প্রণব বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক ছিল বাংলার। তিনি সবসময় কংগ্রেসের হাইকমান্ডের অনুগত থেকেছেন, বড় বড় মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন, কিন্তু বাংলার দিকে তাকান নি কখনো। বাংলার জন্য কোনও প্যাকেজ, অতিরিক্ত সুবিধা আনার চেষ্টা করেন নি।কেউ বলেছেন ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরে বেড়ানোতেই তার আনন্দ। আবার কারোর মতে পৌরসভায় দাঁড়িয়েও জিতে আসার ক্ষমতা ছিল না তাঁর।
সত্যিই জননেতা তিনি ছিলেন না কোনোকালেই।দিল্লির সরকারের অলিন্দেই তিনি ঘোরাঘুরি করেছেন এটাও সত্য। কিন্তু তাঁর ক্ষমতায় থাকার জন্য হাইকমান্ডকে যতটা দরকার ছিল, হাইকমান্ডের তাঁকে দরকার ছিল অনেক বেশি।রাজনীতিবিদ অনেক রকম আছে, কেউ রাজনীতি করে আবেগ দিয়ে, কেউ গলা দিয়ে, কেউ পরিবার দিয়ে, কেউ জাতপাত দিয়ে আর কেউ মাথা দিয়ে।এই মাথা দিয়ে রাজনীতি করার মানুষগুলি সেভাবে খবরে বা হাইলাইটে থাকেন না। শুধু যখন দল বা দেশ সমস্যায় পড়ে তখন ডাক পড়ে মগজমিসাইলের। এই ঠাণ্ডা মাথা আর অদ্ভুত দৃঢ় প্রজ্ঞার জন্যই বেঁটে বাঙালি ছাপিয়ে গেছেন অনেক বড় বড় মাথাকে।হয়ে উঠেছেন সরকারের ক্রাইসিস ম্যানেজার।
আদ্যোপান্ত ধুতি পাঞ্জাবীর, মিষ্টি করে বাঙালি ঢঙে হিন্দি বলা, মৃদুভাষী বাঙালি হয়েও তিনি বাংলায় আটকে থাকেন নি। দেশ বা কেন্দ্রই ছিল তাঁর কাছে প্রধান। তাই ইন্দিরা গান্ধী থেকে সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে সনিয়া বা রাহুলও ভরসা করেছেন তাঁর ওপর।১৯৬৯ থেকে পাঁচ দশক তিনি ভারতীয় রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে রয়েছেন।শুধু আনুগত্যে এই গুরুত্ব পাওয়া যায় না, চাই কোয়ালিটি। আর তা ছিল বলেই ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে অর্থ মন্ত্রকের ভার দেন।তারপর থেকে প্রতিরক্ষা,বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক বাঘা বাঘা মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেন তিনি।জনপ্রিয়তার অভাবজনিত কারনেই হোক বা রাশ আলগা হবার ভয়েই হোক দলের পক্ষে প্রধান্মন্ত্রীর জন্য তাঁকে বিবেচনা করা হয় নি কখনও। কিন্তু তিনি ধোনির টিমের গম্ভীরের মতো,বা সৌরভের টিমের দ্রাবিড়ের মত নীরব অথচ অপরিহার্য সেকেন্ড ম্যান হিসাবে রয়ে গেছেন মন্ত্রীসভায়।যখনই সমস্যা এসেছে মেরামত করেছেন তিনি। মনমোহন সিং এর বাইপাসের সময় এই প্রনব বাবুই একসাথে বিদেশ এবং অর্থের মতো দুই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলেছেন একসাথে। বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে ২০০৮ এ ভারত মার্কিন অসামরিক পরমানু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, আবার ২০০৯ এর মন্দার সময় অর্থদপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে ভারতের অর্থনীতিকে রক্ষার চেষ্টায় ব্রতী হন। বারবার বুঝিয়ে দেন এই বাঙালির ব্রেন অন্য ক্লাসের।উল্লেখ্য আজকের জিএসটির উল্লেখ তিনিই প্রথম করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক সম্মান কিছু কম পান নি। ১৯৮৪ সালে ইউরো মানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার , বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাঙ্ক এর মত আন্তর্জাতিক সংস্থার বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্যপদ লাভ করেন বিভিন্ন সময়। ১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অফ 24 এর সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালের মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন।এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্মানের পালক আছে তাঁর মুকুটে। কিন্তু কোনোদিন জাহির করেন নি নিজেকে।
আজকের রাজনীতিবিদ মানেই কুকথা, তথ্যহীন হাস্যকর যুক্তি, দুর্নীতির দাগ লাগা যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিনি তার থেকে ছিলেন হাজার মাইল দূরে। কখনো কুকথা বলেন নি ভুলেও।ভুল তথ্য দেওয়া তাঁর চরিত্রে ছিল না কখনো। সৌজন্যে তিনি ছিলেন বিশেষ গোত্রের। সবসময় হাসি মুখ, মিষ্টি মৃদু ভাষা, হিন্দি ইংরাজি শুনতে কানের আরাম।যখন তিনি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বামেরা তাকে সমর্থন দেওয়ায় কেউ কেউ তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়া আটকাতে প্রবল চেষ্টা করছেন। তার রাষ্ট্রপতি হওয়া আটকাতে যখন তারই রাজ্যের থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডক্টর এ পি যে আব্দুল কালাম, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের এর নাম প্রস্তাবিত হচ্ছিল তিনি তখনও নিশ্চুপই ছিলেন । রাষ্ট্রপতি হবার পর রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁকে শাল দিয়ে দাদা সম্বোধন করে সম্বর্ধনা জানালেন, তিনি হাসি মুখেই গ্রহন করলেন তা। এভাবেই সৌজন্য দেখিয়েছেন বারবার।
আমার সেরা অভিজ্ঞতা তাঁকে রাষ্ট্রপতি দেখা। হোক না নিয়মতান্ত্রিক প্রধান তবুও স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তোলা, দেশের সাংবিধানিক প্রধানের পদ অলংকৃত করা এ কি কম ব্যাপার নাকি? নেতাজিকে বঞ্চিত হতে দেখা, জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে না দেখার আফসোস বাঙালি মিটিয়েছে বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে পেয়ে।দেশের প্রধান পদে এক বাঙালিকে শপথ নিতে দেখে আবেগে ভেসেছে বাঙালি। সম্ভব হয়েছে প্রনববাবু ছিলেন বলেই।
দেশের ক্রাইসিস ম্যান দেশের এই ক্রাইসিসের সময়ে আচমকাই পড়ে গিয়ে চরম ক্রাইসিসের মধ্যে চলে গেলেন। অনেক চেষ্টা লড়াইএর পর হার মানলেন তিনি জীবনের কাছে। ভারতের রাজনীতির এক রত্ন খসে গেল। এবার পুজোয় বীরভূমের কির্ণাহারের মিরাটির মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজোটা অন্ধকার হয়ে গেল।গরদের কাপড় পরা মানুষটি আজ অনেক দূরে।
বিদায় প্রনব মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় রাজনীতি মিস করবে আপনাকে। অনেকদিন…
চিত্র সংগ্রহ : গুগল, ইন্টারনেট
পার্থ চক্রবর্তী