সারা বিশ্ব তখন করোনা আতঙ্কে থরহরি কম্প; দেশি বিদেশী খবরের কাগজগুলি তখন চীন ও তার করোনা ভাইরাস সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশলের সমালোচনায় মুখর; সোশাল মিডিয়াতে ও উঠছে নানান প্রতিবাদের ঝড়; ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামি দামী চিকিৎসা ব্যাবস্থা তখন করোনার ঘায়ে তাদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে। এসব আলোচনা করতে করতেই শোভা দেবী ও তার বান্ধবী গার্গী রায়চৌধুরী সেদিনের মতো পার্কে তাদের শেষ পাকটা দিয়ে নিলেন।
বিবাহসূত্রে দুজনের দেখা এই পাড়াতে। গার্গী দেবীর শ্বশুর মশাই শোভা দেবীর দূর সম্পর্কের মামা শ্বশুর হন। তাদের দূরের হলেও একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেই কারণেই দুবাড়ির মধ্যে পুজো-পার্বণ অনুষ্ঠানে যাতায়াত চলে। সে কতদিন আগেকার কথা। শোভা দেবীর বয়স তখন মাত্র সতেরো কি আঠারো। বিয়ে করে এসে এই অচেনা জায়গায় পাশে পেলেন একমাত্র সমবয়সী গার্গীকে। কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের এতো সখ্যতা জন্মে গেল যে পাড়ার লোকেরা তাদের ‘সই’ বলে মজা করতো। একসাথে সিনেমা দেখা, পুজোর কেনাকাটি, স্বামী-বিয়োগ কত সুখ দুঃখের স্মৃতিই না জড়িয়ে আছে তাদের বন্ধুত্বকে ঘিরে। আজকালতো আর সেসব হয়ে ওঠেনা। ডায়াবেটিস দূরীকরণের অছিলায় এখন তারা নিয়ম মেনে বিকেল বেলা করে এই পার্কে হাটঁতে আসেন ।
আজ একটু বাড়ি ফেরার তাড়া রয়েছে দুজনেরই । প্রধানমন্ত্রী আজ সন্ধ্যা বেলা বক্তৃতা দেবেন। কানাঘুঁষো শোনা যাচ্ছে লকডাউন করে দিতে পারেন নাকি গোটা দেশে। তাই দুজনে পার্কের গেট পেড়িয়ে বেশী কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। আজ সুদীপ্ত ও অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। সে এক নামী বহুজাতিক সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাদের অফিসেও নাকি work from home দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে পাছে করোনা ছড়িয়ে পরে কর্মচারীদের মধ্যে। এ রোগ যে ভীষণ কঠিন। ধরলে একবার আর রক্ষে নেই. তাই কেউই ঝুঁকি নিতে নারাজ. শোভা দেবী পার্ক থেকে ফিরে নিজের হাত Sanitize করে জামা কাপড় পাল্টে সন্ধ্যে দিয়ে নিলেন। সুতপা তখন রান্নাঘরে জলখাবার তৈরীতে ব্যাস্ত। সে ও আজ ছাত্রদের একটু আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে। জলখাবার খেতে খেতে সবাই এক টেবিলে বসে শুনলেন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। আগামী ২২শে মার্চ ‘জনতা কে লিয়ে জনতা কে দ্বারা কারফিউ’। ভাষণ শেষ হতেই টিভিটা বন্ধ করতে করতে শোভা দেবী ভাবলেন “ইস.. সেদিন যে গার্গীকে নিয়ে আমার গোলাপ গাছ কিনতে যাওয়ার কথা। লোকটা যে রবিবার করেই বাজারে আসে”। সেদিন রাতে দুজনে মিলে ফোনে তাদের এই সপ্তাহে গোলাপ গাছ কিনতে না পারা নিয়ে খুব দুঃখ করলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপর খানিকটা ক্ষোভ ও উগরে দিলেন। তবে তাঁর কথা মতো রবিবার গৃহবন্দী রইলো গোটা দেশ। সে যেন এক উৎসব। সুদীপ্ত সেদিন আগে থেকে মাংস এনে রেখেছিলো। সুতপা আগ্রহ করেই রান্নার মাসিকে ছুটি দিয়েছে। একটাই তো দিন। তাই সে নিজের হাতে ফ্রাইড রাইস আর মটন রাঁধলো। দুপুরে মটন এর শেষ টুকরোটা খাওয়ার সময়ে শোভা দেবী শুনলেন সোমবার থেকে নাকি একুশ দিনের জন্য গোটা দেশে লকডাউন করে দেওয়া হবে। তিনি মনে মনে বললেন “তাহলে একুশ দিন কি তবে গার্গীর সাথে দেখা হবেনা?? ও কে যে শান্তিনিকেতন থেকে সুতপার মায়ের এনে দেওয়া নতুন বটুয়া ব্যাগটাই দেখানো হলো না। ও বেচারী বলেছিলো পছন্দ হলে এবার পয়লা বৈশাখে ওটা নিয়ে পাড়ার কালচারাল প্রোগ্রামে যাবে। আর তো মনে হয়ে না একুশ দিন আমার সাদা গোলাপের চারা কেনা হবে বলে”। কথা মতো ঘড়ির কাঁটা ঠিক বিকেল ৫টা; সবাই শাঁখ, কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে স্বাস্থকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করলো। খানিকটা বিষাদভরা মনেই শোভা দেবী নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এই উদ্যোগে যোগ দিলেন। গার্গী দেবী সেদিন রাতে ফোন করে জানালেন পার্কে নাকি মিস্টার বোস এসে পোস্টার টানিয়ে দিয়ে গেছেন ‘ক্লাব অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ’, পাছে social distancing না মানা হয়।
অনিচ্ছাকৃত ভাবেই নিরুপায় হয়ে শোভা দেবী ছাদে উঠতে শুরু করেছেন এখন। এতদিনের একটা অভ্যেস নষ্ট করা চলে না। সুতপা, সুদীপ্ত আর তাদের ছেলেও ঠাম্মির সাথে যোগ দেয় মাঝেমধ্যে। Work from home আর online class এর ভারে তাদেরও একটু ফ্রেস এয়ার নেওয়া প্রয়োজন। ইতি মধ্যে কানে এসেছে পাড়ার পিছন দিকে নাকি বেশ কজনের করোনা ধরা পড়েছে। সেসব জায়গা নাকি সিল করে দেওয়া হয়েছে। নাম ধাম জানার ও বালাই নেই। সে বিষয়ে বিশাল কড়াকড়ি। বাড়িশুদ্ধ সকলকে quarantine করা হচ্ছে। খবরে শোনা যাচ্ছে মারা গেলে নাকি বাড়ির লোকের দেখা তো দূর শ্মশানে নাকি পোড়াতে অবধি দেওয়া হচ্ছে না। শোভা দেবী আতঙ্কিত মন নিয়ে ভাবছিলেন “কি যে শুরু হলো বাবা….জীবনে তো শুনিনি এসব। কেন যে চীনাগুলো বাদুড় খেতে গেল”। এর মধ্যেই তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল “আচ্ছা গার্গীদের আসে পাশেই তো হয়েছে মনে হচ্ছে। ওকে ফোন করলে নিশ্চই সব জানা যাবে”। পরক্ষনেই বলে উঠলেন “এতো রাতে হয়তো ফোন করা টা ঠিক নয়, তাও নিছকই আগ্রহের বশে। কাল করা যাবে না হয়”।
বাড়ির মাসিদের ট্রেন বন্ধ থাকায় সুতপার সাথে হাত লাগিয়ে শোভা ও কিছু কাজ এগিয়ে দেন। একদিন দুপুরে কাঁচের বাসন গুলো শোকেসে গুছিয়ে রাখতে রাখতে শোভার খেয়াল পড়লো “বেশ কয়েকদিন হলো গার্গী ফোন করছে না। মাসিও আসছে না যে একটু খোঁজ নেওয়াবো। কেমন আছে কে জানে। এই করোনাটা যে কেন এলো। ধুর আর ভালো আগে না। ওর নাতির মোবাইলে পড়াশুনো শুরু হলো নাকি কে জানে। এতদিন তো ও ফোন না করে থাকে না। খোকার কাজ শেষ হলে আজ একবার ফোনটা ধরে দিতে বলবো”।
সেদিন সকালে হঠাৎ কিসব কথায় শোভা দেবীর ঘুম ভেঙে গেল। আজ একটু দেরি করেই উঠেছেন উনি। কাল অনেক রাত অবধি রামায়ণ পড়ে শোনাচ্ছিলেন নাতি কে। উঠে দেখলেন সুদীপ্ত বাজার থেকে ফিরে বৌমাকে নিচু গলায় কিছু একটা বলছে। তার মাকে দেখে ফেলতেই খানিকটা ঘাবড়ে থেমে গেল। হালকা করে “গার্গী জেঠিমা” কথাটা যেন কানে ভেসে এলো শোভা দেবীর। আসলে সাইকোলজি বলে চেনা নাম আগে কানে আসে। আর এ নাম যে শোভা দেবীর খুব পরিচিত। তখনই তার মনে কিছুটা কু ডাকল। সেদিন সকালে শোভা দেবী আর কিছু ব্রেকফাস্ট করলেন না। মনটা বড্ডো আনচান করছে তার। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে গোলাপ গাছের জন্য কিনে রাখা টবগুলোর দিকে তাকিয়ে না কিনতে পারা সাদা গোলাপ গাছ গুলোর কথা ভাবছিলেন। এমন সময় বোচকা এসে কাঁদো কাঁদো মুখে ঠাম্মি কে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শোভা জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে সোনা??? বাবা বকেছে??? আচ্ছা আমি বকে দেব….” । তাঁর কথা শেষ করে ওঠার আগেই বোচকা বলে উঠলো “গার্গী ঠাম্মি আর নেই গো ঠাম্মি…করোনা হয়েছিল.. মা আর পাপা বলাবলি করছিলো..ভাস্কর কাকু, রিংকু কাকিমা আর তাতাই কেও ধরে নিয়ে গেছে গাড়ি এসে….”. বলতে বলতে ঠাম্মির বুকে মাথা গুঁজে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কথাটা যেন শোভা দেবীর বুকে তীরের মতো বিঁধলো। একসাথে অনেকগুলো স্মৃতি নিমেষের মধ্যে আলোর গতিতে তার চোখের সামনে চলে এলো। নিজেকে খানিকটা সামলানোর ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন “করোনাটা বুঝি আমাদেরও ছাড়লো না রে সই…”।
চিত্র সৌজন্য : গুগল
খুব সুন্দর