দ্বিতীয় সত্তা

হৃষিকেশ বাগচী
4.5 রেটিং
3306 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 17 , গড়ে : 4.5]

পাঠকদের পছন্দ

দেবদত্তকে প্রথম দেখি কলেজে ভর্তি হবার দিন। একটা ফাঁকা বেঞ্চে একলা বসেছিল। গালে হাত। না কাটা দাড়ি। এলোমেলো চুল। রোগা, লম্বা। সারা শরীরে একটা অযত্ন ছড়ানো।

 আমরা সবাই ডাক্তারি পড়ব বলে প্রথম বছরে ভর্তি হতে গেছি। পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী। প্রায় সবাই কলকাতা বা তার আশেপাশের। উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্র খুব কম। দুই-একজন কোচবিহার আর জলপাইগুড়ি আছে। আর আছে নর্থ ইস্টের কিছু ছেলেমেয়ে।

 সবার মধ্যেই উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে সবার মুখেচোখে একটা অসম্ভব স্বপ্নিল ঝকঝকে ভাব। তার অনেকটাই যদিও অজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার অভাব থেকে কিন্তু সারা করিডোর জুড়ে যে সম্ভাবনার অস্থিরতা ব্রাউনিয়ান চলনে ঘোরাফেরা করছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।

 একমাত্র ব্যতিক্রম ওই দেবদত্ত। পৃথিবীর সাথে ওর কোন যোগাযোগ ছিল না। কথা বলতে গেলাম। হেসে নাম বলল। নাম জিজ্ঞাসা করল। জানলাম ও আমাদের ব্যারাকপুরের পাশেই নৈহাটিতে থাকে। ওইটুকুই। কেমন যেন কেঁচোর মত সংকোচে গুটিয়ে গেল। আমি অপ্রস্তূত হয়ে সরে এলাম।

 কলেজে ভর্তি হবার পর হোস্টেলে পরিচয়পর্ব শুরু হল। আইনের ভাষায় সেটা র‍্যাগিং হতে পারে। তবে আমাদের সময় সেটা অন্তত কিছুতেই ভয়াবহ স্তরে পৌঁছয় নি। দিনে যে কতবার ‘ইন্ট্রো’ দিতে হত তার ঠিক নেই। সব দাদাদের নাম মনে রাখতে হত। অনেকে আবার নোটবুকে সবার নাম লিখে রাখত। সকাল-বিকেল পাখিপড়া পড়ত। অ্যানাটমির অস্থিবিদ্যার নীরস চ্যাপ্টার মুখস্ত করাও এর থেকে অনেক সহজ কাজ ছিল।

 খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সব রাস্তাই যেমন রোমে যেত, সব আলাপ পরিচয়ই শেষ পর্যন্ত নাভির নীচের আলোচনায় শেষ হত। সিনিয়ররা অনেকেই এই ধারণা পোষণ করতেন যে জীবনের আদিম ও মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ওরা একটা মহৎ কার্য করছেন। সবার মধ্যে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। একটিও না জ্বলা দীপ আর রইবেনা ঘরে। অনেকে গম্ভীর হয়ে বলত, ‘বুঝলি, সেক্স ব্যাপারটায় আমাদের ভারতীয়দের মধ্যে অনেক ট্যাবু আছে। মিসকনসেপশন আছে।’ হাতে সিগারেট। শূন্য দৃষ্টি আকাশে।

 কিন্তু একটি দীপ জ্বলল না। দেবুকে যা প্রশ্ন করত তার উত্তরে ও ‘মা, মা’ বলে চেঁচিয়ে উঠত। বহু বাঙালী হিন্দুস্তানী গালাগাল ওর উপর আছড়ে পরত। কোনোকিছুই ওর মাতৃনাম জপ করা থেকে ওকে আটকাতে পারত না। সিনিয়র দাদারা হতাশ হয়ে ছেড়ে দিল। ঘন্টার পর ঘন্টা যখন আর সবার পরিচয়পর্ব চলত দেবু গালে হাত দিয়ে এককোণায় চুপ করে বসে থাকত। কখনও কখনও ওর ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি দেখা দিত। ওর দিকে লক্ষ্য করলেই আবার গম্ভীর হয়ে যেত।

 এভাবেই কতদিন কেটে গেল। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়ে গেল। দাদাদের ওপর ভয়ভাব কেটে গেল। পড়াশোনার নামে স্টিম রোলার চলতে লাগল। প্রতিটা পরীক্ষার পর ওজন দু-কেজি কমত বা বাড়ত। মধ্যপ্রদেশ ভারী হত। আর প্রতিটা সেমেস্টার পরীক্ষা কিছু নতুন করে নেশাখোর বা প্রেমিকের জন্ম দিত। বিছানার নিচে হলুদ মলাটের বই জমে উঠত। তাদের বিনিময় হত ঘরে ঘরে।

 কিন্তু এতসবের মধ্যেও দেবুর কোন পরিবর্তন হয় না। ওর ‘মাতৃনাম’ চালু রইল। ওর মুখ দিয়ে একটা গালাগালিও বের করা গেল না। আমরা বুঝতাম ও অসুস্থ। কিন্তু ওর কি মানসিক অসুখ তা বোঝার মত জ্ঞান আমাদের তখনও হয় নি।

 ওর ঘরে আমরা কেউ ঢুকতে পারতাম না। অসম্ভব অপরিচ্ছন্নই শুধু নয়, আমাদের মধ্যে এর থেকেও অপরিচ্ছন্ন ছেলেও ছিল, ওর ঘর থেকে কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ বেরোত যে গা বমি-বমি করত। পরে জানা গেল ও দীর্ঘদিন স্নান করত না। বাথরুমে গিয়ে স্নান না করে হাত ধুয়ে চলে আসত।

 ওর আচরণে অসঙ্গতি দেখলেও কখনো হিংস্রতা, ভয়ংকরতা তখনো পর্যন্ত দেখি নি। আমাদের পরীক্ষা সামনে। ক্লাস বন্ধ। সবাই হোস্টেলের ঘরে বসে পড়ছি। দেবুর বাবা পরীক্ষার সময় ওর কাছে এসে মাসখানেক থাকতেন। মুখে অপ্রস্তূত হাসি। অসম্ভব বিষন্নতা। কিন্তু সেই বিষণ্ণতা যেন থিতু হয়ে গেছে। মনে হত সেই বিষণ্ণতা কোন অন্তর্লীন বেদনা থেকে এসেছে। তার থেকে বিপদের যেমন কিছু নেই, তাকে সংশোধন করাও অসম্ভব। কাকু এলে দেবুর ঘর পরিস্কার করতেন। বিছানার চাদর পালটাতেন। জানালা খুলে দিতেন। মুখে কোন কথা ছিল না। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে একটু হাসতেন।

 সেদিন হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি দেবুর ঘরের দরজা খোলা। দেবু বাবার বুকের ওপর উঠে ওনার গলা চেপে ধরে বসে আছে। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলছে, ‘মেরেই ফেলব তোকে। আমি জানি তুই আমেরিকার গুপ্তচর।’ তার সঙ্গে অবিরত গালাগালি। পরিচয়পর্বে শেখা দেশি বিদেশি কোন গালাগালিই বাদ গেল না।

 ওই প্রথম ওকে আমরা গালাগালি দিতে শুনলাম। সবাই এসে দেবুকে টেনে সরালাম। ওর গায়ে এত জোর কোথা থেকে এল কে জানে! আমরা তিনজন ধরে ওকে সরাতে পারছিলাম না। ওর চোখেমুখে সেদিন যে ঘৃণা আর হিংস্রতা দেখেছিলাম তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।

 কাকু তবু নীরব। সাময়িক ভীতিভাব আর অপ্রস্তূত অবস্থা কাটিয়ে উঠে উনি বাইরে গেলেন। দেবু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমিয়ে গেল। আমরা ওকে শুইয়ে দিলাম। আমাদের অনেকের মনে অনেক রকম প্রশ্ন। কিন্তু কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দেবার ইচ্ছেই ওনার নেই।

 এত বড় একটা ঘটনা অথচ উনি মিনিট তিনেকের মধ্যেই কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে গেলেন। বুঝলাম এরকম ঘটনা ওনার জীবনে নতুন তো নয়ই বরং নৈমিত্তিক।

 পরীক্ষা শেষ হল। যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। দেবুও বাড়ি ফিরে গেল। শুনলাম দেবু নাকি অসম্ভব ভাল পরীক্ষা দিয়েছে। ভাইভা টেবিলে বিহার থেকে আসা এক্সটারনাল আমাদের কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছেন। দেবুর পরীক্ষার দিন উনি দেখি মুগ্ধবৎ চেয়ারে বসে আছেন আর দেবু একের পর এক সারা শরীরের লসিকা সংবহনতন্ত্র বলে চলেছে। অথচ পরীক্ষার আগের দিন রাতে আমরা যখন হালে পানি পাচ্ছি না, সেদিনও আমি ওকে ইন্টিগ্রাল ক্যাল্কুলাসের বই খুলে ঘন্টার পর ঘন্টা একটাই পাতা পড়ে যেতে দেখেছি। ওর হাতে অ্যানাটমি বই কেউ আগের দিন দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।

 রেজাল্ট বের হলদেবু পাশ করল। ভাইভা প্র্যাক্টিক্যালে প্রচন্ড ভাল করলেও থিওরিতে ও খুব কম পেল। পরীক্ষায় ঘন্টাখানেক লিখেই ও নাকি ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। খাতায় তেমন কিছুই লেখে নি।

 আবার নতুন বছর। নতুন জোশ। কিন্তু তিপ্পান্ন নম্বর ঘরে সময় থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই গালে হাত, না কাটা দাড়ি, খুস্কিতে ভরা চুল, মুখে হাসি আর ‘মা-মা’ বিলাপ।

 আমাদের কিছু ছেলে প্রতিদিন দেবুকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে যৌনতা সংক্রান্ত প্রশ্ন করত। একই প্রশ্ন রোজ করত। ওদের কাছে এটাই একটা নৈমিত্তিক বিনোদন ছিল। প্রতিদিনই দেবুর কাছ থেকে উচ্চাঙ্গের ‘মা-মা’ ছাড়া আর কিছুই ওরা শুনতে পেত না। আমরা পরীক্ষার আগে দেবুর মুখের গালাগালি শুনে ভেবেছিলাম ওর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়েছে। কিন্তু আমরা না বুঝলেও দেবু বুঝত যে ব্রহ্মজ্ঞান যেখানে সেখানে বিলোবার জিনিস নয়।

 নর্থ বেঙ্গলের আবহাওয়া খুব মনোরম। কিন্তু বর্ষাকালে বৃষ্টি শুরু হলে আর বন্ধ হতে চায় না। টানা দু-দিন, তিনদিন বৃষ্টি হয়। একটানা বৃষ্টিতে একটা ঝাপসা বিষণ্ণতা ক্যাম্পাসটাকে ঘিরে রাখে। অদ্ভূত এক নির্জনবাস। যাকে বলে বোঝানো যাবে না। দেবুর ঘর, ঘরের চারপাশ সর্বত্র এই বিষণ্ণতা আরও জোরদার হয়ে আমাদের দোতলার উইং-এর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

 আমাদের বন্ধুদের মধ্যে রাজদীপের সাথে দেবুর বাবা খুব যোগাযোগ রাখতেন। কিছুটা আমার সঙ্গেও। রাজদীপ পড়াশোনা বা সেমেস্টার সম্পর্কিত খবরাখবর ওনাকে ফোন করে জানাত। সন্ধ্যেবেলায় রাজদীপের ঘরে গেলেই দেখতাম ও বিছানায় কানে হেডফোন গুঁজে জগজিৎ সিং এর গজল শুনছে আর দেবু মেঝেতে মাদুর পেতে বই পড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত বইটা উলটো করে রাখা। দেবু পাতা উলটে পড়ছে। শুধু বই উল্টো করে পড়াই না, দেবু অনেক সময় খাতায় বাঁদিক থেকে না লিখে ডানদিক থেকে লিখত। যদিও ও ডানহাতি ছিল, তবু অনেক সময় দেখতাম বাম হাত দিয়ে লিখছে।  

 আমরা সবাই ওর পেছনে লাগতাম। ওকে নিয়ে নানারকম মজা করতাম। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করতাম ও জিনিয়াস। জিনিয়াস ব্যাপারটা অনেকটা মিথের মত। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ও হঠাৎ এমন একটা কথা বলত, ক্লাসে এমন এমন প্রশ্নের উত্তর দিত যে আমাদের অধ্যাপকেরাও মাঝে মাঝে স্তম্ভিত হয়ে যেত।

 তবু ও যতটা মেধাবী ওর অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে তার প্রকাশ ঘটত না। খুব সাধারণভাবে পাশ করত। অনেক সময় ওকে হয়ত পাশ করিয়েও দিতে হত। পরীক্ষায় আট কি দশ লাইন উত্তর লিখে চলে এসেছে। পরীক্ষক আর কি নম্বর দেবেন? ওর যে প্রতিভাকে মেলে ধরতে না পারা তার মূলে ছিল ওর মানসিক অসুখ।

 ততদিনে আমরা জেনেছি দেবু সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। অনেকটা প্যারানয়েড। ওর মাঝে মাঝেই হ্যালুসিনেশন হত। উল্টোপাল্টা কথা বলত। ওর প্যারানয়েড আঁধারি জগতের প্রধান ভিলেন ছিলেন ওর বাবা। বাবাকে ও আমেরিকার গুপ্তচর বলে ভাবত। ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠত যখন বুঝতে পারত বাবা ওকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। কাকু যতদিন থাকতেন খাবারের সাথে মিশিয়ে ওকে ওষুধ খাওয়াতেন। ও সারাদিন ঘুমোত তবু ভাল থাকত। আমাদের সাথে ওর মেলামেশাটা বাড়ত। কিন্তু যেই বুঝতে পারত ওকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে আমেরিকার গুপ্তচরের উপর ভয়ঙ্কর নিপীড়ন শুরু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ও খুব বেপরোয়া হয়ে যেত। কলেজের করিডোরে ছুটে বেড়াত। রাত্রিবেলায় আমরা খবর পেলে ধরে নিয়ে আসতাম। রাজদীপ ওর বাবাকে টেলিফোন করলে উনি আসতেন।

 আমরা ওনাকে খুব বকাবকি করতাম। কেন উনি দেবুকে একা রেখে এভাবে চলে যান? দেবুর তো যখন-তখন কিছু হয়ে যেতে পারে। ওর মধ্যে তখন আত্মহত্যার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছিল। হাতের সামনে ব্লেড দিয়ে অনেকগুলো কাটা দাগ নতুনভাবে দেখা গেল। মাঝেমাঝেই ছাদের কার্নিসের ধারে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে আমরা নিয়ে আসতাম।

 দেবুর বাবাকে এত কথা আমরা বললাম, আমাদের বলার ধরণ অনেক সময়ই গুরুজন হিসেবে ওনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধের সীমা লঙ্ঘন করে গেল, তবু কিছুতেই ওনার ভাবলেশহীনতার কোন পরিবর্তন হল না। আমাদেরকে উনি কোন অজুহাত দিলেন না। শুধু একটু কৃতজ্ঞতা জানালেন।

 কয়েক বছর পরে আমরা কোনভাবে জেনেছিলাম দেবুর বাবা ও মা দুজনেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। ওর মা অন্য শারীরিক অসুখে মারা যান। দাদা সুইসাইড করে। অর্থাৎ একদিকে যখন আমরা দেবুর সাথে ওনাকে দেখছি, ভর্ৎসনা করছি ছেলেকে অবহেলা করছেন বলে – তখন বাড়িতে অন্য দুই ভারসাম্যহীন ও অফিস-কাছারি নিয়ে উনি অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন।

 আজও আমি যখন কোন প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ, স্প্যাস্টিক বা অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বাবা-মা কে দেখি, তাদের সাথে কথা বলি, তাদের জীবনযুদ্ধকে অতি সামান্য অনুভব করার চেষ্টা করি আমার দেবুর বাবার মুখটা মনে পড়ে। কি বিপন্ন, অসহায়, বিষণ্ণ, করুণ একটা মুখ। আমাদের সুখি মানুষদের জগৎ থেকে ওনারা যেন কত বাইরের জগতের মানুষ। একটা চোরা শিরশিরে ভয় আমার মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যায়। তীব্র বিপন্নতাবোধ আমাকে ঘিরে ধরে।

 আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। পড়ার চাপ প্রচন্ড। তার মাঝে মাঝেই আমরা ভাবতাম পরবর্তীকালে কে কী করব। দেবুর কথা উঠলে আমরা আলোচনা করতাম ও কেমন ডাক্তার হবে, কিসের ডাক্তারি করবে? রুগিরাই বা ওকে কেমনভাবে নেবে? ওই বা তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে? আমরা হাসাহাসি করতামকোন সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম না।  

 যে সময়ের কথা বলছি ওটা ২০০১ সাল। আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। হলিউডে সেবছর একটা দারুন ছবি বেরিয়েছিল। আ বিউটিফুল মাইন্ড। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন ন্যাশকে নিয়ে ছবি। বিখ্যাত গেম থিওরির আবিষ্কর্তা জন ন্যাশ। ন্যাশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাসেল ক্রো। এই ছবির খবর তখন আমি রাখি নি। আমাদের সময় তো এত ইন্টারনেট, টরেন্ট ছিল না। তবে সিনেমাটা আমি পরে দেখেছি। সেই সিনেমায় ন্যাশেরও মনে হত রাশিয়ার কেজিবি এজেন্টরা সবসময় তাকে অনুসরণ করছে। পরে তার সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে ও চিকিৎসা হয়।

 ততদিনে বহু বছর পার হয়ে গেছে। আমাদের ব্যাচের সবাই কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ বন্ধুদেরই খবর পাই। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ থেকে। কিন্তু কয়েকজনের কোন খবর পাই না। তারা যেন নিখোঁজ হয়ে গেছে। কোন দিক থেকেই তাদের সাথে কোনরকম সংযোগযোগসূত্র বের করে উঠতে পারি না।

 দেবদত্ত ছিল তেমনই একজন। আমাদের স্মৃতি থেকেও ও যেন বেমালুম উবে গেছিল।

 গত একবছর ধরে আমার পাখির ছবি তোলার নেশা হয়েছে। বেশ দামি একটা ক্যামেরা আর লেন্স কিনেছি। ডিসেম্বর মাস। জাগুলিতে বেশ কয়েকটা কমন রোজফিঞ্চ আর সাইবেরিয়ান রুবিথ্রোট এসেছে। তারই ছবি তুলতে গেছিলাম। সকাল থেকে ক্যামেরা নিয়ে বসে থাকলেও একটাও ভাল ছবি পাই নি। খানিকটা হতাশ হয়েই ফিরছিলাম।

 অটোতে উঠে বসেছি। কাঁচড়াপাড়া স্টেশনে যাব। হঠাৎ আমার পাশে দেখি দেবদত্ত বসে আছে। আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

  • আরে দেবদত্ত তুমি? কেমন আছ?

ওর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে চিনতে পারে নি। না চেনাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে আমার চেহারায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে আমার পরিচিত লোকেরাই আমাকে চিনতে পারে না। তবে দেবু কিন্তু একইরকম আছে ওর চেহারায় বিশেষ কিছুই পরিবর্তন হয় নি।

  • আমি মলয়। মলয় চক্রবর্তী। তোমার সাথে পড়তাম।
  • ও হ্যাঁ মলয়। কেমন আছ?
  • ভাল আছি। তুমি কোথা থেকে আসছ?
  • আমি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিংয়ে গেছিলাম। বাড়ি ফিরছি।
  • তুমি কী করছ? আমার ওর কথাটা যেন বিশ্বাস হল না।
  • আমি প্রাইমারি স্কুল টিচার। আমার স্কুল ব্যান্ডেলে। নৈহাটির বাড়ি বিক্রি করে আমরা ব্যান্ডেলে চলে এসেছি। আমি আর বাবা থাকি।
  • প্র্যাক্টিস করছ না?
  • শুরু করতে হবে। ভাবছি করব… কোথায় করব…

 ওর কথা হারিয়ে যায়।

 কাঁচরাপাড়ায় ও নেমে গেল ট্রেন ধরতে। আমি ওর অটো ভাড়া দিয়ে দিলাম। না করল না। যাবার আগে হাত নাড়াল।

 জন ন্যাশ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েও নোবেল পেয়েছিলেন। দেবদত্ত ঘোষ। আমদের ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ডাক্তারি পাশ করেও প্রাইমারি স্কুলের টিচার। এই দেশে জন্মে আমার আর কার কী হবে?

 তবে কোথায় যেন আমার মনে হল ও ভালো আছে। ওর দাড়ি কামানো গাল, পরিষ্কার ইন করে পরা জামা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। ও হয়ত এখন নিয়ম করে ওষুধপত্র খাচ্ছে।

 আমার কেন জানি মনে হল কাকুও ভাল আছেন। পুরনো স্মৃতিকে ফেলে নতুন জায়গায় গেছেন। উনি হয়ত স্বস্তি পেয়েছেন।

 এর থেকে বেশি স্বস্তি উনি হয়ত কোনোদিন আশাই করেন নি।

 

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Niloy April 5, 2019 at 6:46 pm

    osadharon…

  • শান্তা বসু April 6, 2019 at 10:23 am

    ভালো লাগল। তবে ডাক্তারের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষকের অবমূল্যায়ন মানতে পারলাম না। দুটোই noble profession। ডাক্তার এর ভিত কিন্তু তৈরি হয় ওই প্রাথমিক শিক্ষকের হাতেই।

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল