ছোটবেলার স্কুলের ছুটি পড়লেই বাবা আমাকে দেশের বাড়িতে ঠাকুমাদাদুর কাছে রেখে আসতো। বেড়ানোর জায়গা বলতে দেশের বাড়িটাই ছিলো আমার একমাত্র প্রিয় জায়গা। বাবা ফিরে যেতেই আমি মেতে উঠতাম নিজেকে নিয়ে। কেউ বাধা দেওয়ার নেই, শাসন করার নেই, খবরদারি করার নেই। অন্তহীন, অখণ্ড সময়। ঠাকুমার আদর মেশানো শাসন যেন মানবোনা জেনেই কর্ণকুহরের বহুযোজন দূরে এসে থেমে যেত। আমার কড়াচোখপাকানো আর একচিলতে হাসির সামনে তারা এগোনোর সাহস পেতনা। এপাড়া ওপাড়া, পুকুরপার আলজমি ধরে শুধু ছুট আর ছুট.. সঙ্গী বলতে একটা দুটো ছাগলছানা কিংবা মুরগির ছানা। কখনো প্রখর রোদ, কখনো একচিলতে মেঘ তো কখনো নদীপাড়ের পলির গন্ধ মাখা বাতাস আমায় ছুঁয়ে থাকতো সর্বক্ষণ।
তবে চিনতো আমায় সবাই .. আশেপাশের সব ঘর, সব গাছগাছালি, পাখপাখালি, ফুলের দল পুকুরের জল … তাতে ফোটা শালুকপদ্মরা আমায় চিনে নিত ঠিক। ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই আমার সব কেমন যেন ম্যাজিকের মতো মনে হতে থাকতো। অন্যরা সবাই যেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ভ্যানরিক্সার অপেক্ষা করতো .. আমাদের সামনে কোথা থেকে যেন একটা বা দুটো ভ্যান এসে দাঁড়াতো.. “এই টেরেন করে এলে নাকিগো ছোদ্দা?” বাবা বলতো “হ্যাঁ রে, এই তো এলাম” .. সে বলতো ..” ন্যান উইঠ্যা পড়েন” .. আমার বেশ নিজেকে কেমন একটা মান্যগণ্য কেউ বলে মনে হতো.. সারা রাস্তা গল্প শুনতে শুনতে আসতাম , খুব মজা পেতাম। রাস্তার মোড়ে ভ্যান বাঁক নিলেই ভেসে আসতো বাবার নাম ধরে পরিচিত-অপরিচিত কন্ঠস্বরের ডাক .. “ ওমা .. এই এইলি নাকি.. তা আজই চলি যাবি নাকি ..’ “ মেইয়ে এইছে যে , ওমা দুগ্গা .. থাইক বে তো তুমি ..?” আমি হেসে ঘাড় কাত করতাম, থাকবো আবার না! পেটের মধ্যে হাজার ঘূর্ণি পাক খেতো, প্রজাপতির মতো যেন ডানা মেলত একরাশ আনন্দ। বিকেলের ট্রেন এ বাবার ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা। আমার রাজত্ব শুরু। গাছপালা, পুকুর , খালবিল থেকে শুরু করে মায় ঠাকুমাদাদু অব্দি সবাই আমার রাজত্বের প্রজা.. সারাদিন টো টো।
ঠাকুমা ভয় পেতো, বলতো.. “ মানু, বেশিদূর যেওনা.. ডাকলে যেন সাড়া পাই..” আমি একহাতে ঠাকুমার দেরাজ থেকে চুরি করা একমুঠো কদমা আরেক হাতে একটা আমের ডাল নিয়ে স্বরাজ্য শাসন করতে বেরিয়ে পড়তাম। আমি জানতাম, ঠাকুমা শুধু শুধুই ভয় পেতো, আমি কাউকে সেভাবে না চিনলেও কয়েকজোড়া চোখ আমার সব গতিবিধির দিকে নজর রাখতো সবসময়। পুকুরের কাছটায় যাওয়ার বারন ছিল, কারণ সাঁতার জানা ছিলোনা আমার। কতবার ওর টলটলে জলের মধ্যে ঘাই মেরে ডুবে যাওয়া মাছেদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে.. ইস আমিও যদি ওদের মতোই একডুবে এপার থেকে ওপারে গিয়ে উঠতে পারতাম.. কিংবা হঠাৎ জল থেকে মাথা তুলে চাওয়া পানকৌড়িটা যখন জলের ওপর পড়া আমার প্রতিবিম্বটাকে ছিঁড়ে দিয়ে আবার ডুব দিত, আমি ব্যস্ত হয়ে উঠতাম শান্ত পুকুর টায় ওঠা মৃদু ঢেউ গুলোকে অনুসরণ করতে.. কি জানি আবার যদি কোথাও গিয়ে সে ব্যাটা মাথা তোলে । প্রতিবার নিজের কাছে কথা দিতাম, এবার বাড়ি ফিরে সাঁতারটা আমায় শিখতেই হবে। কাঠবিড়ালির পিছনে ধাওয়া করে কতবার যে পেয়ারাগাছে উঠতে গিয়ে পা হরকেছি, তার হিসাব নেই আজও.. এসবই ছিল আমার নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা । যেটা পারিনা, সেটা পারবোনা জেনেও বার বার করতে চাওয়ার সাহসটাকে নিজের ভিতর বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ।
নদীর দিকটায় বেশ কিছু মুসলিম পরিবার এর বাস ছিল। ওদের ঘর থেকে মেয়েরা সাধারণ গৃহস্থ বাড়িগুলোতে কাজে আসতো। ওদেরই একটা মেয়ে ছিল জানু । তার সাথে আমার ছিল যেন জন্মজন্মাতরের সখ্য। তার দাদার একটা ভাঙাচোরা সাইকেল নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম এদিক ওদিক। তার কাছেই আমার প্রথম সাইকেল শেখা .. সবার অজান্তে । নদীর চরে শিয়াল এর গর্ত খুঁজে তাতে জল ঢালা থেকে পশ্চিমের দিকে যে শ্মশানটা ছিল, সেখানে গিয়ে চুপি চুপি মৃতদেহ সৎকার দেখা.. এসবই ছিল জানু আর আমার গোপন খুফিয়া কাজগুলোর অন্যতম।
একবার রাজ্যের হালহকিকত তদারকি করতে করতে কখন যেন রাজধানী থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়েছিলাম। রাস্তা ছেড়ে গলি তস্যগলি বেয়ে একটা এদো, বুজে যাওয়া পুকুরপাড়ে একটা ততোধিক বয়েসের ভারে নুয়ে পড়া বুড়ো বেলগাছের তলায় গিয়ে পড়লাম। এদিক ওদিক চাইলাম, কেউ নেই কোথাও … ফিরবো যেন কোন রাস্তাটা ধরে ভাবছি … হঠাৎ কোথা থেকে এক বুড়ি এসে হাজির। কাঁখের বোঁচকা আর হাতের লাঠি সামলে তার জর্দা খাওয়া ফোকলা দাঁতের মুখটা আমার মুখের সামনে এনে একপলক দেখে বললো … “ ও ও ও মা, এই ছুঁড়ি তুই ছোড়দার মাইয়্যা না ? ওমা, দ্যাহদিহি, তা এহ্যানে কি কোচ্চো মা! ঠ্যাগমা যে খুইজ্যআ মরতিচ্যে। চ চ ঘর জ্যবি চ..” সে বুড়ি আমায় ঠিক চিনেছে .. আমার বাবার নামে, আমার বংশপরিচয়ে। আমিও রাজকুমারীর মতো পিতার পরিচয়ের দেমাকে গটগট করে তার হাত ধরে বাড়ি ফিরেছিলাম। ঠাকুমা ততক্ষনে মনেহয় পারলে নদী পেরিয়ে ওপারবাংলায় লোক পাঠিয়ে দেয় আমার খোঁজে। পরের দিন আবার গিয়েছিলাম ওই বুড়োবেলতলায়, নাহ , বুড়ির খোঁজে নয়, গিয়েছিলাম নিজের হিম্মতে রাস্তা চিনে ফিরবো বলে। নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ কাজ করে,যা আমায় আজও বেপরোয়া করে বারবার।
এতটুকু পড়ে বাবলি চুপ করলো। দম নিলো খানিক, তারপর জিজ্ঞাসু চোখে সামনে তাকালো, যেন উল্টোদিক থেকে আসবে কিছু প্রশ্ন, কিছু জানতে চাওয়া, প্রতিক্রিয়া..। শীর্ণ চামড়া কুঁচকে যাওয়া অসাড় হাতের পাতাটা একটু নড়ে উঠলো শুধু, মুখে কি একচিলতে হাসি ফুটেও উঠলো.. বাবলি ঝুঁকে একটু সামনের দিকে ওর মুখটা আরো কাছে এনে অস্ফুটে ডাকলো.. “দাদু..” না, কোনো সাড়া মিললো না। আবার ডাকলো.. এবার একটু জোরে .. “দাদু, ও দাদু.. ভালো লাগলো এতটা শুনে?” আয়াদিদি এতক্ষন শুনছিলো সব,বাবলি আড়চোখে দেখলো যেন মহিলার চোখের কোনটা ভিজে। বললো “ দিদি , উনি শোনেন তো সবই.. দেখুন, ওনার চোখ দেখলে বুঝবেন”। বাবলি দাদুর হাতটা একটু চাপ দিলো , ভিতরে একটা কষ্ট দলাপাকিয়ে উঠলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য জিজ্ঞাসা করলো, “দাদুকে দুপুরের ওষুধটা দিয়েছেন?” তাড়াতাড়ি উত্তর এলো “ হ্যাঁ, দিয়েছি ।”
বাবলি জানে, ওষুধের প্রশ্ন করাটা অহেতুক,দাদু শুনছে হয়তো তো সবই .. শুধু প্রকাশ করার ক্ষমতা হারিয়েছে আজ প্রায় আড়াইমাস হতে চললো। দাদু ঠাকুমা ওর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । মায়ের কড়া শাসনে বছরভরের রোজনামচায় একমুঠো স্বাধীনতা ছিল এরা । সেই স্বাধীনতা অর্ধ্যেক হয়ে যায় যেদিন ঠাকুমা আচমকা কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই সবাইকে ছেড়ে চলে গেল । তারপর বাকিটুকু বাঁচিয়ে রাখার তাগিদটা ছিল বড্ডো। তবু সেদিন বাবলির দুঃশ্চিন্তা কে সত্যি করে দিয়ে মাস আড়াই আগে কলেজে এর offperiod এ বন্ধু দের সাথে আড্ডা মারার সময় মায়ের ফোনটা এলো,, “বাড়ি চলে যায় যত তাড়াতাড়ি পারিস” ।