” ইয়ে মানে বলছি যে এবার পুজোয় কিন্নর যাবে? “. শুধু কিন্নর কেন? কিন্নর- কিন্নরী- অপ্সরা-অপ্সরী কোন কিছুতেই আমার আপত্তি নেই। আসলে বেড়াতে আমি বড্ড ভালোবাসি কিনা! নিন্দুকেরা বলে আমার পায়ের তলায় সর্ষে। তা সর্ষেই থাক আর হাওয়াই চটিই থাক — নীল আকাশে সাদা মেঘ দেখলেই মন উড়ু উড়ু হয়ে যায়। তাই বোঁচকা কাঁধে ‘হোক কিন্নর’ বলে উৎসবের কলকাতা ফেলে রেখে, ষষ্ঠীর সন্ধের মায়া কাটিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।
চন্ডীগড় স্টেশন থেকে গাড়ি চেপে যখন সিমলা পৌছলাম তখন প্রায় শেষ দুপুর। অক্টোবরের হিমাচল শরত আলোয় মাখামাখি, কাশফুল না থাক দুগ্গাপুজোর মনকাড়া শব্দ ও ঘ্রাণ দিব্যি উপস্থিত । নতুন জামা জুতোয় সেজেগুজে সন্ধে বেলায় ঠাকুর দেখতে বেড়োনো হল । কালীবাড়িতে আরতি দেখে যখন সিমলা ম্যলে পৌঁছলাম তখন ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়ানোই দায়। একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে আকাশ এখন পরিস্কার, দূর পাহাড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে আমরা হোটেল মুখী হলাম।
পরদিন সকাল থেকেই মন চঞ্চল তিতলি, সিমলা পেরিয়ে আজই কিন্নরে প্রবেশের কথা। অক্টোবরে সব পাহাড়ই সুন্দর , আর রূপসী হিমাচল যেন এই সময় অপরূপা হয়ে ওঠে । ক্রমে সিমলার বিখ্যাত জ্যাম পেরিয়ে আমরা চললাম কুফ্রি ও ফাগুর পথে।প্রথমে আমরা সেখানেই যাব, উত্তেজনা চরমে, না জানি কি সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে সেখানে! কিন্তু পৌঁছে কি নিদারুণ স্বপ্মভঙ্গ। ঘোড়ায় চড়ে বীরাঙ্গণার মত পাহাড়ী পাকদন্ডী বেয়ে যেতে হবে স্যুটিং পয়েন্ট দেখতে! একটি ঘোড়ায় একজনই যেতে পারেন।
সব দেখে শুনে ছেলে ও ছেলের বাবা ঘোষণা করলেন তাঁরা মোটেও এমন বোকামিতে রাজি নয়। অন্যদিকে আকাশজুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। অগত্যা আর সাহস না দেখিয়ে আবার গাড়িসই হলাম।প্রিন্সদাদা আমাদের অশ্বারোহী না করতে পেরে কুপিত হলেও, গুরগুর করে চলতেও লাগলেন। ক্রমে রামপুর এল। পথের পাশেই পদম প্রাসাদ। অনবদ্য কাঠের কারুকাজে মনভরানো বুশাহার রাজাদের প্রাসাদ। যদিও ভেতরে প্রবেশনিষেধ, তবু আমার একটু নেমে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গাড়ি থামল না। বুঝলাম ঘোড়ায় না চড়ার ফল। আমি কটমট করে antiঘোড়াদের দিকে তাকাতে লাগলাম, আর তারা পাত্তাও না দিয়ে প্রকৃতি দেখতে লাগলেন।
সারাহান যাবার মূল পথটি বন্ধ, কারণ জানা গেল স্থানীয়দের বয়ানে, “পুল গির গ্যয়া “। জানা গেল গত বর্ষার ভয়াবহ বৃষ্টিতে সেতু ভেঙে যাওয়ায় গ্রাম্য পথ ছাড়া উপায় নেই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় জায়গায় জায়গায় ভয়াবহ। উল্টোদিক থেকে গাড়ি এলে দাঁড়ানো ছাড়া গতি নেই। দেখলাম দুটি গাড়ি খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,অনেক বড় দল। আমরা চারটি প্রাণী মনে মনে –হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল গাইতে গাইতে এগোলাম। প্রায় সাতটা নাগাদ HPTDC র হোটেলে যখন পৌঁছলাম,তখন ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমরা কপালের আতঙ্কঘাম মুছে প্রবেশ করলাম।
সারাহানের সকালটি ভারী মনোরম। চারিদিক গলানো সোনার মত উজ্জ্বল । আকাশজুড়ে হিমালয় স্বমহিমায় দন্ডায়মান। মাঝে ঝকঝক করছে শ্রীখন্ড চূড়া। HPTDCর হোটেলের প্রায় লাগোয়া ভীমাকালী মন্দির । হিমাচলী কাঠের ও রুপোর কারুকাজ নিশ্চিত মন কাড়বে। মাথা ঢেকে লাল মখমল বিছানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দেবীদর্শণ হল। সুন্দর ভোজনালয় ও যাত্রীনিবাস আছে মন্দির চত্বরেই। কোন পূজারির উপদ্রব না থাকাতে আপন মনে পুজো দেওয়া যায়, এ রীতি হিমাচলের সর্বত্র। হোটেলে ফিরে আর দেরী না করে রওয়ানা হলাম সাংলার পথে, চারিদিক তখন শরতের রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে।
সারাহান থেকে সাংলা খুব বেশী দূর নাহলেও রাস্তায় জায়গায় জায়গায় কাজ চলার কারণে আমরা থেমে থেমে এগোতে লাগলাম। শতদ্রুর সঙ্গ ছেড়ে এখন আমরা বসপার হাত ধরেছি। রাস্তা ভয়াবহ সুন্দর। পাহাড় ফুটো করে রকছাম, করছাম পার হয়ে যখন সাংলায় পা রাখলাম তখন শেষ বিকেল। হিমালয়ের শৃঙ্গে শৃঙ্গে সোনা রঙ লেগেছে। রাস্তা জুড়ে সার সার আপেল বোঝাই ট্রাক চলেছে। প্রিন্সদাদা জানালেন প্রতি বছরই নাকি এই অক্টোবরে ট্যুরিস্ট বাহিনীর আহ্লাদে আপেলবাগান তছনছ হয়ে যায়, তারমধ্যে সিংহভাগই যে বাঙালী তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।তাই নাকি এখন হানাদাররা আসার আগেই অধিকাংশ আপেল পেরে ফেলা হয়। বিদেশে স্বজাতের এমন গুণগানে মন খারাপ হয়ে গেল ।
সাংলায় HPTDC র কোন হোটেল না থাকায় আমরা বাঙালী মালিকানাধীন একটি হোটেল ভাড়া করেছিলাম । বাইরে থেকে ভালো লাগলেও ভেতরে গিয়ে বুঝলাম ঐ ভীষণ শীত প্রতিরোধের ব্যবস্থা মোটেও তাতে নেই। আপেল বাগানের মধ্যে সুসজ্জিত হোটেলে কার্পেট ও রুম হিটার তো নেইই, গিজারও খুবই স্বেচ্ছাচারী। মাঝেমধ্যেই সে চলেনা। এদিকে ঐ বিকেলেই তাপমাত্রা 4°C, রাতে নাজানি কি হবে!
সাংলা শহরের পাশ দিয়েই চলেছে বসপা নদী, দোকান বাজারও বেশ ভালোই। সন্ধ্যা বেলা একটু বেড়োনো হল, হঠাৎ শুনি কাড়ানাকাড়া বাজছে। আবার বুঝি বিয়েবাড়ি- ভেবে খুশী মনে এগোতে যেতেই স্থানীয়রা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। নির্দিষ্ট তিথিতে ২০০ সিঁড়ি ভেঙে শোভাযাত্রা সহ কামরু ফোর্ট থেকে দেবতার অবতরণ ঘটে, কোন অহিমাচলীর তা দেখা মানা। চুরি করে দেখতে গেলে নির্বিচারে পিটুনি জোটে। হায় হায় এই ব্যথা পা আর মোটাসোটা শরীর নিয়ে কোথায় লুকোই, অগত্যা হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন সকালে ছিটকুলযাত্রা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে “শেষ গ্রাম” এর আগেও দেখেছি ,এও তেমনই। আমরা যেহেতু ছিটকুলে রাত্রিবাস করব না তাই তাড়াতাড়ি রওয়ানা হতে হবে প্রিন্সদাদা বলে গিয়েছেন।
লাল ও সোনালী আপেলের বাগানের মধ্য দিয়ে পথ গেছে, আকাশ এত নীল যে তাতে তুলি ডুবিয়ে আঁকা যায় স্কুলবেলার সিনারী। ছিটকুল যাবার পথ স্বর্গীয়, এর বেশী বর্ণনার ক্ষমতা আমার নেই। অপূর্ব প্রকৃতি যেন আপনমনে বীণা বাজাচ্ছে। কোথাও ইমনকল্যাণ, কোথাও ভৈরব বা কোথাও হংসধ্বনি—- মোহমুগ্ধ চারটি প্রাণী প্রকৃতির সুর গায়ে মেখে ঝর্ণা পাহাড় ডিঙিয়ে চললাম।
ছিটকুলে বেলা ১১টার ঝলমলে রোদে গ্লাভস, টুপি, জ্যাকেট, মাফলারে সেজে আমরা বসপা ছুঁতে চললাম। সবুজ জল পাথরে পাথরে নেচে নেচে চলেছে, বরফঢাকা পাহাড়চূড়া যেন স্পর্শের অপেক্ষায়। দূরে একদল চমরীগাই নিজের মনে লড়াই করছে। ভারতের গর্বিত পতাকা দামাল হাওয়ায় অহঙ্কারীর মত উড়ছে। অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে আমরা ধীরেসুস্থে এগোতে লাগলাম। গাড়ি করে ITBPর ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়া চলে। ভারতীয় সেনানীরা সেখানে প্রহরায় নিযুক্ত।বসপার তীরে সবুজ চালের একটি girls school দেখে আমরা ফেরার পথ ধরলাম , কারণ বেলা বৃদ্ধি হলেই নাকি আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে যাবে। যখন পথে নামলাম তখন পেঁজাতুলোর মত বরফ নামছে আকাশ থেকে। প্রথমে ভারী আহ্লাদ হল, তারপর তুষারপাত জনিত জ্যামে আটকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যখন হোটেলে ফিরলাম ততক্ষণে “শাম ঢল গয়া”।
পরদিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। আজ আমরা কল্পা যাব। কত কত্ত গল্প শুনেছি কল্পার,আজ চাক্ষুস করব। সাংলা থেকে কল্পা বেশি দূর নয়, তাই ধীরেসুস্থে বেরোনো হল। ঠিক হল কল্পাতে গিয়েই দুপুরের আহার গ্রহণ করা হবে, সেই মত আমরা চলতে লাগলাম। পথ ভয়াবহ সুন্দর, পাশে পাশে বসপাও চলেছে। পথ নদীর সঙ্গী , না নদী পথের – জানিনা! পাহাড় কোথাও কোথাও পথের উপরে হুমরি খেয়ে এগিয়ে এসেছে।আপেল বোঝাই গাড়ি চলার বিরাম নেই!
ক্রমে রেকংপিও এসে গেল, কিন্নর জেলার সদর শহর। ট্রাফিক পুলিশে, সিগন্যালে সাজানো বেশ বড় শহর পিও। প্রশস্ত বাজার, সব শহুরে জিনিস থরে থরে মজুত। ভারতের মস্ত পতাকা আপনমনে উড়ছে। রেকংপিও থেকে গাড়ি আরও উপরে উঠতে লাগল। আপেল বাগান পেরিয়ে আমরা চললাম।কল্পাতে পৌঁছেই শোনা গেল গতরাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যাওয়ায় তুষারপাত হয়েছে ,আজও সম্ভাবনা যথেষ্ট ।
HPTDC র কল্পার হোটেলটি অনবদ্য। সামনেই উত্তুঙ্গ কিন্নর কৈলাশ, জানলা খুললেই হিমালয় ঘরে ঢুকে আসে। ধাপে ধাপে হোটেলটি উঠে গেছে, দু দিকে আপেল ও নাসপাতি গাছ। কিন্তু ভয়ংকর ঠান্ডা । হোটেলের ব্যবস্থা অসম্ভব ভালো, তাই এখানে আর সাংলার মত কষ্ট নেই। সন্ধ্যা হতেই প্রথমে বৃষ্টি, তারপর তুষারপাত শুরু হল। অবশেষে হিমাচলী খাদ্যে উদর পূর্ণ করে doubleলেপের নীচে বাঙালী প্রাণ সঁপে দিলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক অপূর্ব প্রাপ্তি। গত রাতে বৃষ্টি ও তুষারপাতের পর আকাশ আজ নির্মেঘ, কিন্নর কৈলাশের মাথায় হালকা রঙের ছোঁয়া। ক্রমে এক অপরূপ উদ্ভাসে চরাচর ভরে উঠল। কিন্নর কৈলাশের পিছন থেকে আলোরছটায় কল্পা স্নান করতে লাগল। আকাশ জুড়ে বাজতে থাকল ভৈরব। নতুন দিনকে বুঝি এইভাবেই স্বাগত জানাতে হয়!
আজ আমাদের গন্তব্য কল্পার আশপাশ। প্রথমেই চললাম রোঘি গ্রামের দিকে। আকাশ আজ অদ্ভুত নীল। আকাশী নয়, নীল। তার সামনে বরফমোরা কৈলাশ, চারিদিক লাল আপেলে ছেয়ে আছে। রঙিন ঝলমলে চারদিক।কলকাতার ধূসর আকাশদেখা চোখে এ এক অনবদ্য অনুভব। প্রিন্সদাদা জানালেন কিন্নরীরা কোন এক বিশেষ তিথিতে কৈলাশ পর্বতে পুজো দিতে যায়, আমারও মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি।
রোঘি গ্রামে সবাই আপেল বাগান আর হিমাচলী জীবনযাত্রা দেখতে যায়। যাওয়ার পথে এক জায়গায় নামা হল, এ নাকি suicide point । খাড়া পাহাড় নেমে গেছে কোন অতলে। রীতিমত মাথাঘোরানো অনুভূতি। তার ধারে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা চলছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। আমার মধ্যবিত্ত মাথা ততক্ষণে বনবন ঘুরছে, প্রাণও মৃত্যুভয়ে ধরফর। আমরা আত্মহনন এর ইচ্ছা ত্যাগ করে এগোলাম।
রোঘি গ্রাম হিমাচলী বাড়িতে, মন্দিরে, মনাস্ট্রিতে সাজানো, হ্যাঁ সাজানো আমাদের মত পর্যটকদের জন্য। আপেলবাগান লাগোয়া এক ছোট্ট দোকান থেকে ২০টাকা কেজি দামে আপেল কেনা হল। অপূর্ব তার স্বাদ, আপেল যে অমন রসালো হয় তা জানা ছিল না। কেনা হল golden apple ও। তার দাম অবশ্য বেশী। একটু পরেই অবশ্য বিপত্তি দেখা দিল। হিমাচল যে plastic free প্লাস্টিকময় বঙ্গহৃদয়ের তা স্মরণে ছিলনা। আপেলের মালকিন তার সুন্দর আপেলগুলিকে কাপড়ের ব্যাগবন্দি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদূর যেতেই তারা ব্যাগ ছিঁড়ে ধরাশায়ী হতে লাগল। কর্তামশাই ও ভাই রাগী রাগী চোখে আমাকে দেখতে লাগল আর আপেল কুড়োতে লাগল। আসলে তারা বাক্সবন্দী সাজানো গোছানো আপেলপন্থী, আমিই আহ্লাদে আটখানা হয়ে এমনধারা কান্ড করেছি। তাই অবিরাম দৃষ্টিবান চলতে লাগল। সত্যযুগ হলে বোধহয় ভস্ম হয়ে যেতাম, কিন্তু এখন দিব্যি কোলেকাঁখে আপেল নিয়ে গাড়িমুখো হলাম।
পরের গন্তব্য চিনি গ্রাম। আসলে কল্পারই ১৯৬২ পর্যন্ত নাম ছিল চিনি। মধুর বলেই কিনা জানিনা! সেখানে আছে একটি বাংলো, এখন হোটেল,একটি মনাস্ট্রি আর সাধারণ মানুষের রোজের ঘরগেরস্থালী। আমার ভারী ভালো লাগল, বিয়েবাড়ির সাজ ছেড়ে ঘরের পোষাকে মানুষকে যেমন কাছের মনে হয়—- সাজানো কল্পার মাঝে এও তেমন একটুকরো আপনার জায়গা। দেখলাম লোকে বেলচা করে আপেল তুলে বাক্সে ভরছে, আপেলসমান শিশুরা খেলে বেড়াচ্ছে। মায়েরা গৃহকর্মে ব্যস্ত।দোকানগুলিও স্যুভেনির নয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীতে ঠাসা।
কল্পার মনাস্ট্রিটি ছোট্ট কিন্তু সুন্দর। হিমালয় চারিদিকে ঘিরে পাহারারত। কনকনে হাওয়া মেদমজ্জা ভেদ করে অস্থিতে বিঁধছে। লাগোয়া একটি স্কুল। জানাগেল নভেম্বর থেকেই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, খুলবে সেই মার্চে। কল্পার দখল নেবে তখন হু হু বাতাস আর তুষারবাহিনী।আপেল গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত জলসিঞ্চন করে শিশু কোলে মা, ব্যস্ত বাবা, লাঠি ঠুক ঠুক ঠাকুমা দাদু—- সবাই নেমে যাবে উষ্ণতার খোঁজে। হিমনগরীতে প্রাণ ফিরবে আবার বসন্তে।
রোদ পরে এলেই ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর অবশ হয়ে যায়। আকাশের ভাবগতিকও সুবিধার নয়। তুষারপাতের প্রবল সম্ভাবনা। অতয়েব আমরা আবার HPTDC র নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে চললাম।
যেহেতু অক্টোবরের মাঝামাঝি হয়ে গেছে, তাই কল্পার পর আমরা আর এগোতে পারিনি। সেনাবাহিনী স্পিতির পথ বন্ধ করে দিয়েছে । তাছাড়া কল্পাতেই যা অসহ্য ঠান্ডা এরপর আরও বেশি হলে তা সহনক্ষম থাকবেনা বলেই আমাদের HPTDC র কলকাতার অফিস থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল । তাই আমাদের পরবর্তী বুকিং ছিল নারকান্দায়।
কল্পা থেকে আমরা সোনারোদ মাখা কিন্নর কৈলাশের ছবি প্রাণে ভরে নিয়ে বেরোলাম। বিচিত্র শহর গ্রাম, নদী পর্বত, টায়ার পাংচার সব পেরিয়ে যখন নারকান্দায় পা রাখলাম তখন এক অপূর্ব বিকেল। হোটেলের লনে রোদ খেলা করছে। নারকান্দা ছোট্ট কিন্তু ভারী সুন্দর স্থান । আপেল বাগিচায় পথ ছেয়ে আছে, লোকজন বিশেষ নেই– বেশ ফাঁকা ফাঁকা । হোটেলটিও ভারী ঝকঝকে । নারকান্দায় মূলত আমাদের রাত্রিবাসের উদ্দেশ্য ছিল। প্রচলিত রামপুরের বাইরে নারকান্দা আমাদের পছন্দ ছিল, সে পছন্দ সার্থক।
পরদিন সকাল ৮য় না রওয়ানা হলে কিছুতেই সময় মত কালকা পৌঁছনো যাবেনা প্রিন্সদাদা জানালেন । কিন্তু নারকান্দার মায়াবী ভোর বড্ড মনকাড়া ।হোটেলের চমৎকার লনটি কাকলিতে পরিপূর্ন। কিন্তু সুতো ছিঁড়ে উড়ে না গেলে সব ঘুড়িকেই একদিন আকাশ ছেড়ে ফিরতে হয়। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। শতদ্রুর সঙ্গ ছেড়ে , সিমলার প্রথম দিনের চেনা মুগ্ধতা পেরিয়ে এগোতে লাগলাম। পুত্রের রোজের চেনা দুষ্টুমি আজ কিছুটা কম, পুজোর ছুটি শেষে স্কুল খোলার সময় হয়ে এল যে! আমাদেরও রোজের ব্যস্ত চেনা ছন্দে পা মেলাতেব হবে বৈকি। এখনও যে বানজারা হওয়া হলনা, তাই কালকা স্টেশনের শতাব্দী এক্সপ্রেসই গন্তব্য। প্রিন্সদাদার সঙ্গে কথা হয়ে গেল সামনের গ্রীষ্মেই আবার আসছি । কে জানে কথা রাখা হবে কিনা ,নাকি শহুরে আকাশ আবার বিস্মৃতিকে সঙ্গী করে দেবে!
মনে রাখার তথ্য: কলকাতা থেকে উত্তর ভারত যেতে গেলে দিল্লি হয়ে যাওয়াই ভালো । দিল্লি থেকে সকাল বিকেল দুবেলাই দুটি শতাব্দী এক্সপ্রেস কালকা যায়। আমরা এপথেই গিয়েছি ও এসেছি। বিমানে চন্ডীগড় হয়ে যাওয়াও সুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে সময় বাঁচবে দুদিন।
হোটেল: সিমলাতে Hotel Gulmarg আমাদের পছন্দ ছিল, যেহেতু হোটেল পর্যন্ত গাড়ি যায় এবং হোটেল থেকে কালীবাড়ি হাঁটাপথ। এছাড়া সিমলা শহর জুড়ে হোটেলের অভাব নেই। কমদামি, বেশিদামি, সরকারী, বেসরকারী সবই মজুত। নেটে সবার নামধাম ফোন নম্বর পাওয়া যাবে।
অন্যত্র HPTDC ই অবস্থান ও সুযোগ সুবিধার নিরিখে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিৎ । HPTDC সব জায়গাতেই online সংরক্ষণ হয়। কলকাতার HPTDCর অফিসে যেকোন প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছিলাম।
সাংলা বা ছিটকুলের মত যেসব জায়গাতে
সরকারী ব্যবস্হা নেই, সেখানে হোটেল ঠিক করার আগে সব সুযোগ সুবিধা বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেবেন।
দূরত্ব: চন্ডীগড় থেকে সিমলা – ১১২ কিমি
সিমলা থেকে সারাহান – ১৬২ কিমি
সারাহান থেকে সাংলা- ৮৪ কিমি
সাংলা থেকে কল্পা- ৪০ কিমি