ফেরা … (পঞ্চম পর্ব)

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
5 রেটিং
1480 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

প্রথম পর্বের লিংক:
https://www.saabdik.com/fera/
দ্বিতীয় পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/fera_2/
তৃতীয় পর্বের লিংক:
https://www.saabdik.com/fera-3/
চতুর্থ পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/fera-4/


ধর্মতলার মোড়ে প্রায় আধঘন্টার ওপর দাঁড়িয়ে বাবলি। ও জানে এমনটা নতুন কিছু নয়,  দিনের পর দিন কলেজে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে চলে আসে এই নিউ মার্কেট চত্বরে।এমনটা আজ প্রায় দেড়মাস ধরে ঘটছে  প্রতিদিন। এরপর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, এটা সেটা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করা বা কখনোবা টুকটাক কিছু কেনাকাটা। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তিবোধ করতো.. মনে হতো চারপাশের সবাই শুধু ওকেই দেখছে। ওর চোখমুখের কষ্ট, যন্ত্রনার ছাপ, দুচোখের তলার কালি, ক্লান্তির ছাপ যেন ওকে বেআব্রু করে দিত অচেনা দৃষ্টিগুলোর সামনে।  অনেক লোক .. হরেকরকমের আওয়াজ .. ঠেলাঠেলি ওর স্থবির হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা দিত । বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র যন্ত্রনায় ওর ভিতর থেকে কি যেন একটা পাক দিয়ে উঠে আসতো , ওর সারা মাথা ছিঁড়ে পরে প্রচন্ড চিৎকারে ঝনঝন করে উঠতো .. অথচ মুখ থেকে একটা শব্দও বের হতো না। সামনের যা কিছু সব যেন দুলতে থাকতো  .. সবাই যেন ওকেই খালি দেখতো .. ওর দিকে তাকিয়ে হাসতো মুখটিপে, কথা বলতো ফিসফিসিয়ে.. বাবলি মাথা চেপে বসে পড়তো ফুটপাতে। একটা সময় পর উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিত জনস্রোতে , ধাক্কা আর ঠেলাঠেলির মধ্যে হাঁটতে থাকতো দিকশূন্য হয়ে । এভাবেই ধীরে ধীরে অচেনা এই পৃথিবীটাকে সে আশ্রয় করে নিয়েছিল নিজেকে আড়াল করার জন্য। 

এভাবেই হয়তো চলতো আরো বেশ কিছু দিন ,কিন্তু তার মধ্যেই একদিন এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় আচমকাই মাথাঘুরে অজ্ঞান হয়ে যায় ও। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে যে ভয়টা  পেয়েছিল, সেটাই সত্যি হয়েছিল। 

এরপরের দিন গুলো কান্না, অপমান, লোকলজ্জার ভয়… সবকিছু নিয়ে যেভাবে কেটেছিল, আজ সেসব ভাবলে মনে হয় ওর চেনা দুনিয়াটা একলহমায় সেখানেই থমকে গেছে এজন্মের মতো। দাদুর সদ্য চলে যাওয়া আর তার পর এই ঘটনার জেরে পুরো পরিবারের ওপর যেন পাহাড় ভেঙে পড়েছিল। ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বালুকাবেলার মতো বিধ্বস্ত একাকী হয়ে গিয়েছিল বাবলি। যে আসতে চলেছিল, তাকে আটকানো ছাড়া আর কোনো রাস্তায় খোলা ছিলোনা ওর সামনে, নার্সিংহোম থেকে ফেরার  ঠিক একমাসের মাথায় বাবলি বাড়ি ছাড়ে। সন্তান হারানোর যন্ত্রনা ওকে বেপরোয়া করে তুলেছিল। 

সকাল থেকেই আজ মেঘলা হয়ে আছে আকাশটা, বাবলির একবার হাসনাবাদ  যাওয়ার আছে। কাল থেকে জানুর মেয়েটার জ্বর নামছে না, এখন চারদিকে যে পরিমান ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে.. ছোট্ট দুধের শিশু। মায়ের শেষ সম্বল। জানুর কাছেই শুনেছিল, নিকাহ করার ছয়মাসের মধ্যেই জানুর মরদ ওকে অন্য এক মেয়ের জন্য ছেড়ে চলে যায়, এই মেয়ে তখন জানুর পেটে। অবশ্য ওদের এসব গাসওয়া, হামেশাই ঘটে। তবুও, চরম দারিদ্র আর একাকিত্বের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা। ওদের এই লড়াইয়ের সাথে আজ প্রায় দেড় বছর হতে চললো বাবলি ওতপ্রোতভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। খাওয়া আর ঘুমটুকু ছাড়া বাড়িতে ওর সেভাবে থাকাই হয় না। এই জগৎটা যেন বাইরের জগৎ থেকে আলাদা, অন্য এক পৃথিবী। ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষগুলোর ধুলো ঝেড়ে উঠে আবার লড়াই করার পৃথিবী। হার না মানতে শেখার, শত কষ্টের মধ্যেও মুখে হাসি ধরে রাখা যায় কিভাবে বাবলি এই খেতে খাওয়া মানুষগুলোকে না দেখলে বিশ্বাসই করতো না। ও  এখানকার মহকুমা হাসপাতালে জনস্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যুক্ত একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে কাজ করে। সারাদিন অজস্র মানুষের সাথে ওঠাবসা, তাদের অসুবিধা অভিযোগ শোনা, প্রতিক্ষেত্রে না পারলেও যতটা সম্ভব ওদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা.. দিনগুলো কেটে যায় চোখের পলকে।

প্রথম প্রথম কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হলেও, ওর বরাবরের হার না মানা মনোভাব আর জেদ দিয়ে সেসব সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছে খুব দ্রুত। শুধু ফেলে আসা কিছু সময়ের  কথা মনে পড়লে আজ কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে ওর.. চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভিড়ে ঠাসা রাস্তা আর তাতে অজস্র মানুষের চিৎকার। দুহাতে কান চাপা দেয়, চোখ বন্ধ করে আপ্রাণ আটকাতে চায় ভিতর থেকে উঠে আসা এক অব্যক্ত যন্ত্রণার বেগ। 

বৃষ্টি আসার আগেই পৌঁছাতে হবে ভেবে বাবলি আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো। পশ্চিমের মাঠ পেরিয়ে শিবুদের পুকুর পার দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হবে চিন্তা করে সেই পথেই এগোয় সে। ঝড়ো হওয়া দিতে শুরু করে দিয়েছে, ছাতাটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে পা চালায় বাবলি। খানিকদূর এগোতেই ওর  চোখে পরে সেই বুড়ো বেলগাছটা। আগের চেয়ে আরো যেন নুইয়ে পড়েছে, পাতাও ঝরে গেছে অনেক। আগামী একটা দুটো কালবৈশাখীর দাপট সামলাতে পারবে বলে আর মনে হয় না। গাছটার গা ঘেঁষেই শিবুদের পুকুর, বাবলি আরেকটু এগোতেই খুব আস্তে কিন্তু কান্নার একটা আওয়াজ পেলো যেন। থমকে দাঁড়ালো, ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো.. হাঁ, খুব নিচুস্বরে কেউ কাঁদছে। একটু এগিয়েই চোখে পড়লো বেলগাছ আর পুকুরপাড়ের মাঝের ঢালে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে। নয় কি দশ হবে বয়েস। হাতে একটা ভাঙা বেতের ঝুড়ি আর তাতে কিসব জংলি ফুল। হঠাৎ যেন একটা জলছবি ফুটে উঠলো ওর  চোখের সামনে। ছোটবেলায় স্কুল ছুটি পড়া, এখানে আসা, দাদু-ঠাকুমার আদর, দুষ্টুমি… সব কেমন পাক খেয়ে উঠলো মাথার মধ্যে। বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে গেলো সে , জিজ্ঞাসা করে জানলো, বাড়ি নদীর ধারে বোষ্টমী পাড়ায়। খেলতে খেলতে এদিকে এসে পড়েছে, এখন আর বাড়ির রাস্তা চিনতে পারছেনা। 

কি মনে করে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে জিনাতকে  একটা ফোন করলো বাবলি । জিনাত এখানে ওর সহকারী হিসাবে কাজ করে।  ফোনে ওকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলো, সাথে জানুকে বলতে বলে দিলো আগামীকাল গিয়ে ওর মেয়েকে   দেখে আসবে।

এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার হাত ধরলো বাবলি। ওকে ওর মায়ের কাছে  পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো সে। কিছুক্ষন বসে থাকলো চুপ করে, তারপর ধীরপায়ে উঠে এলো ঠাকুমার প্রিয় কাঠের দেরাজটার কাছে। কত দিন হয়ে গেছে ঠাকুমার চেনা গন্ধটা পায় নি, কতদিন হয়ে গেছে ঠাকুমার ছুঁয়ে থাকা জিনিগুলোকে স্পর্শ করে নি ও। বাবলির মনে হলো, জীবনটা বড়ো অদ্ভুত, অলীক নিয়মে বাঁধা.. একটা না একটা সময়ে আমাদের ঠিক সেখানেই ফিরে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, যেখান থেকে নিয়ম ভাঙা শুরু হয়। 

সমাপ্ত।।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল