তাঁর কাছাকাছি অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু সেবারের অভিজ্ঞতাটা ছিলো একটু অন্য। সোমেন দা তৃতীয়বারের জন্য সভাপতি হয়েছেন ২০১৮ তে ; দিল্লি গিয়েছেন রাহুল গান্ধীর সাথে নবনিযুক্ত কমিটির জরুরির বৈঠক। সোমেন দার ছায়া সঙ্গী আমি। মিটিং এর পরদিনই সম্ভবত সোমেন দা, শিখা মিত্র ( বৌদি) এবং আমি প্রণব বাবু’র বাড়িতে গেলাম। কথাবার্তা চলছে সোমেন দা, বৌদির সাথে প্রণব বাবুর। রাজনীতি থেকে পড়াশোনা, শবরীমালা বিতর্ক সব আলোচনার মাঝে সোমেন দা হঠাৎ প্রণব বাবুকে বললেন, রাজা কিন্তু খুব ভালো লেখে। আমায় অবাক করে দিয়ে প্রণব বাবু বললেন, “আমি জানি তো, আজকাল-এ নাটকের রিভিউ পড়েছি ওর..।” সোমেন দাও অবাক। কারণ সোমেন দাও জানতেন না, আমি আজকাল-এ নাটকের রিভিউ লিখতাম, আমিও বলিনি কখনো। প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, রাজনীতিবিদ, ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ, রাষ্ট্রপতি, কুটনীতিবিদ কিম্বা বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীত্ব সামলানো ক্রাইসিস ম্যানেজার প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে আলোচনা করা আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে অন্ধের হস্তী দর্শন মাত্র। তাই এইসব বৃত্তের বাইরের এক রাজনীতিবিদকেই রাজনীতির এক সামান্য ছাত্র হিসেবে খোঁজার চেষ্টা করব।
টানটান টেনশনের জঙ্গিপুরের ইলেকশন প্রচারে বেড়িয়েছেন। ছাত্র পরিষদের কর্মী হিসেবে সম্রাট তপাদারের সাথে আমরা প্রচারে গিয়েছি। প্রার্থী প্রণব বাবুর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা, দেখি গাড়িতে বসে প্রার্থী সুধীন দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা হাতে নিয়ে নিবিষ্ট পাঠে ডুবে। এই প্রণব বাবুকেই চেনার চেষ্টা করেছি বারবার।
তাঁর মুখেই শুনেছি… “কলকাতার ছোকরাগুলো যেভাবে লিটিল ম্যাগাজিনের পিছনে বাপ-মা এর টাকার শ্রাদ্ধ করে তা সারা বিশ্বে কোথাও দেখিনি…কি লড়াই যে ছেলে-মেয়েগুলো করে…।”
‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকাটি জন্ম নেওয়ার লগ্নে প্রণব মুখার্জি এবং তাঁর প্রয়াতা স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির নেপথ্য ভূমিকা হয়ত অন্তরালেই থেকে যাবে। কলকাতায় আসলেই একটা সময় ‘প্রতিক্ষণ’ দফতরে ঢুঁ মারা ছিলো মানুষটার নিয়মিত রুটিন।
‘প্রতিক্ষণ’ -এর পক্ষ থেকে একটা সময় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে কেন্দ্রীয় বাজেট প্রকাশের পরদিনই বাজেট বিশ্লেষণের আয়োজন করা হতো, করতেন ড. ভবতোষ দত্ত। বাংলায় সেই প্রথম বাজেট বিশ্লেষণের রেওয়াজ শুরু, বলা বাহুল্য নেপথ্যে ছিলো প্রণব বাবু’র উদ্যোগ।
এই যে আজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাম ও উদার জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে একত্রিত করে একটা কমন প্ল্যাটফর্ম গঠনের চিন্তা -ভাবনা; সাহিত্য জগতে ‘প্রতিক্ষণ’ বোধহয় তারই সূতিকাগার ছিলো এই বাংলায়, যার সেতুবন্ধনের কাজটা প্রণব বাবু করতেন।
যখনই সময় পেতেন বইয়ের ভিতর ডুবে থাকাটা মানুষটার নেশা ছিলো। কংগ্রেস রাজনীতি, দেশ-বিদেশের সমস্যা, কখনো প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব সব কিছুর দায়িত্ব সামলেও এমন স্থিতধী মানুষ খুব অল্প দেখেছি। রাজনীতিতে ‘ধী’ শক্তির যে প্রয়োজনীয়তা তা তাঁর মধ্যে ছিলো, যা যেকোনো তাবড় রাজনীতিবিদের কাছেই ঈর্ষনীয়।
২০০৩ সালে দিল্লিতে এন.এস.ইউ.আই -এর সর্বভারতীয় সম্মেলন ‘দৃষ্টিকোণ’-এ প্রতিনিধি হিসেবে গেছি, সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রণব বাবু ‘ভারতীয় অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি’ নিয়ে বক্তব্য রাখবেন। যেই বক্তব্য রাখতে উঠলেন, শিবাজি স্টেডিয়ামে স্লোগান উঠলো প্রণব মুখার্জি জিন্দাবাদ। স্পষ্টত বিরক্ত প্রণব বাবু বক্তব্য শুরুই করলেন এই বলে…
“..কারো নামে জিন্দাবাদ দিলেই সে বেঁচে থাকে না, আবার মুর্দাবাদ দিলেই সে মরে যায় না..।” এই চরম নির্বেদ নিস্পৃহতাই ছিলো বোধহয় প্রণব মুখার্জির ইউ.এস.পি।
সেবারেই ফেরার সময় টিকিটের টাকা নেই। আমাদের দলে তো সম্মেলনে যাওয়া আসার জন্য প্রতিনিধিদের ট্রেন ভাড়া দল দেয় না কোনোদিন, নিজেদেরই ব্যবস্থা করতে হয়। আমরা সম্মেলনের শেষের পর দিন গেলাম তালকোটরা রোডে ওনার বাড়িতে। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটা করলো সম্রাট তপাদার। প্রণব বাবু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “এই জন্যই সকাল বেলা দল পাকিয়ে আসা হয়েছে? “। এ কথা সে কথার পর বেড়িয়ে আসলাম, ওমা হঠাৎ দেখি ওনার সিনিয়র আপ্ত সহায়ক এম.কে.মুখার্জি বাবু একটা মোটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, ” দাদা, ১৫ হাজার দিয়েছেন তোদের গাড়ি ভাড়ার জন্য..। “
সদ্য তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে তৃণমূল এগিয়ে গ্যাছে; হতাশাজনক ফল কংগ্রেসের, সেই সময় একটি টি ভি চ্যানেল কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,… ” সাফল্যতেও মাথা ঘোরে না আবার ব্যর্থতার শূণ্যতাতেও হতাশ হই না..”।
বাঙালীয়ানা নিয়ে প্রণব বাবু র একটা চাপা আভিজাত্যই হোক কিম্বা শ্লাঘাই হোক, তা আমার নজর এড়ায়নি। একটা ব্যাপার বললে, ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ছিলো একেবারে রাঢ় বাংলার অ্যাকসেন্টে,জীবনে কখনো তা বদলাবার চেষ্টা তিনি আদেও করেননি; হয়ত তা সচেতন ভাবেই। একবার কথায় কথায় তাঁর মুখে শুনেছিলাম… ” একজন বাংলা জানা ইংরেজ কি আমাদের মতো করে বাংলা বলেন..?
প্রণব বাবুর মৃত্যুতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বোধহয় শেষ ধুতি পাঞ্জাবি পড়া বাঙালির প্রতিনিধিত্বের জার্নিতে ছেদ পড়লো। সেই ছেদরেখা কবে, কিভাবে মুছবে? আদেও মুছবে কি, না? তার উত্তর নিশ্চিত ভাবেই সময়ের গর্ভে।
অশোক ভট্টাচার্য (রাজা)
Good