চিত্র এক। খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ছশো বছর পূর্বের বর্তমান ইরান ইরাক সংলগ্ন এক স্থান। আসিরীয় সভ্যতার এক অনুষ্ঠান চলছে। নৃপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন রাজা আসুরবানিপাল। চারিদিকে রাজবন্দনা। উৎসবের আবহে রঙিন পরিবেশ।
চিত্র দুই। ওল্টানো যাক ঋগবেদের পাতা। হঠাৎ করেই অসুর শব্দটির দিকে চোখ পড়ে গেল। কি আশ্চর্য! এ তো দুর্গার অস্ত্রের আঘাতে আহত রক্তাক্ত কোন অশুভ চরিত্র নয়। হিন্দু ধর্ম ও দর্শনের এই আদি গ্রন্থ তো বলছে সম্পূর্ণ উল্টো কথা। ক্ষমতাশালী পুরুষ মাত্রেই অসুর উপাধি প্রাপ্ত। দেবতারা, এমনকি, ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি ও নাকি অসুর। এমনকি খোদ সূর্যদেব কেও নাকি করে ফেলা যায় অসুর ক্লাবের সদস্য।
চিত্র তিন। চলে আসা যাক ২০১৯ সালে। ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অখ্যাত গ্রামে। দুর্গাপূজার চারদিন এখানে অরন্ধন পালিত হচ্ছে। নবমীর দিনে এই শোক পালনের মাত্রা সবথেকে বেশি। কারণ, এই দিনটি এইসব গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে কালা দিবস। ভাবছেন, এ আবার কোন গ্রাম? আছে, এমন গ্রাম ও আছে। এই গ্রামের বাসিন্দারা অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ।
একটি বিষয়ে আলোচ্য নিবন্ধকার নিশ্চিত। উপরোক্ত তিনটি চিত্র বহু পাঠককেই ধাঁধায় ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে। এবার খোলসা করে বলাই যাক। উপরোক্ত তিনটি চিত্র এবং আরও বহু টুকরো টুকরো ঐতিহ্য এবং আচার অনুষ্ঠানের বিশ্লেষন করে বেশ কিছু ঐতিহাসিক এক বৃহত্তর চিত্রের অনুসন্ধান করেছেন। সেটি হল, লোককথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অনুসন্ধান। আলোচ্য নিবন্ধের উদ্দেশ্য ও সেটিই। ফিরে যাওয়া যাক খ্রীষ্টের জন্ম পূর্ববর্তী মধ্যপ্রাচ্যে।
পূর্বেই যে আসিরিয় রাজা আসুরবানিপালের উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর পরিচয় সম্বলিত একটি শিলালিপি উদ্ধার করা হয়েছে, যাতে প্রাচীন কিউনিফর্ম লিপিতে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে। শিলা খণ্ডটি বর্তমানে লন্ডনের জাদুঘরে সযত্নে রক্ষিত। এই রাজাকে প্রজাপালক হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে সেই শিলালিপিতে। রাজার চারপাশে বেশ কিছু মহিষের ছবি বিদ্যমান। বহু পণ্ডিতের মতে, মেসোপটেমিয়ার এই আসিরীয় সভ্যতাই হল পুরাণে বর্ণিত অসুর রাজ্য। রাজার নামে অসুর বা আসুর শব্দের অস্তিত্ব এবং শিলালিপিতে মহিষের উপস্থিতি তাঁদের এই সন্দেহের ভিত্তি। মধ্যপ্রাচ্যের ই প্রাচীন ধর্ম হল জরাথুষ্ট্রবাদ, বর্তমানে যা পার্সি ধর্ম নামে পরিচিত। এই ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘ জেন্দ আবেস্তা’ তে দেবতা আহুর মাজদা বা আশুর মাজদার কথা বর্ণিত আছে। জার্মানির বিখ্যাত ভারত গবেষক ম্যাক্সমুলারের মতে, আসিরীয় সভ্যতার অসুর, আহুর মাজদার অসুর এবং ঋগবেদের অসুর এক সূত্রে গাঁথা। যেহেতু মনে করা হয় যে, ভারতের আর্য দের ই আরেকটি শাখা মধ্যপ্রাচ্যের আর্যরা, এই মতের সমর্থক সংখ্যা প্রচুর। অর্থাৎ, এই মত অনুযায়ী অসুর বা মহিষাসুর কোনও পৌরাণিক চরিত্র নন, বরং তাঁকে বলা চলে আধা ঐতিহাসিক চরিত্র। আমরা সকলেই ঋগবেদের আপাত কঠিন অবয়বের চেয়ে ঢের বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি রামায়ণ মহাভারতের ঘরোয়া আখ্যানে। কিন্তু, অসুরকে নিয়ে এই দুই মহাকাব্যের হাবভাব ও ঋগবেদের থেকে খুব একটা আলাদা নয়।
এদের পাতা উল্টোলে আবার দেবতা এবং অসুরদের বৈমাত্রেয় ভাই হিসেবে দেখা যায়, যাদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। বাঙালি যৌথ পরিবারে যা হয় আর কি! কিন্তু তাই বলে আবার অসুরদের অশুভ ও বলা হয় নি। কি আশ্চর্য, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের শ্বশুরমশাই পুলোমাই যে একজন অসুর হিসেবে চিহ্নিত। অসুররুপী শ্বশুর তাঁর দেবরাজ জামাই কে জামাই ষষ্ঠীতে কিভাবে আপ্যায়ন করতেন সে বর্ণনা মহাকাব্যে নেই বটে, তবে দেবতা ও অসুর বাহিনীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের অস্তিত্ব বোঝাই যায়। ভক্ত প্রহ্লাদের পিতা হিরণ্যকশিপু ও অসুর হিসেবেই বর্ণিত। এরকম আরো বহু চরিত্রের উল্লেখ আছে। টুকরো টুকরো বিষয়গুলিকে ঋগবেদের সুতোয় গাঁথা হলে সেই অসুর শব্দটির অর্থ হিসেবে শক্তিমান পুরুষ, এই যোগফলই বেরিয়ে আসবে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, তাহলে তো বৈদিক বা মহাকাব্যিক চরিত্র অসুরের সাথে বর্তমানে দুর্গাপূজার সংস্কৃতির কোনও মিল ই নেই। এর উত্তর দিতে পারে আর্য অনার্যের সাংস্কৃতিক মিশ্রণে সৃষ্ট ভারতীয় পুরাণ এবং ইতিহাস। উত্তর খুঁজতে আমাদের ভারতের আনাচে কানাচে ঘুরতে হবে। মহীশূর থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে সোজা আলিপুরদুয়ার। পূর্বেই উল্লিখিত তিন নম্বর চিত্রে অসুর উপজাতির উল্লেখ ছিল। সেই কথায় আসব এবার। এই উপজাতি নিজেদের সরাসরি মহিষাসুরের বংশধর বলে দাবি করেন এবং বহির্জগতের উদ্দেশ্যে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান যে, তাঁদের পূর্বপুরুষ, অসুর রাজাকে বিজাতীয় সংস্কৃতির বাহকেরা ছলবলের দ্বারা নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। প্রসঙ্গত, এই পর্বের গবেষকরা উপজাতি এবং পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে অবিশ্বাস্য মিল খুঁজে পেয়েছেন, অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে, এর সাথে মিশে যায় ভারতের ইতিহাস এবং প্রাচীন কিংবদন্তি।
ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় বসবাসকারী অসুর উপজাতির মানুষেরা দাবি করেন, তাঁদের প্রাচীন রাজা প্রজাপালন এবং মানবিকতার জন্য চরম জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাঁদের প্রাচীন পেশা ছিল লোহার সামগ্রী নির্মাণ এবং এঁদের মতে, এই শিল্পের শ্রেষ্ঠতম কারিগর ছিলেন তাঁদের অসুররাজ। পাঠক নিশ্চিত হেসেই ফেলেছেন। রাজা আবার লোহার কারিগর? যেখানে মহিষাসুরের দাপটে দেবতারাও স্বর্গ ছাড়া হতে বাধ্য হন? তাঁর তুলনা লোহার কারিগরদের সঙ্গে? তাহলে আরেকটা ছোট্ট তথ্য যোগ করা যাক। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দাবি করে যে, প্রাচীন মগধ এবং পাটলিপুত্র নগরে মৌর্য এবং গুপ্ত আমলে অসুর উপজাতির মানুষেরাই লোহার কাজ করতেন এবং তা ছিল উৎকৃষ্ট মানের। সেই আমলের বহু লৌহ স্থাপত্যে আজও মরচে পড়েনি। এই ঐতিহাসিক তথ্য মাথায় রাখলে অসুররাজের লোহার কারিগরির তথ্য আর আজগুবি মনে হয় না। যাই হোক, ফেরা যাক মূল কাহিনীতে। তো সেই জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী অসুর রাজ চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেন আর্যদের। তখন অসুররাজকে বিপাকে ফেলতে আর্যরা আশ্রয় নেন সেই বহু পরীক্ষিত নীতির। কি আবার? এক সুন্দরী মহিলা। কবি বলেছেন, “প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে”, কিন্তু তিনি কি আর জানতেন যে, প্রবল প্রতাপশালী অসুর রাজাও এই ফাঁদেই পা গলিয়ে বসেছেন? অতঃপর, প্রেম এবং কামের ফাঁদে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকেন রাজামশাই, সুন্দরীও খেলাতে থাকেন তাঁকে। তারপর, এক মিলন মুহূর্তে রাজার উপর চড়ে বসেন সুন্দরী, অতঃপর ছুরিকাঘাত ও রাজার মৃত্যু।
আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জনৈক অনিল অসুর দাবি করেছেন যে, ছলে বলে অসুর রাজাকে খুন করার আগে সেই সুন্দরী নাকি তাঁকে লোহার অস্ত্রগুলি মাটিতে পুঁতে রাখতে বলেছিলেন, প্রেমিক রাজা সেই মতই কাজ করেছিলেন। অসুরদের মতে, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের গুমলায় অনুষ্ঠিত হয় এই হত্যাকাণ্ড। প্রসঙ্গত, গুমলা র কাছে জঙ্গলের মধ্যে মাটি খুঁড়ে সত্যই প্রাচীন অস্ত্রের সম্ভার মিলেছিল একবার। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নেই। যদি ভারতের উপজাতি গুলির অন্দরমহলে খোঁজ নেওয়া যায় , তাহলে দেখা যাবে, শুধু অসুর নয়। সাঁওতাল, মুন্ডা সহ প্রায় সব উপজাতির নিজস্ব লোকগাথা এই জনপ্রিয় রাজার প্রেমের ফাঁদে পড়ে অকালমৃত্যুর তত্ত্বকে সমর্থন করে। এই প্রসঙ্গে সাঁওতাল দের বিখ্যাত হুদুর দুর্গা উৎসবের উল্লেখ করা যেতে পারে, যার মূল কথা হল হারিয়ে যাওয়া রাজার সন্ধান এবং তাঁর জয়গাথা। অনিল অসুর যদিও ঝাড়খণ্ডের গুমলার উল্লেখ করেছেন, বহু মানুষের মতে, দুর্গা এবং মহিষাসুরের সংঘর্ষের স্থান হল বর্তমান কর্ণাটকের মহীশূর। মহিষাসুর কথাটিই বিবর্তিত হয়ে মহীশূর রূপ ধারণ করেছে মনে করা হয়। তো সেই মহীশূরের অসুর মূর্তি কিন্তু মোটেই পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজার মত রক্তাক্ত নয়। মোটা গোঁফ সম্বলিত এক হাতে সর্প এবং অন্য হাতে অস্ত্র ধরে রাখা এক দয়ালু রাজার। আর্য এবং অনার্য দ্বন্দ্ব এবং এক প্রাচীন কিংবদন্তীর দুরকম ব্যাখ্যা স্পষ্ট হচ্ছে না কি? প্রসঙ্গত, দশমীর দিনে যে মহিষাসুর বধ করা হয় বলে মনে করা হয়, তাতে সায় আছে উপজাতি দেরও। এই স্মৃতি তেই তাঁরা নবমীতে অশৌচ পালন করেন, রাজার মৃত্যুর শোক পালনের উদ্দেশ্যে। শুধু তাই নয়, অসুর উপজাতির মানুষেরা দীপাবলির দিন নাকে, বুকে আর নাভিতে করঞ্জী ফুলের তেল ও লাগান, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন এই তিন জায়গা থেকেই রক্ত ঝরেছিল তাঁদের পূর্ব পুরুষের। এই উপলক্ষ্যে শশা খাওয়াও বাধ্যতামূলক, কারণ তাঁদের সংষ্কৃতি অনুযায়ী শশা হল সেই ছলনাময়ী নারীর প্রতীক।
আমরা যদি মহালয়ার দিনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ খুব নিবিড় ভাবে অনুসরন করি, এই একই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ঘটনা যে কিছু একটা ঘটেছিল, তা স্পষ্ট হতে দেরি হয় না। অসুরদের মতই শ্রীশ্রী চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ীও দেবী দুর্গার আবির্ভাবের পিছনে মহিষাসুরের দাপট এবং দেবতাদের বিপন্নতা কেই কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যা ভিন্ন আঙ্গিক সত্ত্বেও উপজাতি গুলির বক্তব্যের থেকে খুব আলাদা নয়। ছলনাময়ী দুর্গার অস্তিত্ব যদিও আমরা মেলাতে পারি না, দাপুটে অসুর নিধনকারি দুর্গাকে দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু, কিছু কিছু দৃশ্য মনে চিন্তার খোরাক জোগায়। যার একটি হল দুর্গার মোহিনী অবয়ব, যখন সুরাপাত্র হাতে নিয়ে উচ্ছল দুর্গা যুদ্ধে আহ্বান জানান মহিষাসুরকে। অসুর উপজাতির মানুষেরা ও এমনই মোহিনী দুর্গার কথা বলেন, আহ্বানের কোথাও বলেন, তবে যুদ্ধের নয়, প্রেমের। আরেকটি দৃশ্যের কথাও উল্লেখ্য। অসুরের হত্যা দৃশ্য।
শ্রী শ্রী চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, অসুরের শরীরের উপর চড়ে বসে দুর্গা হত্যা করেন তাঁকে। এই শরীরের উপর উঠে বসা যেমন সংঘাতের দৃশ্য হতে পারে, তেমনই হতে পারে উদ্দাম প্রেমের। অর্থাৎ, তলিয়ে দেখলে দুই সংস্কৃতির দুই কাহিনীর মধ্যে অবিশ্বাস্য মিল পরিলক্ষিত হচ্ছে, আঙ্গিকটিই কেবল ভিন্ন। আলোচনার শেষে আবার সামনে চলে আসে সেই তিনটি চিত্র। তিনটি চিত্রের যোগফলে সামনে আসে সেই আদি আর্য অনার্য দ্বন্দ্ব এবং তাতে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আর্যদের জয়। বাঙালি হিসেবে আমাদের মনে দুর্গার যে ইমেজটি আছে, তার বিপরীত ইমেজটি বিশ্লেষন করলে এবং দুটির একত্রে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই প্রাচীন কিংবদন্তীটি যে আর্য অনার্য দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি, তার আভাস পাওয়া যায়। কে শুভ, কে অশুভ, কে ভালো, কে মন্দ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তার হদিস পাওয়া হয়ত পুরোপুরিভাবে সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক এবং সাহিত্য সমালোচক চিনুয়া আকেবে দাবি করেছিলেন যে, ইতিহাস বরাবরই জয়ীরাই রচনা করেন এবং তাঁদের নিজেদের স্বার্থ মাথায় রেখে। হয়তো তাইই প্রাচীনকালের আর্য অনার্য দ্বন্দ্ব বর্তমানে শুভ অশুভের লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে।
তথ্যসূত্র:-
১। চণ্ডীপাঠ। ভাষ্যে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
২। Ancient Indian Social History। অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার।
৩। আনন্দবাজার পত্রিকা।
চিত্র সৌজন্য : গুগল