ইন্দিরা যেদিন শেষরাতে মারা গেলেন ঘুমের মধ্যেই, অমলকান্তি নিজেও ঘুমে মগ্ন ছিলেন। চিরসঙ্গীর চিরতরে ছেড়ে যাওয়াটা তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি । সকালে উঠে যখন টের পেলেন, তখন সব শেষ.. । মানুষটা শেষকটা দিন বড্ডো ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছিল.. ছোট্ট মেয়ের মত সারাক্ষন জেদ করতো । কথায় কথায় ঝগড়া শুরু করে দিত.. আবার চোখের আড়াল হলেই কেঁদে ভাসাত। “তুমি কোথায়.. কোথায় তুমি ..” সারাটাদিন মুখে এক কথা লেগে থাকতো । সারাজীবন জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে হেসেখেলে বেঁচে থাকা মানুষটা শেষমুহূর্তে সেভাবে কাউকেই পেলো না.. । তিনি বরাবরের চুপচাপ শান্ত মানুষ, তাই স্ত্রীর সব আবদার হাসিমুখে মেনে নিতেন। ইন্দিরার চিরঘুমে শায়িত দেহটার সামনে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে এরকম কত কথাই মনে আসাযাওয়া করেছিল সেদিন ….
মনে হয়েছিল , এই বুঝি রান্না চাপিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই হেঁকে বলবে.. “ ওমা, তুমি এখনো বসে, বলি বাজারটা কি আমি করে আনবো..?” আটপৌরে শাড়ির আঁচলের গিঁট খুলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে হয়তো বলে উঠবে.. “ শোনো বুড়ো, আসার সময় আমার জন্য একটা জরি পার কিনে এনোতো । সেদিন রুপাকে দেখলাম কি সুন্দর একখানা জরিপারের ফ্রক পরে ঘুরছে.. ভাবছি, আমার মানুকেও ওমন একটা বানিয়ে দেব।” ইন্দিরার বরাবর মানুঅন্ত প্রাণ। একমাত্র নাতনি বলতে জ্ঞান হারান। হবে নাই বা কেন… বাবলি এক্কেবারে ওর ঠাকুমার মতো, কি দেখতে, কি স্বভাবে.. । যেন, ওর নিজের মায়ের না, ইন্দিরারই মেয়ে ও ।
একটু পর বেলা বাড়লেই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়লো বলে, আছড়ে পড়বে ঠাম্মার নিষ্প্রাণ দেহটার ওপর ..। এত শোকেও মনে মনে হেসেছিলেন অমলকান্তি । ধীরে ধীরে উঠে বাইরে এলেন, শীতের সকালের রোদ পরে রকের এককোনে রাখা নতুন স্টিলের বালতিটা চকচক করছে, আগের হপ্তাতেই বাজার করে ফেরার সময় কিনে এনেছিলেন বৌএর আবদার মেটাতে। আজ এসব কিছুই অপ্রাসঙ্গিক, অর্থহীন হয়ে পরে রইলো একপাশে। আবদার, বায়নারা বাড়ির আনাচেকানাচে মুখ লুকালো চিরদিনের জন্য।
অমলকান্তি আস্তে আস্তে সিঁড়ির দুটো ধাপ নেমে হাঁক দিলেন, “ওরে কেউ আছিস?..” রোদ চড়া হতে শুরু করবে এবার ।
ইন্দিরার শ্রাদ্ধশান্তি খুব ঘটা করে সব নিয়ম মেনেই হয়েছিল। কোথাও একচুলও ত্রুটি ছিল না। সারাদিনের স্বজন পরিজনদের আসা যাওয়া , হাঁকডাক ধীরে ধীরে কমে এলে অসীম, অখণ্ড একাকিত্ব নেমে আসে অমলকান্তির ওপর। অসহনীয় ভার তার, যেন মুহূর্তে ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবেন তিনি। বরাবরই মেনে এসেছিলেন, তাঁর আর ইন্দিরার মধ্যে তিনিই আগে যাবেন। কিন্তু ইন্দিরা যে তাকে ফাঁকি দিয়ে গেল। এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এই অখণ্ড অবসরে তিনি কিভাবে বাঁচবেন সেই ভাবনাই তাকে ঘিরে ধরেছিল। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যে অন্য কোথাও গিয়ে থাকবেন, এই চিন্তাও মনে ঠাঁই দিতে পারছেন না। এতদিনের অভ্যাস। অথচ এখানে থাকা মানে, প্রতি মুহূর্তে স্ত্রীর অভাব বোধ করবেন। আজ আর ঘরের আলোটুকুও জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না, অন্যসময় হলে, কখন এবারের প্রতিটা কোন আলো ঝলমলিয়ে উঠতো। ইন্দিরা মতে অন্ধকার সহ্য করতে পারতো না। সারাবাড়ি তার আলো চাই, কত ঝগড়া হয়েছে তাদের মধ্যে এই নিয়ে.. অথচ আজ..
অমলকান্তির মনে হলো, এই বুঝি বড়ো বড়ো পা ফেলে ইন্দিরা এসে আলো জ্বেলে দেবে আর বলবে…
“ দাদু, এভাবে ঘর অন্ধকার করে রেখেছো কেন ? দেখো তো, এক্ষুনি আমি পড়ছিলাম হোঁচট খেয়ে.. এই জন্য ঠাম্মা তোমার ওপর রাগ করতো..”
অমলকান্তির ঘোর ভাঙে। মুখ তুলে তাকান একমাত্র নাতনির দিকে.. ঠিক যেন ইন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে সামনে.. একরকম ছোট কপাল, একরকম ঠোঁট, একরকমের হাসি।
“ হ্যাঁ দিদি, ভুল হয়ে গেছে, বুড়ো হয়ে গেছি যে, খেয়াল থাকে না আজকাল কিছু আর .. দাও, আলোটা জ্বেলে দাও।”
সেদিন অমলকান্তি উপলব্ধি করেছিলেন, এই নাতনিই পারে বাকি দিনগুলো তার নিজেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার রসদ জোগাতে ।
আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চললো, তিনি ছেলের কাছে আছেন। সারাদিন চুপ করে নিজের মতো কাটলেও, বাবলির ফেরা থেকেই পুরো বাড়িটা কথাবার্তা, হাসাহাসিতে গমগম করতো। মেয়েটা পারে কিছু বকবক করতে..।
নিজের মনেই হাসেন অমলকান্তি । হ্যাঁ, নিজেরই মনে, কারণ.. তিনি জানেন, তাঁর এ হাসি দেখার নয়। মাস দুই আগে সেদিন কি যে হলো হঠাৎ, দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ছাদে উঠেছিলেন স্নান করে মেলে দেওয়া ঘরে পড়ার পাঞ্জাবিটা তুলে নিয়ে আসবেন বলে… আচমকা… দুচোখে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এলো যেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মনে হলো, সামনের আকাশটা অনেক নিচে নেমে এসেছে, আর .. আর তারই মধ্যে থেকে যেন ইন্দিরা হেঁটে আসছে তার দিকে.. মুখে হাসি, পরনে তার দেওয়া প্রথম উপহারের সেই শাড়ী। অমলকান্তি চোখ বুজলেন। জ্ঞান ফেরার পর ধীরে ধীরে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি বাহ্যিক ক্ষমতা হারিয়েছেন। কথা বলা বা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়ানো তো দূর, সামান্য হাসিটুকুও প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই তাঁর। বাবলি পাগলের মতো হাতপা ছুঁড়ছিলো, কিছুতেই তাকে সামলানো যাচ্ছিল না। ডাক্তার, নার্স মিলে তিন চারজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। বাঁচার ইচ্ছে যে কোনোকালেই খুব তীব্র ছিল তা না, কিন্তু এইভাবে বেঁচে থাকার কথা তিনি কল্পনাও করেননি কখনো। মনে হয়, বলেন.. “ ওরে, তোরা আমায় যেতে দে.. কোনো চিকিৎসার দরকার নেই আমার ..”
জীবদ্দশায় কারো কোনো ক্ষতি করেননি, তবুও আজ তার এই অবস্থা কেন! অনেক কষ্ট অনেক যন্ত্রনা অব্যক্ত হয়ে রয়ে গেছে সেই থেকে মনের মধ্যে। ছেলে বৌমা যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেনি যদিও, তবু… এভাবে প্রতিদিন বেঁচে থাকার চেয়ে সেদিনই একেবারে সব শেষ হয়ে গেলে ভালো হতো। ইন্দিরার অভাবটা আজকাল বড্ড বেশি মনে হয় তাঁর, আজীবন চুপচাপ নিস্তরঙ্গ জীবনে ইন্দিরা ছিলেন এক দমকা বাতাসের মতো। স্বভাব মিশুকে মানুষটা বিশাল পরিবারের সকলকে আপন করে নিয়েছিল সেই প্রথম দিন থেকেই। জীবনের শেষ দিন অব্দি তা বজায় ছিল। সবার ছোট থেকে ছোট সমস্যা, আবদার, দাবি সবই ছিল একমাত্র ইন্দিরার কাছে। সংসারের যাবতীয় ঝক্কি একাহাতে সামলাতেন মসৃণভাবে। আঁচলের গিঁটে খুচরো পয়সার অভাব হয়নি কোনো দিন.. অমলকান্তি নিজেও অবশ্য এসবের কিছুর মধ্যে ঢুকতেন না। শুধু জানতেন যেখানে যতটুকু দরকার তা পূরণ হয়ে যাবে। জীবনের কোন বাঁকে এসে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে চিন্তামুক্ত, ভারমুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তা আজ মনে করতে পারেন না অমলকান্তি। ইন্দিরার চলে যাওয়াতে সেইসব চিন্তারাই আচমকা দুশ্চিন্তা হয়ে চেপে বসেছিল তার ওপর।
ছবি সৌজন্য: গুগল