ফেরা … ( দ্বিতীয় পর্ব )

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
5 রেটিং
1674 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 2 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

প্রথম পর্বের লিংক
https://www.saabdik.com/fera/

বাবলি এসে অমলকান্তি বাবুকে আর স্বজ্ঞানে আর সচেতনভাবে দেখতে পায়নি । সেই থেকে আজ অব্দি দুবেলা সময় পেলেই তিনতলার এই ঘরটাতে উঠে আসে ও.. পাশে বসে , গল্প করে সারাদিনের .. কলেজের , বন্ধুদের, ক্লাস নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়া প্রফেসরদের .. এমনকি চুপি চুপি তার কথাও বলে, যাকে কলেজের করিডোরএ আজকাল একঝলক দেখতে পেলেই ওর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায় । কেমন একটা  ভয়ে সারাগায়ে কাঁটা দেয়। বাবলি বলে, কেমন করে সে তার সামনে দিয়ে হেঁটে করিডোর পেরোনোর সময় তার সদ্য কামানো সবুজনীলাভ গাল, সারাগায়ে জড়িয়ে রাখা নাম নাজানা কোনো সুগন্ধি আফটারশেভ এর তীব্র পুরুষালি গন্ধটা ওকে স্থবির, স্থানুর মতো দাঁড় করিয়ে রাখে । এসব কথা খুব কাছের বন্ধু হিসাবে অর্ক বা সুমন ছাড়া আর কাউকেই বলার নয় , তবুও ওর ইচ্ছা হয় এসব বলতে । ভালোলাগার রেশগুলো দিনান্তে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন হামাগুড়ি দিয়ে ওর সারা বিছানায় চলেফিরে বেড়ায়।  ঘাড় কাত করে যেন তাদের দেখে হাসে, শিহরিত হয় হঠাৎ হঠাৎ । দাদু যদি আগের মতো সুস্থ থাকতো তো, বাবলি নিজেই হয়তো একদিন ঋষি এর ব্যাপারে তাকে জানাতো । পড়াশুনাতে কোনোদিনই আহামরি কিছু নয় বাবলি, বরং মিডিওকার-ই বলা যেতে পারে । তবুও, অল্পদিনের মধ্যেই কলেজে একটা পরিচিতি পেয়েছিল সে। সেটার কারণ যত না, দিনের বেশিরভাগ সময়েই union room এ বসে গুলতানি দেওয়া আর কয়েকটা ফেস্টুন লেখার জন্য, তার থেকেও বেশি ওর tomboy মার্কা লুকের জন্য । বন্ধু বলতে শুধু অর্ক আর সুমন, মেয়ে বন্ধু প্রায় নেই বললেই চলে । ওর এই ইমেজ এর জন্য কেউ কেউ যেমন ওকে এড়িয়ে চলতো, তেমন কেউ কেউ ওকে আড়াল থেকে দেখা শুরু করলো। ঋষির বর্তমানের  গার্লফ্রেন্ড যে মেয়েটি, সেই মেয়েটাও কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভাবে বাবলিকে দেখা শুরু করলো । চোখাচোখি হলেই অন্যান্য বান্ধবীদের সাথে হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো । বাবলি প্রথম দিকে বিষয়টা নিয়ে অটো পাত্তা না দিলেও পরে তা বেশ বিরক্তিকর জায়গায় চলে গিয়েছিল । একদিন কলেজে এর অনার্সএর ক্লাস এর পর দেবলীনা নামের মেয়েটিকে ডেকে সরাসরি জানতে চেয়েছিল । দেবলীনা যে চোখের জলে নাকের জলে এক করবে তা ওর মতো ন্যাকা মেয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল, আর এটা বাবলি জানত । জানতোনা যেটা সেটা হলো, পরের দিন কলেজে ঢুকেই ওকে ঋষির মুখোমুখি হতে হবে । সেই প্রথম ঋষিকে ওর দেখা.. ওদের দুজন এর মধ্যে সেদিন বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল, কিন্তু সেই উত্তাপ এর মাঝেই যে ভালোলাগার নরম পরশ ওমের মতো কখন ওকে ঘিরে ধরলো তা বুঝতে বুঝতেই গোটা একটা মাস কেটে গিয়েছিল । দুজনেই সেদিন এর পর থেকে দুজন কে এড়িয়ে বা পাশকাটিয়ে চলে যেতে শুরু করেছিল, তবুও তারমাধ্যেই বাবলির বুকের বাঁদিকটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠতে থাকলো ক্ষনিকের চোখাচোখির মুহূর্তগুলোতে , কেমন যেন একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হতে লাগলো । পাত্তা দেবেনা.. দেবেনা করেও বাবলি একদিন আবিষ্কার করলো ঋষি ভীষণ বিচ্ছিরি কেউ থেকে বিশেষ কেউ হয়ে গেছে কবে যেন ।

সেদিন বাড়ি ফিরে খুব একচোট কেঁদেছিলো বাবলি । কলেজের tomboy, Union room’এ বাকি ছেলেদের সাথে বসে টেবিলে বাজানো , ফেস্টুন লেখা, ছেঁড়া জিন্স পড়া ভীষণ অগোছালো নন্দিতা রায়ের  ভিতরেও যে মেয়েলি বাবলিটা এভাবে নিজের অস্তিত্ব প্রমান দেবে তা ও স্বপ্নেও ভাবে নি কখনো । ওর মতো মেয়ে কিনা শেষমেশ একটা মেয়ে পটানো, চরম নাক উঁচু , অসভ্য ছেলের প্রেমে পড়বে এ ওর কল্পনারও বাইরে ছিল.. কান্নার মধ্যেও ঋষির মাথাউচু লম্বা চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবলির.. ছ’ফুট তো হবেই.. উফফ … ভাবতেই কেন জানি না আরো হু হু করে উঠলো বুকটা.. কান্না গেল বেড়ে।  কান্না থামলে সেদিন বাবলি চুপিচুপি উঠে এসেছিল দাদুর কাছে। আয়ামাসি কাছাকাছি যে নেই, সেটা সতর্ক দৃষ্টিতে একঝলক দেখে দাদুর কানে কানে বলেছিল ওর প্রথম ভালোলাগা.. ওর প্রথম প্রেম এর কথা। দাদু শুনেছিল কিনা , বা শুনলেও বুঝেছিল কিনা তা ও জানে না, শুধু একপরিতৃপ্তি লাভ করেছিল, যেন এক আকাশ মেঘের থেকে বৃষ্টির পর চারপাশ শান্ত আর ভেজা ভেজা হয়ে থাকে, যেমন মাঠের সবুজ আর আকাশের নীলটা  মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে, দাদুকে বলার পর ওর মনটাও তেমনি হালকা ভারহীন , মেঘমুক্ত আকাশের মতো লেগেছিল ।

প্রেমটা একতরফাই। ঋষি আদৌ বোঝে কিনা বাবলি সেটা এখনো অব্দি বুঝে উঠতে পারেনি, রোজকার ক্লাস, লেকচার সেমিনার আটেন্ড করার মধ্যে দিয়েই অধ্যেক সময় কেটে যায়। বাকি যেটুকু পরে থাকে, তাতে অর্ক আর সুমনের বকবকানি শুনতে আর ওদের সাথে  ইয়ার্কি মারতে মারতেই কেটে যায়। মনের মধ্যে একটা খচখচানি যে একেবারেই চলে না, তা নয় .. কিন্তু ঐটুকুই। ওর সাহসে কুলোয় না, এর বাইরে কিছু ভাববার। union room এ দুএকজন কমন ফ্রেন্ড যারা আছে, তাদের সাথে কথা হলে অনেক সময়েই ভেবেছে যদি ঋষির কথা কেউ বলে, কিন্তু সেভাবে কীই বা আর বলার থাকতে পারে। অস্বস্তিটা দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। দেবলীনা নামের মেয়েটির সাথে মাঝে মধ্যে ঋষিকে ঘুরতে দেখে নিজের মনেই নিজের বোকামির জন্য গাল দেওয়ার পরেও রাতের আলোআধারীতে ঘরের এককোনে অস্বস্তিটাকেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েছে বাবলি। যে গানগুলো ঈপ্সিতা, নবমিতা বা কোয়েলরা শুনতো বলে, “ ইসসস, এসব কি শুনিস.. যত্তসব ন্যাকামির গান..” বলে ওদের খিল্লি করতো, আজকাল কানে হেডফোন গুঁজে সেই গান গুলোই শোনে চুপিচুপি আশেপাশে কেউ না থাকলে। পলিটিক্যাল ফেস্টুন, জ্বালা ধরানো বক্তৃতা বা সিরিয়াস কোনো ইস্যুতে লেখালেখির বদলে আজীবন এড়িয়ে চলা কাব্য,কবিতা বা নিদেন পক্ষে হাহুতাশ করা প্রেমিকের দুই লাইনের পদ্য ওকে ভাবায় বেশি। মাথা ঝিম ধরে থাকে, মেজাজ খিঁচড়ে থাকে বিনা কারণে। কি যে সব যাচ্ছেতাই হচ্ছে ওর সাথে, ভেবে কুল পায় না বাবলি। যেমন ভেবে পায় না, একটা মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে, তাকে ভুলে যেতে কারো ঠিক কতটুকু সময় লাগে!

“ দেশের বাড়ির কাঁঠালগাছটা এবার বেচেই দে দাদা, কি আর হবে… কে করবে দেখভাল..। তারচেয়ে বরং যা টাকা পাওয়া যাবে, ভাইবোনেরা মিলে ভাগ করে নিলেই হলো..” সেদিন পিসির বাড়িতে ভাইফোঁটা দেওয়ার পর কথাটা বলেছিল বাবাকে পিসি। বাবলির একটুও ভালোলাগেনি গাছ বিক্রির প্রস্তাবটা। ওটা ঠাম্মার নিজের হাতে পোঁতা গাছ, ঠাম্মার কোনোকিছুতেই কারো হাত পড়ুক বাবলি ভাবতেই পারেনা জাস্ট । বিক্রির তো প্রশ্নই ওঠেনা । সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বাবার সাথে এই নিয়ে বেশ খানিক ঝগড়াই করে ও ।

আজ অনার্স -এর ক্লাসের শেষে ডেস্কে মাথা রেখে চুপ করে বসে এসবই ভাবছিল বাবলি। পুজোর ছুটির পর কলেজ খুললেও, খুব একটা কেউ আসছেনা। ফাঁকাই রয়েছে পুরো কলেজ প্রায় । uninon room’ এও তাই বিশেষ কিছু কাজ নেই ওর। তাছাড়া  ঋষির ব্যাপারটা নিয়ে মাথাব্যথাতো আছেই । তারওপর এই উটকো মনখারাপ। ভালোলাগছেনা কিছু ওর। নয়মাস হয়ে গেল ঠাম্মা নেই.. ঠাম্মার গন্ধটা আজও পায় বাবলি, কি মিষ্টি একটা গন্ধ।

ঠিক যেন ওদের চন্ডীমণ্ডপের গন্ধটা.. কাঁচা মাটির .. একচালার প্রতিমার .. খড়ের .. ধূপের .. ভোগের.. নতুন শাড়ির মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া গন্ধ একটা। ঠাম্মার সারাগায়ে সারাক্ষন লেগে থাকতো সেটা। ঠাম্মার দেরাজটা ছিল ওর সবচেয়ে লোভের জায়গা। কত কি যে রাখা থাকতো ওটার মধ্যে বাবলি ভেবেও কূল পেতনা। কদমা, বাতাসা, চানাচুর, গুঁড়োদুধ … এগুলো তো ছেড়েই দিলো, কিন্তু আমের আচারের ওই শিশিটা, কিংবা,, সাদা মুক্তদানার মতো নারকেল নাড়ু ভরা বড়ো কাঁচের বোয়ামটা। বাবলি এর দিন কেটে যেত বিশাল দেরাজটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে করতে। কখন একটা সুযোগ আসবে, কখন ঠাম্মা কাজের তাড়াহুড়োতে দেরাজের তালাটা লাগাতে ভুলে যাবে.. আর কখন ঘর ফাঁকা থাকবে.. ব্যাস.. ব্যাস..একটা তেমন সুযোগ, চোখের নিমেষে কাজ হাসিল করেই বাবলি দেছুট…। একবার তো আচারের পুরো শিশিটা নিয়েই ও পগারপার হয়েছিল। বেলা গড়িয়ে দুপুরবেলায় যখন বাড়ির উঠোনে পা দিলো, ঠাম্মা তখন চিলচিৎকারে করে বাড়ি মাথায় তুলেছে, আর দাদু বুঝিয়ে ঠান্ডা করছে..” আহা, দিদিই তো নিয়েছে, ওর জন্যই তো বানানো.. দশদিন ধরে না খেয়ে একদিনে খাচ্ছে..”

বিকেলে লম্বা টানা বারান্দাটায় বসে পড়ন্ত রোদের দিকে পিঠ করে বসে ঠাম্মা যখন চুল বাঁধতে বসত, বাবলি পা টিপেটিপে গিয়ে পিছন থেকে “ঠাম্মা’ বলে গলা জড়িয়ে ধরতো.. “ ছাড়.. ছাড় আমায় মুখপুড়ি.. পুরো আচারটা শেষ করে দিলো একদিনে.. চিনির কত দাম.. কত কষ্ট করে রোদে দিয়ে বানালাম.. ছাড় আমায় মানু.. আমি খুব রাগ করেছি..” চোখদুটো ভিজে এলো নন্দিতার। কতদিন হয়ে গেল মানু ডাক শোনে না..

“আরে তুই এখানে … ওদিকে…” শ্বেতার গলার আওয়াজে আচমকা ধড়মড় করে উঠলো সে। “একিরে তুই কাঁদছিস..! কি হয়েছে রে.. এনিথিং রং .. হোয়াট হ্যাপেন্ড বেবি ..” তাড়াতাড়ি চোখে কোনটা মুছে নিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিলো নন্দিতা।

“ নাথিং রে.. বল.. কিছু বলবি?” শ্বেতা একটু চাপ দিতে গিয়েও দিলো না.. “ হাঁ, মানে তোকে ঋষি খুঁজছিল ..”

ধড়াস করে উঠলো ওর বুকটা.. ঋষি ওকে খুঁজছিল, হঠাৎ..?

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল