছিলো । পাছে কেউ জেনে যায় সেই ভয়ে আবার লুকিয়ে ফিরে এলাম । জাল যথাস্থানে রেখে ভিজে জামা প্যান্ট পাল্টে সাধু সেজে আবার ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । সন্ধ্যায় দুটো বড় বেলে মাছ আর কিছু চিংড়ি মাছ ধরে নিয়ে এলাম । তাই দিয়ে রাতে তরকারি আর রুটি খাওয়া হলো । সেদিন শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে যদি সঠিক সময়ে শ্যামল ডুব সাঁতার দিয়ে না আসতো ? যদি আমাকে না খুঁজে পেতো ? কিংবা জাল থেকে হাতের ফাঁস যদি না খুলতো ???
কি জানি ঠাকুর হয়তো সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন । সত্যিই রাখে হরি মারে কে ?