চিনে বাদামের খোসা ভাঙতে ভাঙতে জানলার পাশের সিটটা ঠিক ফাঁকা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে হওয়া ঝমঝমানি বৃষ্টির পরে এবং ট্রাফিকের লাল সবুজ বাতি পেড়িয়ে বিকেলের শেষ রোদটুকু এবং শরতের পেঁজা মেঘের চিহ্নটুকু স্পর্শ করে এগিয়ে চলেছি কর্মব্যস্ত শহরের বাইরে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে হয়ে থাকলে রাস্তার দুপাশের আলোর রোশনাই, চারিদিকে ঢাকের ধ্বনি এবং একটা সাজো সাজো গন্ধ, লোকারণ্যে উৎসবের মিছিল, গাড়ির কাঁচে কখনো জলের আঁচড়,আর তার সাথে রকমারি আলোর প্রতিফলন আঁকা। চারিদিকে নানা রকমের সুর,গান, রাস্তার মোড়ে বাঁশের কাঠামো, এক নারী মূর্তির প্রতিফলন, শিউলি ফুলের সুবাস আর কাল ফুলের সজ্জা। ঝুপ্ করে ডুব দিয়ে সন্ধ্যে নামের শহরের রাস্তায়। গাড়ির ঝনঝনানি আর নস্ট্যালজিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাই আমার পুরোনো শহরের হারানো ঐতিহ্যের কাছে। ফিরে দেখার সময়গুলো ঘড়ির সশব্দ প্রহরীতে ও দিনযাপনের ব্যস্ততায় গুটিয়ে নেয় নিজেকে।
জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারের মানুষগুলোর কর্মোদ্যম, পুরোনো ছবির সামনে সম্পর্কের রেশটুকুর অব্যক্ত কথোপকথন,শহর সজ্জা, কাজের ফাঁকে মাটির ভাঁড়ে এক-চুমুক দু-চুমুকের স্বস্তি,ফুচকার দোকানের ভিড় আর বাঙালির রসোগোল্লা – সবকিছু মিলে মিশে এক নতুন প্রস্তুতির উদ্যোগ নিয়েছে। স্মৃতির আনাগোনায় কফি হাউসের আড্ডা, বিকেলের ভাবজমাটি, পুরোনো কলরব, ফ্যাকাসে ব্যালকনি, কোথাও সম্পর্ক বাঁচানোর লড়াই ও অর্থের খচখচানি, কোথাও পুরোনো অভ্যাস ফিরে পাওয়ার ব্যাকুলতা, কোথাও প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়া অথবা খোঁজা-সব এক লহমায় ম্লান হয়ে যায় সময় ও স্মৃতির টেরাকোটায়।
বহুদিনের পুরনো অভ্যাসে থাকা পিতৃপক্ষের অবসান ও মাতৃপক্ষের শুরুতে , প্রভাতী মহালয়া শোনার মুহূর্তগুলো মৃতপ্রায় হলেও বাঙালির বাঙালিয়ানায় মহালয়ার সেই ধ্বনি ও সম্পর্ক সদা শাশ্বত। চারিদিকে নবসজ্জা,নব প্রস্তুতি – দশ হাতে দশ অস্ত্র নিয়ে সপরিবারে তাঁর আবির্ভাবের দিন গোনা বাঙালি কখনো একান্তে, কখনো লোকারণ্যে, কখনো সতীর্থদের সান্নিধ্যে থাকা ভালোলাগায় , কখনো পিছুটানে, কখনো শৈশবের অবাধ্যতায়,পেটপুজোর আবেগে, ভালো থাকার সান্নিধ্যে ও ফিরে না পাওয়া মুহূর্তের বন্ধনে ও একমুঠো ভালোলাগায় বারে বারে হারিয়ে যাই নস্ট্যালজিয়ায়। শৈশবে ছুটির দিন গোনা ও ছুটি শেষের সাথে দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার বিস্মৃতিতে পুরোনোকে খুঁজে পাওয়ায় মিশে আছে অকৃত্রিম ভালোলাগা,যা কখনো যোগায় বিষাদমাখা মৃদু হাসি। মাতৃপক্ষের সূচনায় শৈশবের খুনসুটিমাখা কাহিনীগুলোর পিছুটানে স্মৃতির সরনী বেয়ে এগিয়ে চলেছি, আমার সঙ্গে চলেছে নতুন কাঠামোর সাজ, প্যান্ডেলের প্রস্তুতি আর জট পাকানো ঘটনার মুক্তি।
হঠাৎ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। বিজয়ার সকালে স্নিগ্ধ রোদটুকুর স্পর্শে অনেক পরম্পরার সমাপ্তি ও হঠাৎ দেখা স্বপ্নটুকুর রেশ থেকে যায়,ঠিক যেমনভাবে চেনার মধ্যে অচেনার রেশটুকু লেগে থাকে।মাতৃপক্ষের সূচনায় তৈরি কাঠামোগুলোর সাথে তখনো থেকে যায় অনেক হিসেব নিকেশ, কাহিনীর পরম্পরা, আবেগের সমারোহ ও প্রতীক্ষার অবকাশে লেগে থাকে শেষ বিকেলের ভালোলাগা টুকু আর খোসা হীন চিনে বাদামের গল্পগুলো।
চিত্র সৌজন্য : গুগল