আকাশদের স্কুল আজ ছুটি, কিন্তু স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের জন্য সবাইকে স্কুলে যেতে হয়েছিল। হেডমাস্টার রতনবাবু জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন, ছাত্রছাত্রীরা সবাই বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়েছে, জয়হিন্দ ধ্বনি দিয়েছে। মাস্টার মহাশয়, দিদিমণি ও অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আকাশ জনগণমন গেয়েছে। গান শেষে মাস্টারমশাইরা এই স্বাধীনতার বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন, চটপট হাততালি পড়েছে, আকাশও হাততালি দিয়েছে। তারপর দিদিমণিরা সব্বাইকে লজেন্স দিয়েছেন। লজেন্স চুষতে চুষতে আকাশ দেখেছে তেরঙ্গা পতাকাটা কেমন পতপত করে উড়ছিলো। স্বাধীনতা উদযাপন শেষে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল ক্লাস থ্রি-র আকাশ। এমন সময় ওর নজর পড়লো রাস্তার ধারে ক্লাব শতদলের মাঠের দিকে। মাঠে ক্লাবের ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছে। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সমীরবাবু পতাকা তুলছেন, বেশ ব্যস্ততা চারপাশ জুড়ে। চটপট হাততালির শব্দ আর ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনির মধ্যে দিয়ে পতাকাটা উঠল, আর খোলা হাওয়ায় পতপত করে উড়তে লাগল পতাকাটা। আকাশ এবার বাড়ির পথ ধরলো। হঠাৎই মনে কি যেন একটা খটকা লাগতে আকাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখল — ঠিক সন্দেহ-ই করেছে আকাশ! পতাকাটা উল্টো ভাবে উড়ছে অর্থাৎ উপরে সবুজ দিকটা এবং নিচে গেরুয়া দিকটা! অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়! গেরুয়া থাকবে সবার উপরে, আর সবুজ থাকবে নিচে! কিন্তু এ কী ভুল!! একছুট্টেই মাঠের ভেতর ঢুকলো আকাশ, তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, — কাকু তোমাদের পতাকাটা উল্টো লাগানো হয়েছে! কিন্তু কে শোনে কার কথা! আর ওই টুকু ছেলের কথা কেউ গুরুত্ব দিতেই চায়না! সব মিলিয়ে চেঁচামেচি, হই-চই! ব্যাপারটা নজরে পড়তেই প্রেসিডেন্ট এগিয়ে এলেন, — কি হয়েছে? ব্যাপার কি? এত হই-চই কিসের? — দ্যাখো না জেঠু, আমি বলছি পতাকাটা উল্টো লাগানো হয়েছে, কিন্তু কেউ শুনছেই না! ওইটুকু ছেলের কথা শোনামাত্র চমকে উঠলেন সমীরবাবু ! তাই তো ! ঠিকই তো বলেছে ছেলেটা ! সর্বনাশ ! ওরে ! শিগগির ব্যবস্থা কর ! নইলে কোনও ফটোগ্রাফার বা সাংবাদিক দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ! ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে মুহূর্তের মধ্যে হুলুস্থুলু কাণ্ড ! পতাকা তো সোজা করে পুনরায় টাঙানো হলো ! এদিকে ক্লাবের কর্মকর্তাদের তো আক্কেল গুড়ুম ! এ ওকে দোষ দেয়, তো ও তাকে দোষ দেয় ! সমীরবাবু সবাইকে শান্ত করে আকাশকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন,— তুমি কি করে বুঝলে যে আমরা পতাকাটা ভুল টাঙিয়েছি ? আকাশ একটুও অপ্রতিভ না হয়ে জবাব দিলো,— আমি তো জানি ! আমার বাবা আমাকে এই জাতীয় পতাকা সম্পর্কে সব বলেছে ! এমনকি এই তিনটি রঙের ব্যাখ্যাও বলে দিয়েছে ! —- তাই বুঝি আকাশ ! তুমি খুব ভালো ছেলে ! একদিন তুমি অনেক বড়ো হবে। আজ তুমি আমাদের খুবই লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছো ! আর সেজন্য আমরা তোমার কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ ! তোমাকে আমরা প্রাইজ তো দেবোই, তা ছাড়াও তোমার সম্মানে আমি একটা দারুণ কিছু করবো ! বন্ধুগণ ! আজ আমাদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছে আমাদের এই ছোট্ট বন্ধু আকাশ ! আমরা ওর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাই আজকের প্রথম সম্মানীয় বক্তা আমাদের এই ছোট্ট বন্ধু আকাশ হালদার। ও আমাদেরকে জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বলবে, আর তিনটি রঙের ব্যাখ্যা শোনাবে। স্টেজে উঠে ভয়-ভয় করলেও মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডটা বেশ শক্ত করে চেপে ধরলো আকাশ। তারপর কচি কচি গলায় বলতে শুরু করলো– “আজ পনেরোই আগস্ট । আমাদের স্বাধীনতা দিবস । আর তাই আমরা আমাদের জাতীয় পতাকা তুলে এই দিনটাকে মনে করি। এই জাতীয় পতাকার তিনটি রং — গেরুয়া, সাদা, সবুজ। সাদা অংশে রয়েছে একটি নীল রঙের চক্র — যার নাম অশোকচক্র। অশোকচক্রে চব্বিশটি দন্ড রয়েছে। পতাকার উপরে যে গেরুয়া রং — তার মানে হল ত্যাগ আর সাহস। সাদা হলো শান্তি এবং সত্যের চিহ্ন। আর সবুজ হলো বিশ্বাস ও মর্যাদার জন্য। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত এই জাতীয় পতাকাকে সম্মান করা। তোমরা সবাই একসঙ্গে বলো – জয়হিন্দ ! ….বলো বন্দেমাতরম্ !” মাঠ জুড়ে যেন গর্জন উঠলো— জয়হিন্দ ! …. বন্দেমাতরম্ ! তারপর তুমুল হাততালি! স্টেজ থেকে নামতেই আদরের বন্যায় ভেসে গেল আকাশ! একগাদা উপহার হাতে দিয়ে আকাশকে বাড়ি পৌছে দিয়ে গেল ক্লাবের সদস্যরা। সেদিন সন্ধ্যাবেলা মায়ের কোলে বসে টিভি দেখছিল আকাশ। হঠাৎ দেখল– টিভির লোকাল চ্যানেলে দেখাচ্ছে বক্তব্যরত আকাশকে! আকাশ এতোটা ভাবেনি ! টিভিতে ও নিজেকে দেখে আর ওর বক্তব্য শুনে লজ্জায় মুখ লুকালো মায়ের কোলে। ওর মা ওকে ভরিয়ে দিল চুমুতে চুমুতে! ঠিক সেই মুহূর্তে টিভিতে বেজে উঠল “জনগণমন” সুর। অমনি মায়ের কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল আকাশ, মাকেও দাঁড়াতে বললো। আকাশ জানে যে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হয়।