বাগানে বসন্ত

প্রোজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায়
5 রেটিং
1068 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 3 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

” এই দিনটি আমার জীবনে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমার কোচিং কেরিয়ারের অন্যতম সেরা দিন আজ।”         কিবু বিকুনিয়া (মোহনবাগান কোচ)
1911 সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে খালি পায়ে লড়াই করে ব্রিটিশ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে পরাধীন ভারতে স্পর্ধার তুফান তোলা থেকে শুরু করে 2020 সালের আই লিগে চাম্পিয়ন হওয়া, – শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবের  মুকুটে সাফল্যের পালক অগুনতি।

তবুও কেন আলাদা এবারের আই লিগের এই অবিশ্বাস্য সাফল্য? কেনই বা ভারতের একটি টুর্নামেন্ট জয়কে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন হাই প্রোফাইল স্প্যানিশ কোচ কিবু? কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় কিবু বদলে দিলেন বাগান ড্রেসিংরুমের আবহাওয়া? উত্তর খুঁজতে হলে পুরো মরসুমের ঘটনাপ্রবাহে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।               এটা ঠিকই যে, আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া মোহনবাগানের কাছে নতুন কিছু নয়। জাতীয় লিগ ও আই লিগ মিলিয়ে এর আগেও চারবার খেতাব ঢুকেছে গোষ্ঠ পাল সরণির তাঁবুতে। পার্থক্য এটাই যে, এবারের মত অবিশ্বাস্য দাপট মোহনবাগান কোনবারই দেখাতে পারেনি। শুধু মোহনবাগান কেন, লিগের ইতিহাসে কোনও দলই চার ম্যাচ বাকি থাকতে শিরোপা লাভ করেনি। তাহলে কি মন্ত্রে এই চোখ ধাঁধানো সাফল্য উপহার দিলেন কিবু ও তাঁর ছেলেরা? কৃতিত্ব কিছুটা পাবেন কর্মকর্তারাও। মরসুমের শুরুতে কলকাতা লিগ সহ একাধিক টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও কোচ ও ফুটবলারদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরা। ময়দানি ট্র্যাডিশন মেনে ছাঁটাই এর রাস্তায় যাননি। মরসুম শেষে তাঁরা প্রমাণ করলেন, ধৈর্যের ফল মিষ্টিই হয়। 
            যে কল্যাণী স্টেডিয়ামে আইজল বধ করে ভারতসেরার ট্রফি তুললেন সুহের, পাপারা, সেই স্টেডিয়ামেই লিগের প্রথম পর্বে চার্চিলের কাছে 4-2 ব্যবধানে হেরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল সবুজ মেরুন ড্রেসিংরুমে। উত্তাল ‘ গো ব্যাক ‘ ধ্বনির মধ্যে দিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন কিবু। অথচ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সেই কিবুকে নিয়েই ধন্য ধন্য রব মোহন জনতার। মোহনবাগানের এই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা স্প্যানিশ কোচের বিশেষত্ব হল, নিজের ঘরানার প্রতি অফুরন্ত আস্থা এবং নমনীয়তা। মরসুমের শুরুতে কলকাতা লিগে রানার্স অবধি হতে পারেননি বেইতিয়ারা। বাংলাদেশে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ও ব্যর্থ হয় বাগান। আইলিগের শুরুটাও হয় খাবি খেতে খেতে। অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও কিবু বিশ্বাস হারাননি নিজের প্রতি, দলের প্রতি। মাঝমাঠে জোসেবা বেইতিয়ার উপরেই ভরসা রেখে গেছেন তিনি। যার প্রতিদান জোসেবা দিয়েছেন ম্যাচের পর ম্যাচ দলের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে, বিশেষত ডার্বি ম্যাচে লাল হলুদ ব্রিগেডকে নাকে দড়ি দিয়ে যেভাবে ঘুরিয়েছেন, বাগান ভক্তেরা সহজে তাঁকে ভুলতে পারবেন না। আশুতোষ মেহতা, নৌদেম্বা নাওরেম, ধনচন্দ্র, ভিপি সুহের, শেখ সাহিল, শুভ ঘোষ, কিয়ান নাসিরি, সহ একঝাঁক দেশীয় তরুণ তুর্কির উপর আস্থা রেখেছিলেন সাতচল্লিশ বছরের এই স্পেনীয়। তাঁদের তৈরি করেছেন যত্ন করে। মরসুম শেষে এই তরুণ ব্রিগেড ট্রফি নামক গুরুদক্ষিণা উপহার দিল প্রিয় কোচকে। আদ্যন্ত পেশাদার এই কোচ কখনোই ক্লাবের আগে নিজের স্বার্থ রাখেননি। তাই নিজের আনা সালভা চামোরো সফল হতে পারছেন না দেখে তাঁকে সরিয়ে সেনেগাল স্ট্রাইকার পাপা বাবাকার দিওয়ারাকে নিতে দুবার ভাবেননি। এমনকি বাবা যখন প্রথম দুই ম্যাচে গোল পেলেনই না, তখনও কিবু ছিলেন লা লিগা ফেরত এই স্ট্রাইকারের পাশেই। জানতেন, বাবা ফর্মে ফিরলে একাই পৌঁছে দিতে পারেন খেতাবের দোরগোড়ায়। মরসুম শেষ হতে আরো চার ম্যাচ বাকি। ইতিমধ্যেই দশ গোল করে কোচের আস্থার মর্যাদা দিতে ভুল করলেন না ইউরোপের একাধিক লিগের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই আফ্রিকান স্ট্রাইকার। অন্য বিদেশি কোচেরা যখন লং বল টেকনিকে গুরুতে দেন, কিবু আঁকতে থাকেন পাসের শিল্প। পাস, পাস আর পাস, কিবুর ফুটবল দর্শন একান্তই তিকিতাকা নির্ভর। শিক্ষকের দেখানো পথে হেঁটে পাসের ফুলঝুরি ফোটাতে ভুল করেননি মোহন ফুটবলাররা। চার্চিল ম্যাচে 23 পাসের গোল তো ফিফার কাছেও বাড়তি তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। কলকাতা ময়দানে আধুনিক কোচিং এর স্বাদ নিয়ে এসেছেন তিনি, যাঁর পরিকল্পনা কখনোই ট্রফি কেন্দ্রিক হয় না। ম্যাচ বাই ম্যাচ রণনীতি, যা বর্তমান ফুটবলের মূল দর্শন, কলকাতায় হাজির করলেন কিবুই। প্রতিপক্ষের চুলচেরা বিশ্লেষন, সেই মত রণনীতি ঠিক করা আধুনিক ফুটবলের ধর্ম। মোহনবাগানের সাফল্য সেই আধুনিক ফুটবলের জয়গান রচনা করে। এ বছরের মোহনবাগান অসম্ভব গুরুত্ব দিয়েছে সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী এবং ভিডিও অ্যানালিস্ট নীতিশ কেও। ইস্টবেঙ্গলে ছয় বছর সহকারী থাকা সত্ত্বেও তেমন পাত্তা পেতেন না রঞ্জন। অথচ ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একের পর এক ম্যাচে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে গিয়েছেন মোহনবাগান কোচ। সেই স্ট্র্যাটেজি মরসুম শেষে সুপার হিট। নীতিশ ও নিজেদের এবং অন্যান্য দলের ভিডিও বিশ্লেষন করে তাঁকে দিতেন, সেই অনুযায়ী চলত কোচের হোমওয়ার্ক।

সঙ্গে মোহনবাগান কোচের বড় গুণ তাঁর তুখোড় ম্যান ম্যানেজমেন্ট। স্বদেশী বনাম বিদেশি, সিনিয়র বনাম জুনিয়র, কোনও দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেয়নি তাঁর আমলে। প্রথম দলে থাকা শঙ্কর বা সুহের যেমন কোচের পরামর্শ পেয়েছেন, তেমনই শিলটন বা চুলোভার মত প্রথম দলের বাইরে থাকা ফুটবলাররাও কোচের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হননি। তাই তো বাবার গোলে উল্লাসে ফেটে পড়েন রিজার্ভ বেঞ্চে থাকা শুভ। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ ঠিক থাকা মোহনবাগানের সাফল্যের অন্যতম কারণ।          একটা সময় পর্যন্ত মোহনবাগানের নীতি ছিল ভারতের মাটিতে খেলা পরীক্ষিত বিদেশি দেরই নেওয়া। হোসে রামিরেজ ব্যারেটো অবশ্যই ব্যতিক্রম। তবে ওডাফা থেকে মার্কোস, ডু থেকে বেলো রাজাক, দিপান্দা দিকা থেকে সনি নর্দে (বাংলাদেশের শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে আইএফএ শিল্ডে খেলে পূর্বেই কলকাতার নজর কেড়েছিলেন), সবার সাথেই পূর্বেই পরিচিত ছিল ভারতীয় ফুটবল। অথচ এবার সেই নীতি থেকে সরে এসে কোচের পছন্দ অনুযায়ী বিদেশি রিক্রুট করেছেন কর্তারা। কোচের পছন্দের ফ্রান গঞ্জালেস, ফ্রান মোরান্তে, জোসেবা বেইতিয়া সকলেই ফুল ফুটিয়েছেন বাগানের উর্বর ভূমিতে। মরসুমের শুরুতে আসা স্ট্রাইকার সালভা চামোরো যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু এক স্ট্রাইকারে খেলার লোড নিতে পারতেন না, গোলমুখে এসে খেই হারিয়ে ফেলতেন।জোসেবা বেইতিয়া থাকায় মোহনবাগানের সাপ্লাই লাইন দুরন্ত ছিল, অভাব ছিল একজন গোলগেটারের। চামোরো সেই কাজটি ঠিকঠাক পারছিলেন না। বুদ্ধিমান কোচ দেরি না করে সেনেগালের বাবা দিওয়ারাকে সই করান চামোরোর জায়গায়। লিগের মাঝপথে দলে আসা বাবা বাকি ম্যাচগুলোতে ঝড় বইয়ে দেন বিপক্ষের রক্ষনে। চেন্নাই সিটি এফসি কোচ আকবর নওয়াজের মতে, মোহনবাগানের আচমকা বদলে যাওয়া চেহারার মূল কারিগর এই লা লিগার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সেনেগালিজ স্ট্রাইকারই। পড়শী ক্লাবে যখন লাগাতার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও কোলাডোরা শুধুমাত্র কোচের আশীর্বাদের ফলে থেকে যান, মোহনবাগানে সেরকম হল না কারণ, দলের প্রয়োজনের সময় কিবু নিজের ইগো ধরে থাকেননি। তাই নিজের পছন্দের চামোরোকেও সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। অবশ্য শুধু বাবা নন, বাকি বিদেশীরাও কেউ কারোর থেকে কম যান না। মাঝমাঠ থেকে দলকে খেলানোর মূল ভূমিকা পালন করেন শিল্পী মিডফিল্ড জেনারেল জোসেবা বেইতিয়া। ভারতে আসা বেশিরভাগ বিদেশি ফুটবলারই শরীর নির্ভর খেলতে অভ্যস্ত, কারণ ভারতীয় ফুটবলের যা ধরন, তাতে এটাই চাহিদার মূল বিষয়। বেইতিয়া সেদিক দিয়ে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই বলপ্লেয়ারটি মাঝমাঠ থেকে পাসের ফুলঝুরি জ্বালিয়ে মাঠ নিয়ন্ত্রণ করায় বিশ্বাসী। এবং তাঁর বাড়ানো বল থেকেই গোলের পর গোল করে গেছেন বাবা। বেইতিয়া নিজেও জালে বল ঢোকানোয় কম যান না, বিশেষত ডেডবল সিচুয়েশনে ভয়ঙ্কর  স্পানিশ। রক্ষণ সামলানোর সাফল্যের সঙ্গে নটা গোল ও সঙ্গী ফ্রান গঞ্জালেসের। ফ্রান মোরান্তে ও তাঁর সঙ্গী ডিফেন্ডার ড্যানিয়েল সাইরাস রক্ষণে নেতৃত্ব দানেও সমান পারদর্শী। মাঝপথে দলে ঢোকা তুর্সুনভ ও সাপোর্টিং স্ট্রাইকার হিসেবে চমৎকার খেলে গেলেন। বিদেশি রিক্রুট এর ক্ষেত্রে দুরন্ত ভূমিকা নিয়েছেন মোহন কর্তারা। 


          প্রশংসা প্রাপ্য বাগান কর্তাদের ও। স্পনসর ছাড়াই এমন সুন্দর একটা দল তৈরি করে খেতাব জয় যথেষ্ট শিক্ষণীয়। মরসুমের শুরুর খারাপ পারফরম্যান্সের পরও কিবুর উপরে আস্থা রেখে তাঁর ও তাঁর ফুটবল দর্শনের পাশে দাঁড়ানো কর্তাদের মাস্টারস্ট্রোক। ডিসেম্বরের ট্রান্সফার উইন্ডো থেকে বাবা অথবা তুর্সুনভকে সিলেক্ট করাও প্রশংসার দাবি রাখে। বস্তুত, আই লিগে মোহনবাগানের মত দলের সমর্থকদের সবসময়েই চাহিদা থাকে তুমুল সাফল্যের। একটু এদিক ওদিক হলেই তাঁরা গেল গেল রব তোলেন। মরসুমের শুরুতে লাগাতার ব্যর্থতার পরে কিবুকে সরানোর দাবিও উঠেছিল। মোহন কর্তাদের অভিনন্দন প্রাপ্য এই জন্য যে, তাঁরা চাপের কাছে মাথা নত না করে আস্থা রেখে গেছেন কোচ ও খেলোয়াড়দের উপর।  সময় পেতেই ময়দানের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন খেলোয়াড়েরা আর বাগানে বসন্ত এনেছেন কিবু। ফল? চার ম্যাচ বাকি থাকতেই আই লিগের গন্তব্য গোষ্ঠ পাল সরণি। ভারতীয় ফুটবলে আরেকটি নজির গড়ল শৈলেন মান্না, চুণী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য, হোসে ব্যারেটোদের মত ফুটবলারদের জন্ম দেওয়া মোহনবাগান। 


                 এই বসন্তে ভারতীয় ফুটবলের রং? কি আবার? সবুজ মেরুন!

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Niloy April 1, 2020 at 9:15 pm

    nice

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল