ধর্ম যাঁর যাঁর;উৎসব সব্বার

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
1010 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

রামু, নুরুল, সুচিত্রা, টুপু সবাই জংলা দীঘির পাড়ে খেলে, চুরি করা কি কুড়িয়ে জোগাড় করা আম লিচু কি সাকুরকন্দ আলু পোড়া ভাগ করে খায়। পেট তো ভরেই, আনন্দও হয়। খেলাও কতো রকম। দারিয়া বান্দা, গোল্লাছুট, পূজা পূজা খেলা, বিয়া বিয়া খেলা। সুপুরি খোলের নৌকা চড়ে বর বৌ যায়, বরযাত্রীরা পাতার দিকটা টেনে নিয়ে চলে। আরো আছে স্বাধীনতা দিবস খেলা। মাথায় বোঁচকা বান্ডিল আর কোলে একটা পুঁচকে ভাই বা বোন নিয়ে মিছামিছি রিফিউজী রিফুউজী খেলা। বুধুর ঠাম্মা যদিও না করে থাকেন রিফিউজী খেলাটা খেলতে। আরো বারন করেন ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা, কাছাগলায় কীরাধারী সেজে খেলতে। বলেন, ইতা খেলা ভালা না। না হোক, বাচ্চারা যা দেখে তার অনুকরণে খেলে। সব কথা কি আর শোনে। বাচ্চাগুলো মহরম খেলে, কের পুজো খেলে, সরস্বতী পুজো খেলে। রাজেশ কুমার রিয়াংএর ফুটফুটে মেয়েটার সঙ্গে নাদুসনুদুস হারুন মোল্লার ছেলে আবুর বিয়ে বিয়ে খেলা হয় দেববর্মা বিয়ের নিয়মে। পৌষ সংক্রান্তির সকালে কুন্ডুকর্তার মা সবজাতের নাতি নাতনীদের জন্যে একধামা নাড়ুমোয়া পাঠান। পৌষ পার্বন জমে যায়। ঈদের দুপুরে রশিদ চাচার মা একগাদা লাড্ডু হালুয়া জোগাড় রাখেন। গোবিন্দ পণ্ডিতের নাতনী আর মসজিদের ইমাম সাহেবের চারবছুরে নাতনী কাড়াকাড়ি করে খায়। কারোর জাত টাত যায়না।

সেদিন তো ঘোমটা আর ঘাঘরা পরা নাচনমণির পুজো হচ্ছিল পেয়ারা তলায় নৈমুদ্দিন দিব্যি পুরুত সেজে ঘন্টা নাড়লো। আঙুরাচাচী হাসতে হাসতে কান ধরে তুলে নিয়ে গেলো এই যা।

ক’দিন থেকে নূতন খেলা শুরু হয়েছে ইফতার। রামু, দীপালি, রেখা, রহিম, তৌফিক, বুদ্ধুরাম সবাই জানে অন্ধকার থাকতে খেয়ে নিয়ে সারাদিন উপোস থাকতে হয়। সারাদিন উপোসটা অবশ্য এদের অনেকের জন্য আলাদা কিছু না। সন্ধ্যার সময় পেট ভরে খেতে হয় তারপর একদিন আসে চাঁদের দিন, সেদিন ঈদ। নামাজ পড়তে হয়। আকাশে একফালি চাঁদের ওপর সুন্দর তারাটি জাগে সেদিন ঈদ। কোলাকুলি করতে হয়।বন্ধুদের কিছু দিতে হয়।

মনিপুরী বস্তির গোরাচাঁদ আর ললিতা জানে চাঁদের রাতেই রাসপূর্নিমা নাচের উৎসব কিন্তু সেই চাঁদ বড় আর গোল । সে উপোস হলো কি হলো না, কিন্তু সন্ধ্যায় ইফতার হোলো। একদিন ঘরঘর থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে আনা মুড়ি, কজন এনেছিলো জমানো পয়সায় কেনা তেলেভাজা। একদিন খাওয়া দাওয়া হোলো কলা আর জাম। আর একদিন মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খুব ভালো ইফতার হোলো। আজ চাঁদের উৎসব। চাঁদ দেখা গেছে। নৈমুদ্দিন রসুল রহিম বড়দের সঙ্গে মসজিদে গেছে। নামাজ আদায় করেছে।আতর মেখেছে। কোলাকুলিও করেছে। হালুয়া, হালিম যা যা রান্না হয়েছে, খেয়েছে।

তা বলে দীঘির পাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ হবে না? রামু, ললিতা,বুধন সবাই মিলে নৈমুদ্দিনদের সঙ্গে নামাজ পড়লো। কচি গলার প্রার্থনা আল্লার দরবারে পৌছলো নিশ্চয়, ভুল ছিলো হয়তো তবু। আমিনার নানীর দেয়া একথালা সিমুই, লালুর বাবার দোকানের একহাঁড়ি বোঁদে, হালিমের আম্মার দেয়া ছোলা ভাজা দিয়ে দিব্যি দাওয়াত হচ্ছিল।

কিন্তু গোল একটা বাঁধলো; সাঁঝ পেরিয়ে গেছে, শাঁখ বাজানো হয়ে গেছে। বাচ্চাদের ঘরে ফেরার নাম নেই। গেল কোথায়? ও দীঘির পাড়ে ঈদের খানাপিনা হচ্ছে? চিন্তা হয়, আজকাল দিন বদলাচ্ছে, ঈদ, মহরম, পুজোর সময় শহর থেকে অতি উৎসাহী খবরদার আসে, নজর করে, ঘোঁট পাকায়। শেখাতে চায় অন্যের ধর্ম তোমার নয়, তোমার ধর্মে অন্যের নজর, ছোটরা তো বোঝে না, বড়রা ভয় পায়। তেতুইল্যার দীঘির পাড়ে কত ঘরপোড়া মানুষের বাস, সিঁদুরে মেঘে তারা ডরায়। মসজিদের মৌলবী আর গোবিন্দ জীউ আখড়ার গোঁসাই, সূফিয়ার নানী এক পাঠশালায় ছোটবেলা পড়েছে, এই খুদে গুলোর মতোই দৌরাত্ম্যি করেছে। মণিপুরি বস্তির বুড়োকে ডেকে আনে, গুটিগুটি চলে সব দীঘির পাড়ে।

কি কথা হয় সালিশি সভার সঙ্গে, একরোখা রা গলা চড়ায়, তিনমাথা যাদের এক হয়েছে তারা নির্বিকার। শান্তভাবে বলেন বাচ্চাদের বাপু ধমক চমক করতে যেওনা। ফিরতে পারবে না। সিমুই খাও,ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।

তারা সিমুই খায়না, প্রতিশোধের স্পৃহা নিয়েই হয়তো চলে যায়। পাকাচুলেদের চোখে চিন্তা, কিন্তু আজ যে আনন্দের দিন, দেখাই যাক না, আমরা যদ্দিন আছি…।

বাচ্চারা ঘরে ফেরে, পথে বকাঝকা কানমোল,চুলটানাও জোটে, এ রোজকার ব্যাপার, আজ একটু বেশীই রাত হয়ে গেল, সে যাক, ঈদের দাওয়াত তো হলে। দীঘি দেখে এপারে ঝুপড়ি বাড়ি সারিসারি, দাওয়ায় বসে বুড়োদের অস্পষ্ট আলাপ, ওপারে মাঠ পেরিয়ে শহর, গাড়ির ধোঁয়া, অন্ধকার ফুঁড়ে মোবাইলের টাওয়ার।

মসজিদে তুমুল এবাদত চলছে। প্রথমে ‘মিলাদ’ তার পড়ে ‘জিকির’। সে কি জিকিরের জোস !! যে যেমন পারছে তেমন করে পরছে, একজন আরেকজনের গায়ের উপরে পড়ে যায় “ইসকের” ঠেলায়। বেসিরভাগই এই দুষ্টুমি টা ইচ্ছে করে করত আরেক জনকে রাগানোর জন্য। ছোটদের উপস্থিতি থাকত সেইরকম বেশি। ছওয়াব টা যেন তাদেরই বেশি দরকার !! ছোটরা “এলহু এলহু” করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম মসজিদের চটে। এরি মাঝে কিছু অতি কৌতহলি মানুষ এসে দেখে যেত যে রান্না কতটুকু হয়েছে আর কতক্ষন লাগবে এইসব। তার পর তারা মসজিদে এসে কানে কানে সবাইকে এই খবর দিত। কেউ আবার বিড়ি খাবার জন্য, কেউ “ইসতেনজা” করার জন্য জিকিরে বিরতি নিয়ে বের হত।

এবার খাবার পালা।সবাইকে প্লেট দেওয়া, হাত ধোয়ানো, পানির গ্লাস দেওয়া, কুপি বা হারিকেন দেওয়া সব আমাদের দায়িত্ব !! সে যে কি হৈ হল্লা ! সবাই খেতে খেত হয়রান। গ্রামের মানুষ একটু বেশি খায়। পারলে বাসায়ও নিয়ে যায়। খাওয়া শেষ হলে ঢেকুর তুলতে তুলতে আর আলহামদু লিল্লাহ বলতে বলতে বাড়ি যায়।বাড়ি তো গেল সবাই কিন্তু এইসব হাড়ি পাতিল বাসন কোসন কে পরিষ্কার করবে কে ধুবে ? গ্লাস প্লেট কে দিয়ে আসবে? অরে ঐ তো রামু,বুদ্ধুরাম নিয়ম করে এই কাজটা করে থাকে..সে যতই সালিশিদের চোখ রাঙানি থাক..

দিন বদলের হাতছানি নেই;জমকালো অনুষ্ঠানের মহড়া নেই,জাতি ধর্মের কচকচানি মানে না শৈশবের শিশুমন অন্তত,রামু, নুরুল, সুচিত্রা, টুপু, তৌফিক এই সমাজের আকাশে একফালি চাঁদ, তারা, একটুও আক্ষরিক অর্থেই মেঘ নেই। কোথায় ফুটেছে হাসনুহানা। আতরসুবাস বাতাসে। কখনো পালিত খুশির হয় ঈদ। চাঁদের উৎসব।আবার কখনো দুঃখের পিঠচাপড়ানি মহরমের জিকিরে..

এ প্রসঙ্গে তথ্য:- শিয়া মুসলিমরা “মহরম” অনেক জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে পালন করলেও সুন্নিরা সেভাবে করেন না। এই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে।


চিত্র সৌজন্য : গুগল
©️শঙ্খচিল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল