ছোট একটা হিমবাহ,আড়াআড়ি 30-40ফিটের হবে,আর সেটা নেমে গেছে নিচের ছোট ঝর্ণা পর্যন্ত (1000-1500নিচে)।সেটা পেরোতে গিয়ে একটু তাড়াহুড়ো করেছিলাম-ব্যাস্ ঐ বরফের হিমবাহের উপর পিছলে নেমে গেলাম 100-150 ফিট্ নিচে।একটা হাইকিং স্টিক্(ট্রেকিং এ ব্যবহৃত বিশেষ ধরণের লাঠি) ছিটকে গেছিল আগেই,আরেকটা প্রানপনে গেঁথে দিলাম বরফের মধ্যে,তাও খানিকখন ছেঁচড়ে গিয়ে থামলাম।বরফে ছেঁচড়ে গিয়ে হাতের আঙুল কেটে রক্ত ঝরছে।তাও কোন রকমে আটকে থাকলাম বরফের মধ্যে।আর কিছু পরেই আমাদের একজন পোর্টার দৌড়ে এসে কোন রকমে আমাকে টেনে তুলল। পোর্টারের হাত ধরে কোন মতে সেই জায়গাটা পেরোলাম,বার দুয়েক পা হড়কালো,ওকে নিয়েই পিছলে যাচ্ছিলাম প্রায়।ও আমাকে মনে সাহস এনে ধীরে ধীরে জায়গাটা পেরোতে বলল।
ভুলটা আমারই,পিছনে থাকা বন্ধু অনেক বার আমাকে তাড়াহুড়ো করতে বারণ অরেছিল।পোর্টাররা যে পথে আমাদের মালপত্রের কয়েকশো কিলোর বোঝা নিয়ে তরতর করে পেরিয়ে গেল,আমি তাদের পায়ের ছাপ এর উপর পা রেখেই পার হব ভেবেছিলাম।কিন্তু অর্দ্ধেক পথ পেরোবার পরই এই ভীষণ ভাবে আছাড় খাওয়া।এরপর পোর্টাররা পা দিয়ে গর্ত করে দিল বরফে আর আমার বন্ধুরা একে একে পেরোলো।
এবার বুরানঘাটি ট্রেকিং এ এমনই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হল।অ্যাডভেঞ্চাররের নেশায় এবার একটু কঠিন হাই অল্টিটিউড্ ট্রেকিং করব ভেবেছিলাম।তাই চলে গেছিলাম হিমাচল প্রদেশের এই ট্রেকিং রুটে।এই রুট খুব বেশি জনপ্রিয় নয়,কিন্তু অপূর্ব এই রুটের দৃশ্য।বেশ কিছু ট্রেকিং টিম এবার ঐই ট্রেক করতে এসেছে।এই রুটে পাস্ এর সর্ব্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 15500 ফিট।
আমরা চার বন্ধু দেবকুমার,দিব্যেন্দু,তিমির এবং আমি মিলে এবারের এই ট্রেকিং এ এসেছি।সময়টা 2016 সালের May মাসের শেষ সপ্তাহ।এটাই এই রুটে ট্রেকিং এর আদর্শ সময়।আমরা হাওড়া থেকে কালকা মেলে কালকা এসেছি,তারপর বাসে করে রোড়ু নামে সিমলার এক ছোট জনপদে আসা।পরদিন আবার বাসে জাংগলিক্ নামে ছোট্ট একটা পাহাড়ী গ্রামে রাত কাটানো।আমাদের গাইড পঙ্কজ নেগীর দোতলা কাঠের বাড়িতে থাকা ,আর তাদের আতিথেয়তা সারা জীবন মনে রাখার মতো।পরদিন এখান থেকেই আমাদের হাঁটা শুরু।প্রথম দিন প্রায় 5-6 কি.মি. এর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা প্রথম টেন্ট ফেললাম দায়রা নামে পাহাড়ী বুগিয়ালে(বুগিয়াল হল পাহাড়ের মাঝে সমতল ঘাসজমি)।এদিন প্রথম টেন্টে রাত কাটানো।বাইরে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া(1-2ডিগ্ৰীC),আমরা চার বন্ধু গুটিসুটি মেরে একটা টেন্টে,আর পাশের টেন্টে ডিনার তৈরি করছে পোর্টাররা।সোয়াবিন দিয়ে গরম গরম খিচুড়ী দিয়ে ডিনার সেরে স্লীপিং ব্যাগের ভেতর ঘুম।পরদিন ঘুম থেকে উঠে টেন্টের বাইরে চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখলাম,দূরের পাহাড় গুলো বরফে ঢেকে গেছে আর তাতে সূর্যের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।এ দৃশ্য ভাষায় বর্নণা করা সম্ভব নয়।সকালে মোটা মোটা চাপাটি,ডিমের ঝুরঝুরে ভাজা,আচার দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পরের গন্তব্যে চন্দ্রনাহান লেক এর উদ্দেশ্যে। চন্দ্রনাহান ৭,৮টা প্রাকৃতিক জলারের সমাবেশ ।একটা জলাধার এর পাশ দিয়ে ঝর্ণা নেমে আসছে।আমরা ঐ পাহাড়ী নদীর পাশ দিয়ে উঠতে থাকলাম চন্দ্রনাহান লেক দেখব বলে,আর আমাদের পোর্টাররা টেন্ট ফেলে দুপুরের খাবার তৈরি করতে থাকল।এই পর্যন্ত আমাদের মাল বইছিল ঘোড়া।এরপর আমরা প্রায় 11,000 ফিট্ উচ্চতায় পৌঁছেছি।তাই ঘোড়া নিয়ে গেল ঘোড়া-ওলা।কারণ এর বেশি উচ্চতায় ঘোড়া যাবেনা।পরবর্তী দিনে পোর্টাররাই সমস্ত মাল টেন্ট,রান্নার সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে যাবে।আমরা যে যার রুকস্যাক বইব।চন্দ্রনাহান লেক চোখ জুড়িয়ে গেল,পাহাড়ের এত উপরে পর পর ৭,৮টা প্রাকৃতিক জলাশয় এক কথায় অপূর্ব।স্থানীয় পোর্টার বলল চাঁদের আলোয় রাতের দেবতারা নাকি এখানে স্নান করতে আসে,তাই এই নাম চন্দ্রনাহান।
আমরা পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোলাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দুন্দা।এটা হল বুরান ঘাটি বা বরুয়া পাস্ এর বেস্ ক্যাম্প।বরফ গলা পাহাড়ী নদী পেরিয়ে,দুধারে হিমবাহ দেখতে দেখতে চলেছি আমরা।এই নদীর জলই আমরা বোতলে ভরে খাচ্ছি জিওলিন মিশিয়ে,না হলে হিল ডাইরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।দুন্দা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।পড়ন্ত বিকেলের রোদে দেখলাম যেন স্বর্গে এসে পৌঁছেছি।বরফে মোড়া পাহাড় গুলো যেন সব হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
হঠাৎ কেন যেন মনে হচ্ছিল এই পাহাড় গুলোর কোথাও হয়তো শিব ঠাকুর বাঘছাল পরে এপাহাড় থেকে ও পাহাড় লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে রাত্রে (-2c,-3c) আমরা চার বন্ধু আমাদের টেন্টে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমের চেস্টা করছি,কিন্তু ঘুম আসছে না।13000 ফিট্ উচ্চতায় এমনই হয় , মাথা যন্ত্রনা,বমি ভাব,ঘুম না আসা।পাশের টেন্টে আমাদের পোর্টার বীরু,শীতল,চন্দরকুমার শীত কাটানোর জন্য গান গাইছে।ওরা সারা রাত গান করেই কাটিয়ে দিল।পরদিন ভোর ৫টায় ওদের ডাকেই ঘুম ভাঙল,দেখি ব্রেকফাস্ট ম্যাগী আর চা রেডি।আজ তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে,কারণ দুপুরের মধ্যে পাস ক্রশ করতে হবে।তাই ভোর ৫টায় উঠে গোগ্রাসে ম্যাগী ,চা খেলাম।ফল যা হবার তাই হল,সব হড়হড় করে বমি।যাই হোক থেমে থাকা যাবে না তাই বরুয়া পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।পাথুরে বোল্ডার এর স্তূপের উপর দিয়ে উঠতে থাকলাম পাসের দিকে,পাশের পাহাড় থেকে টুপটাপ করে খসে পড়ছে পাথর।এই ভাবে হাঁটতে হাঁটতে বড়ো হিমবাহ পার করলাম (যেখানে আছাড় খেয়েছিলাম)।এসে পৌঁছালাম বুরান ঘাটি বা বরুয়া পাসে।পাথর জড়ো করে ভগবানের মন্দির সাজানো,আমরা বাদাম চকলেট্ দিয়ে পুজো দিলাম স্থানীয় মানুষের আরাধ্য দেবতা জাগ সাব এর।এরপর নামার পালা,পাস এর অপর প্রান্ত পুরোটাই বরফে ঢাকা।পোর্টাররা বরফ কেটে ধাপ করেদিল আমরা ঐভাবে ধাপে পা রেখে নামলাম কোন রকমে।এরপর পোর্টাররা বলল স্লিপ কেটে নামতে হবে।আমরা তাই ওভাবেই স্লিপ কেটেই নামলাম।এই করে ঐ দিন আমরা প্রায় 11km রাস্তা অতিক্রম করলাম ।সন্ধ্যা থেকে রাত হয়েগেল আমাদের টেন্টে পৌঁছাতে।সম্পূর্ণ অন্ধকারের টর্চে আলোয় পাহাড়ী খাদ পেরোলাম জীবন হাতে করে।দেখলাম পীচের মত কালো আকাশে অগুন্তি তারার মেলা।ছায়াপথ ও দেখা যাচ্ছে।টেন্টে পৌঁছাতে প্রায় রাত১০টা বেজে গেল।পরদিন টেন্ট গুটিয়ে নামার পালা।দেখলাম পাহাড়ী গ্ৰামের ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে।বুঝলাম কাছেই গ্ৰাম।তাও ওই ক্লান্ত শরীরে ঐগ্ৰামে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।ওখান থেকেই আমরা সিমলা যাবার গাড়ি ধরলাম।এবার যে বাড়ি ফেরার পালা।মন খারাপ করলো ঠিকই কিন্তু সঙ্গে ছিল যে সারা জীবন মনে রাখার মত “চাঁদের পাহাড়” জয় করার অভিঞ্জতা।