প্রত্যেক বারের মত গতবছরও এপ্রিল থেকেই চিন্তা ভাবনা শুরু হলো পুজোর ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়। যেহেতু রেলের advance booking এখন 4 মাস আগেই খুলে যায় এবং এজেন্ট দের দৌরাত্বে কয়েক সেকেন্ডেই টিকিট waiting এ চলে যায় তাই যথেষ্ট আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে পুজোর বুকিং পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আগের দু বছর পাহাড় জঙ্গল ঘুরে ক্লান্ত আমার গিন্নি আগেই ঘোষনা করলেন ” এবার কিন্তু সমতলেই ঘুরবো “।
আজ্ঞা শিরোধার্য করে জায়গা ঠিক করতে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার তাহলে আমাদের গন্তব্য হবে ভাইজাগ-আরাকু ভ্যালি-হায়দ্রাবাদ। সেই মত পরিকল্পনা করে পাড়ার Tours & Travels এর অফিসে যোগাযোগ করলাম, ওনারা জানালেন যে ভোর-ভোর বিশাখাপত্তনম (ভাইজাগ এর আদি নাম ) ঢুকতে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ই সেরা, দুপুর 2.50 এ হাওড়া থেকে ছেড়ে পরেরদিন ভোর 4.00 টেয় বিশাখাপত্তনম পৌঁছে দেবে তবে পুজোর সময় ওই ট্রেনের AC র কনফার্ম বুকিং পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, তারথেকে কয়েকদিন বাদে মানে নবমীর দিন বৃহস্পতিবার যদি বেরোই তাহলে হাওড়া-ত্রিচি এক্সপ্রেস এ { Hwh Tpj Express -12663 ( Howrah Junction to Tiruchchirapali ) } নিশ্চিত ভাবে সিট্ এর ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে এই ট্রেনটি বিকাল 4.10 এ হাওড়া থেকে ছেড়ে পরেরদিন সকাল 5.35 এ পৌঁছায়। আমরাও পুজোয় কয়েকদিন আনন্দ করে তবেই ঘুরতে যেতে চাইছিলাম, সেই মর্মে এই ট্রেনটিই ফাইনাল করে advance দিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়ি গিয়ে দেখলাম স্ত্রী ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করেছে আরাকুর অদূরেই ছত্তিশগড় এর জগদলপুরে নাকি রয়েছে চিত্রকূট জলপ্রপাত, যা ভারতের নায়াগ্রা নাম খ্যাত, এবং সত্যিই ইন্টারনেট এ চিত্রকূট এর রূপ দেখে মন ভরে গেল। ঠিক করলাম itenary র রদবদল ঘটিয়ে চিত্রকূট দেখতেই হবে।
খোঁজ নিয়ে জানলাম ভাইজাগ থেকে আরাকু যাওয়ার যে বিখ্যাত ট্রেন Kirandul passenger, যা সকাল 6.50 এ বিশাখাপত্তনম থেকে ছেড়ে বেলা 10.40 এ আরাকু পৌঁছায় সেই ট্রেনটিই বিকাল 4.00 টেয় পৌঁছায় জগদলপুর। তবে আমাদের হাতে যা সময় থাকবে তাতে জগদলপুর ঘুরতে গেলে হায়দ্রাবাদ ঘোরা হবে না।
ইতি মধ্যে যাওয়ার টিকিট হয়ে গিয়েছিলো, সেটা আনতে আবার Tours & Travels এর অফিসে গেলাম ও বাকি বুকিং সেরে ফেললাম। যেদিন ভাইজাগ পৌঁছাবো সেদিন টা কাছেপিঠে ঘোরাই ভালো, পরেরদিন পুরো সাইট-সিয়িং, তার পরেরদিন Kirandul passenger এ আরাকু পৌঁছে সেইদিনটা রিসর্টে রিল্যাক্স করা যাবে। তার পরের দিন আরাকুর জগদলপুরে। আরাকু থেকে পরের দিন আবার ওই ট্রেন ধরে বিকেলে পৌঁছবো জগদলপুর, সেদিনটা বিশ্রাম নিয়ে ও কাছে পিঠে ঘুরে পরেরদিন জগদলপুরের সাইট-সিয়িং। জগদলপুর থেকে সরাসরি হাওড়া আসার একটিই ট্রেন রয়েছে কোরাপুট-হাওড়া এক্সপ্রেস যা ভোর 4.15 এ জগদলপুর থেকে ছেড়ে পরেরদিন সকাল 6.25 এ হাওড়া পৌঁছায়। যদিও এই জার্নিটা একটু একঘেয়ে তবুও এটাই বুক করলাম নাহলে আবার ডাউন Kirandul passenger ধরে ভাইজাগ এসে, সেখান থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরতে হত, আরো একটা দিন বেশি লাগতো।
ভাইজাগ-আরাকু তে থাকার জন্য APTDC (Andhra Pradesh Tourism Development Corporation ) হোটেল বুক করাই মনস্থ করলাম। যে কেউ ওনাদের ওয়েবসাইট https://tourism.ap.gov.in/home এ সরাসরি গিয়ে ঘর ও সাইট-সিয়িং এর প্যাকেজ বুক করতে পারেন। ভাইজাগ এ APTDC এর দুটো হোটেল আছে একটি স্টেশন এর কাছে রামকৃষ্ণ বিচ এ ” YATRINIVAS – HARITHA HOTEL ” এবং আরেকটি হলো ঋষিকোন্ডা বিচ এ ছোট টিলার ওপর অবস্থিত ” RUSHIKONDA,HARITHA BEACH RESORT “. দ্বিতীয়টিই হল প্রিমিয়াম হোটেল কিন্তু পুজোর জন্য হোটেলটির সাধারণ রুম আগেই বুক হয়ে গিয়েছিল, শুধু বেশি দামের ঘর পরে ছিল তাই আমরা রামকৃষ্ণ বিচের যাত্রী নিবাস এই ঘর বুক করলাম। আরাকু তেও APTDC এর দুটি হোটেল আছে তার মধ্যে একটিতে ঘর বুক করলাম। সাইট-সিয়িং এর জন্যও APTDC এর অনেক প্যাকেজ আছে, আমরা লোকাল সাইট-সিয়িং এর প্যাকেজ বুক করলাম, ভাইজাগ থেকে আরাকু গিয়ে আবার ভাইজাগ ফিরে আসার ও অনেকগুলি আকর্ষণীয় প্যাকেজ আছে কিন্তু যেহেতু আমরা আরাকু থেকে জগদলপুর যাবো তাই ওই প্যাকেজ বুক করলাম না। আপনারা যদি জগদলপুর না গিয়ে হায়দ্রাবাদ যান তাহলে ওই প্যাকেজ বুক করতেই পারেন। আরো অনেক ট্যুর এর বিবরণ আপনারা APTDC এর পেয়ে যাবেন।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল, আমরা পঞ্চমী থেকে অনেক আনন্দ করে, অষ্টমীর অঞ্জলি,পাড়ার পংক্তিভোজ, সন্ধিপুজো উপভোগ করে খানিকটা ভারাক্রান্ত মনেই একদিন আগে মা কে বিদায় জানিয়ে নবমীর দিন ট্রেনে উঠে পড়লাম। সহযাত্রীরা অনেকেই বাঙালি ছিলেন, পুজোর গল্পেই সময় কেটে গেলো। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম, সকালে ঠিক করে ঘুম ভাঙার আগেই ভাইজাগ পৌঁছে গেলাম। স্টেশন থেকেই হোটেল এ যাওয়ার অটো পাওয়া গেলো, APTDC এর হোটেল সকলেই চেনে, অটোয় YATRINIVAS মিনিট 15 র পথ, কিছুক্ষন গলিপথ দিয়ে চলার পর সমুদ্রের পাশ দিয়ে রাস্তা চললো, অনেকটা পুরি বা মুম্বই এর মত মনে হতে পারে, মনোরম সৌন্দর্যে মন ভরে গেলো।
দূরে দেখলাম ছোট পাহাড়ের মাথায় বিশাল শিব-পার্বতীর মূর্তি, দেখেই কলকাতার জন্য মন কেমন করে উঠলো। দেখলাম মূর্তির পশে বিশাল অক্ষরে লেখা ” vuda kailasagiri “. হোটেল ও ঘর অত্যন্ত পরিস্কার এবং স্টাফেদের ব্যবহার ও খুবই আন্তরিক ছিল। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার পর হোটেল কর্মী এসে ব্রেকফাস্ট এর জন্য ডাইনিং রুমে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি APTDC র সব হোটেলেই Breakfast Complementary, সুন্দর আঞ্চলিক খাবার ওনারা পরিবেশন করেন এবং তা অত্যন্ত সুস্বাদু। রামকৃষ্ণ বিচে কিন্তু স্নান করা যায় না, স্নান করার ইচ্ছে থাকলে কিন্তু আপনাকে ঋষিকোন্ডা তেই থাকতে হবে। ভাইজাগ এর একটা বৈশিষ্ট হল এখানে আপনি পাহাড় ও সমুদ্র উভয়ের সৌন্দর্য একসাথে উপভোগ করতে পারবেন। হোটেল থেকেই দেখতে পাবেন অর্ধচন্দ্রাকার সম্পূর্ণ সমুদ্র তট ও বিখ্যাত পাহাড় ” ডলফিনস নোজ “.
বিকেলে বেরিয়ে পরলাম সমুদ্রের ধার ধরে চেকে দেখলাম স্ট্রিট ফুড, ভালো তবে কলকাতার মত নয়। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বেশ কয়েকটি পার্ক আছে , সেখানে কিছুক্ষন বসে হাঁটতে লাগলাম vuda kailasagiri র দিকে, হোটেল থেকে হেঁটে মিনিট 15 লাগবে, দেখলাম সেটা একটা পার্ক যেটা পাহাড়ের মাথায় বানানো হয়েছে। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম।
পরেরদিন বেরিয়ে পড়লাম সাইট-সিয়িং এর জন্য, যেখান থেকে APTDC এর সাইট-সিয়িং এর বাস ছাড়ে অর্থাৎ ” APSRTC Central Bus Station ” সেটা খানিকটা দূরে, হোটেল এর সামনে থেকেই অটো পেয়ে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম ওখান থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের সর্বত্র যাওয়ার ই বাস পাওয়া যায় এবং সেখানে প্রচুর বাঙালি হোটেল ও হয়েছে। যাঁরা বাইরে গেলেও বাঙালি খাবারই পছন্দ করেন তারা ওখানকার হোটেল বুক করতে পারেন।
সাইট-সিয়িং এর প্রথম স্পট হল সীমাচলমে অবস্থিত নৃসিংহ মন্দির, এটি ভারতের একমাত্র মন্দির যেখানে শ্রী বরাহ লক্ষ্মী নৃসিংহ স্বামী পূজিত হন, বিশাল এই মন্দির টি অনেক দূর থেকেই দেখতে পাবেন এবং মন্দিরটি ঘুরে দেখতে যথেষ্ঠ সময় ও লাগবে। মন্দির টির একটি বিশেষত্ব হল কেবলমাত্র অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মূল বিগ্রহটি সম্পূর্ণ ভাবে দেখা যায়, বাকি সারা বছর চন্দনের গাঢ় প্রলেপে আবৃত থাকে বিগ্রহটি।
মন্দির থেকে প্রসাদ সংগ্রহ করে চললাম দ্বিতীয় স্পটের দিকে। অবাক হয়ে দেখলাম দ্বিতীয় স্পট হলো vuda kailasagiri . জানলাম কৈলাশগিরি ” হিলটপ পার্ক ” টি 380 একর জায়গা নিয়ে নির্মিত এবং 2003 সালে এটি “Best Tourist Spot” সম্মান লাভ করেছিল। আমরা অপূর্ব সুন্দর এই পার্কটি ঘুরে দেখলাম ও পার্কে টয় ট্রেন ও কেবল কার (রোপওয়ে ) এ চরে মজা করলাম। ওপর থেকে পুরো ভাইজাগ শহরটির ও সি বিচের দুর্দান্ত ভিউ পাওয়া গেলো। পুরো পার্কটি ঘুরতে বেশ সময় লাগবে। এপর আমরা গেলাম ঋষিকোন্ডা বিচে। দেখলাম আমাদের দিঘার মতন প্রচুর লোক স্নান করছেন সেখানে। কিন্তু যেহেতু আমাদের আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে তাই ওই সুখে বঞ্চিত ই রইলাম। সমুদ্র তটের উল্টো দিকে ছোট এটি পাহাড় এর তার ওপরে দেখলাম পরপর কিছু হোটেল হয়েছে।
এর পর আমাদের দেখতে নিয়ে যাওয়া হল ” Thotlakonda Buddhist Complex ” . বর্তমানে এটি একটি ধ্বংসস্তূপ যা প্রায় ২০০০ বছর আগেকার হীনযান সম্প্রদায়ে বৌদ্ধ দেড় স্তুপ ছিল যা সাতবাহন রাজা দের আমলে তৈরী। ভারতীয় নৌসেনা এটি খুঁজে বের করে। এখানে ঘুরে আমরা একটি হোটেলে গিয়ে মধ্যান্নভোজ করলাম।
এরপর আমরা দেখলাম বিশাখা মিউজিয়াম এখানে প্রচুর মডেল যুদ্ধজাহাজ,বিমান, সাবমেরিন ও ক্ষেপণাস্ত্র রাখা আছে যা দেখলে সত্যি শিহরিত হতে হয় উছাড়াও এই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী দের ব্যবহৃত পোশাক, গয়না, পোর্ট্রেট, ম্যানুস্ক্রিপ্ট ইত্যাদি আছে যা থেকে এখানকার ইতিহাসের একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
এরপরই হলো দিনের মুখ্য আকর্ষণ সাবমেরিন মিউজিয়াম বা ” INS Kursura (S20) ” এটি একটি ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন। সাবমেরিন টি 1971 এ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। এই সাবমেরিনের ভেতর ঢুকে পুরোটা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা আজও ভোলার নয়। মনে রাখার বিষয় হলো সোমবার কিন্তু এই বিশাখা মিউজিয়াম ও সাবমেরিন মিউজিয়াম উভয়ই বন্ধ থাকে, তাই টুর প্ল্যান করার সময় সেটা মাথায় রাখবেন। এরপর দিনের শেষ স্পট ছিল ” Lepakshi Handicrafts Emporium “. এটি একটি বিরাট হ্যান্ডিক্রাফট এর মার্কেট, চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন। এরপর কিছুক্ষন সমুদ্রতীরে বস হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম পরেরদিন ভোরে আরাকুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
ভাইজাগ থেকে আরাকু যাওয়ার রেলপথ টি কিন্তু বিখ্যাত, এই সেক্টর টির নাম অনন্তগিরি রিজিয়ন। এই নামটি এসেছে অনন্তগিরি হিলস থেকে। ভাইজাগ থেকে আরাকুর মধ্যে আপনি পাবেন 58 টি টানেল ও 84 টি ব্রিজ । যাত্রীগণ যাতে ভালো ভাবে অপূর্ব এই রেলপথের শোভা উপভোগ করতে পারেন সেইজন্য ভারতীয় রেল এখন কাঁচের ছাদের কোচ বানিয়েছেন। আমরা অবশ্য কিরন্ডুল এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম।
APTDC র আরাকুর রিসর্ট টি নয়নাভিরাম। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা হোটেল লন ও কটেজ। হোটেলে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে প্রকৃতির শোভা দেখছিলাম , এমন সময়ে স্থানীয় কিছু অধিবাসী এসে জিজ্ঞেস করলেন ” বাম্বু চিকেন ” খাবো কিনা ? এটি একটি লোকাল কুইজিন যাতে বাঁশ কেটে তারমধ্যে চিকেন মশলা সহ ঢুকিয়ে রান্না করা হয়। অসাধারণ স্বাদ, অবশ্যই ট্রাই করবেন। সেদিন লাঞ্চে ও ডিনারে বাম্বু চিকেন খেয়েই কেটে গেলো সঙ্গে ছিল লোকাল কফি ও চকলেট।
পরের দিন সাইট-সিয়িং এ বেরিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম ভিউ পয়েন্ট এ যেখান থেকে অনন্তগিরি রেঞ্জ টা অনেকটাই দেখা যায়। সেখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা গেলাম কফি বাগানে। উত্তরবঙ্গে চা বাগান অনেকবার দেখা হলেও কফিবাগানে এই প্রথমবার গেলাম। দেখলাম বড় বড় পেন গাছের মাঝে ছোট ছোট কফি গাছ। সেখান থেকে গরম কফি পান করে ও খানিকটা বাড়ির জন্য সংগ্রহ করে রওনা দিলাম বোরা কেভস এর উদ্দেশ্যে।
বোরা কেভস বা বোরাগুহালু হল আরাকুর মুখ্য আকর্ষণ। সম্পূর্ণ চুনাপাথরের এই বিশাল প্রাকৃতিক গুহা টিতে সারা বছরই প্রচুর মানুষের ভিড় থাকে , তথ্য অনুযায়ী গুহাটি প্রায় কিলোমিটার খানেক লম্বা ও 75-100 মিটার উঁচু। যদিও অতদূর যাওয়া যায় না। গুহাটির মধ্যে প্রচুর প্রাকৃতিক স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট দেখতে পেলাম, অনেক জায়াগায় ছাদ থেকে জল পড়ছে তাই একটা স্যাঁতস্যাঁতে ব্যাপার। পর্যটকদের সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু লোহার প্ল্যাটফর্ম, সিঁড়ি ও লাইটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। অনেক জায়গায় রঙিন লাইট ও লাগানো আছে যাতে সুন্দর ভিউ তৈরী হয়েছে।
বোরা কেভস থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম 7 কিলোমিটার দূরে কাটিকি জলপ্রপাত দেখতে। যদিও এটিকে জলপ্রপাত না বলে ঝোড়া বলাই শ্রেয় তবুও বেশ সুন্দর একটা অনুভূতি হল। সেখান থেকে বেরিয়ে আরাকুর দিকে ফেরার সময় হঠাৎ একটা বাঙালি হোটেল চোখে পড়লো সেখানেই অনেকদিন বাদে মাছ-ভাত দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। ওনারা কথা দিলেন পরের দিন আরাকু স্টেশনে আমাদের জন্য খাবার পৌঁছে দেবেন। পরের স্পট ছিল পদমপুরম গার্ডেন। এটি আরাকুর একটি হর্টিকালচার পার্ক। খুবই সুন্দর সাজানো একটি পিকনিক স্পটের মত। চাকাওয়ালা রাস্তা দিয়ে চলা টয় ট্রেন ও রয়েছে।আমরা এখানে বেশি সময় কাটাতে পারলাম না কারণ আমাদের পরের ও দিনের শেষ স্পট ছিল ট্রাইবাল মিউজিয়াম ও সেখানে নির্দিষ্ট সময় আদিবাসীরা নৃত্য (ট্রাইবাল ডান্স ) প্রদর্শন করেন। দেরি হয়ে গেলে তা শুরু হয়ে যেত। নির্দিষ্ট সময়ে মিউজিয়ামে গিয়ে আদিবাসীদের বিভিন্ন সামগ্রী দেখলাম। নির্দিষ্ট সময়ে নৃত্য শুরু হল। যথেষ্ট ভিড় হয়েছিল। পরেরদিন সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে নির্দিষ্ট সময়ে আরাকু স্টেশনে। পৌঁছে গেলাম। ওই বাঙালি হোটেল থেকে এসে খাবার দিয়ে গেলো। আমরা আবার কিরন্ডুল এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম।বিকেলে পৌঁছে গেলাম জগদলপুর।
জগদলপুরে হোটেল টি ছিল স্টেশন থেকে অটোয় 10 মিনিটের পথ। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রিসেপশনে এসে পরের দিনের জন্য গাড়ি বুক করে ফেললাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম হাঁটাপথে কিছু আছে কিনা তার সন্ধানে।জগদলপুর ব্যস্ত শহর, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, মার্কেটে অনেক ভিড় চোখে পড়লো।আমরা মার্কেটে কিছুক্ষন ঘুরে ও সামনেই অবস্থিত দান্তেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। মূল দান্তেশ্বরী মন্দির কিন্তু বেশ দূরে ও সেটি 52 টি শক্তিপীঠের অন্তর্গত। এটি একটি ছোট মন্দির। তারপর পাশেই অবস্থিত একটি সরস্বতী ও জগন্নাথ মন্দিরে কিছুক্ষন কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
সাইট সিয়িং এর প্রথম স্পট ছিল ” বস্তার প্যালেস ” .জগদলপুর শহরটি ছত্তিসগড় রাজ্যের বস্তার জেলার অন্তর্গত। এটি হল এই জেলার রাজাদের প্রাসাদ। প্যালেস টির মধ্যে নির্মিত মিউজিয়ামে আমরা তৎকালীন রাজাদের পোশাক, ছবি, বিভিন্ন কলসামগ্রী ও আরো অনেক জিনিসের প্রদর্শনী দেখলাম। এর পরে আমরা গেলাম ” তীরথগড় ফলস ” দেখতে।
এটি একটি ছোট জলপ্রপাত কিন্তু বেশ চওড়া। পাথরের ছোট ছোট ধাপ বেয়ে জল নেমে আসছে। তবে তীরথগড় এর মুখ্য আকর্ষণ হল জলপ্রপাতটিকে ঘিরে নির্মিত পার্ক। প্রচুর গাছপালা অনেক লোহার রেলিং ও ব্রিজ দিয়ে নির্মিত এই পার্ক টি। ফটোসেশনের পক্ষে আদর্শ জায়গা।
পরের ভেন্যু একসঙ্গে দুটি। কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক ও কুটুম্বসর গুফা। কুটুম্বসর হল চুনাপাথরের নির্মিত একটি পাথরের গুহা যা কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে অবস্থিত। আমরা গেটের থেকে গাড়ি, গাইড ইত্যাদি ঠিক করে চললাম ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। একদম জঙ্গল সাফারির মোট অনুভূতি হচ্ছিল। ভাগ্য ভাল থাকলে ভারতীয় বাইসনের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে এখানে।
বোরা কেভস এর সাথে কুটুম্বসর এর পার্থক্য হল এই গুহায় কোনো বৈদ্যুতিক আলো বা লোহার সিঁড়ি কিছুই নেই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। লণ্ঠন ভাড়া নিয়ে রীতিমত হামাগুঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হলো। চারিদিক অন্ধকার, ভেতরে ছোট জলধারা বয়ে যাচ্ছে, ওপরের পাথরের ফাঁক দিয়ে অল্প আলো আসছে, স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট তো আছেই , ছোট সাপ ও অনেক ছোট ছোট মাছ ও চোখে পড়লো। মনে হচ্ছিলো অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছি। এর কাছেই কৈলাস গুফা বলে আরেকটি গুহা আছে , প্রায় একইরকম আপনাদের সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন।
এরপর খাওয়া সেরে আমরা রওনা দিলাম আমাদের মূল গন্তব্য ” চিত্রকূট ফলস ” এর দিকে। বেশ খানিকটা দূর থেকেই জলের তীব্র শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সামনে গিয়ে যেন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। তীব্র বেগে বিশাল জলরাশি ভয়ঙ্কর গর্জনে নিচের দিকে নেমে চলেছে , আওয়াজে নিজের গলার আওয়াজই শোনা কষ্টকর।
জলকনায় সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে তৈরী হয়েছে রামধনু। অন্যান্য জলপ্রপাতের সাথে এর পার্থক্য হল অন্য জলপ্রপাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে হয় এখানে রাস্তা গিয়ে নদীতটে মিশেছে। আপনি নদীর তীরে নেমে নিচের দিকে তাকিয়ে জলপ্রপাত দেখতে পারবেন তবে তা করায় যথেষ্ঠ ঝুঁকি আছে। সবচেয়ে ভালো হয় উলটোদিকে তৈরী ভিউ পয়েন্টে রাখা চেয়ারে বসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা। দেখলাম ভিউ পয়েন্ট এই দুর্দান্ত একটি রিসর্ট রয়েছে। রাতের বেলায় হোটেল থেকে জলপ্রপাতের দিকে বড়বড় ফ্লাড লাইট দেওয়া হয় , যাতে সকলে শোভা দেখতে পারেন চিত্রকূট এর। ভিউ পয়েন্টের পাশ দিয়ে পাথরের সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। সেটা দিয়ে নিচে নদীর তীরে নেমে যাওয়া যায়। সেখানে ছোট ডিঙি নৌকো ভাড়া পাওয়া যায় যাতে করে ফলস এর প্রায় তলা পর্যন্ত যাওয়া যায় কিন্তু তাহলে এক সেট অতিরিক্ত পোশাক নিয়ে যাওয়া ভালো কোন ভিজে যাওয়ার আশংকা রয়েছে এবং জলে বেশ স্রোত ও ছিল তাই আমরা ওই ঝুঁকি নিইনি।
আলো থাকা পর্যন্ত ভিউ পয়েন্ট থেকে চিত্রকূট এর শোভা উপভোগ করলাম। তারপর ড্রাইভারের তাড়ায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হল। বউকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আবার এসব ও এলে এই রিসোর্টে এক রাত থাকবোই। হোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি সব প্যাকিং সেরে ফেললাম ও খাওয়া সেরে সব বিল মিটিয়ে দিলাম। সেদিনের ড্রাইভার দাদা কে বলাই ছিল উনি পরদিন পৌনে চারটেয় এসে আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। আমরা একরাশ দুর্দান্ত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরে এলাম।
___________________________________ সমাপ্ত _________________________________