অম্বুবাচী

প্রোজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায়
5 রেটিং
976 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

অম্বুবাচী: ধর্মীয় লৌকিকতার আড়ালে নারীশক্তির জয়গান

পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মই কমবেশি পিতৃতান্ত্রিক, কমবেশি প্রায় সব ধর্মেই নারীদের অবহেলার শিকার হতে হয়, এই ধারণা প্রায় সর্বত্রই। কিন্তু, এই পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনের মধ্যেই কিছু ধর্মীয় লোকাচার এখনও টিকে আছে, যা সমাজে নারীর অবদানকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নেয়, অম্বুবাচী যার অন্যতম।

              কৃষিতান্ত্রিক দেশ আমাদের। শুধু আজ বলে নয়, বরাবরই। ভারত, বিশেষত বঙ্গদেশ সহ সমগ্র পূর্ব ভারতে লৌকিক উপাচার যে কৃষিভিত্তিক হবে এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। নবান্ন, পৌষ পার্বণ থেকে রাম নবমী, বাংলায় প্রচলিত হিন্দু লোকাচার উত্তর ভারতীয় সাবেক হিন্দু আচার অনুষ্ঠানগুলোর থেকে অনেকটাই পৃথক। অম্বুবাচী হল এমনই একটি পূর্ব ভারতীয় হিন্দু উপাচার। যদিও প্রথাটির গভীরে গেলে বোঝা যায়, এটি যতটা না ধর্মীয় আচার, তার থেকেও বেশি লৌকিক।

               পিরিয়ড বা মাসিক! ২০২০ সালের ভারতেও তা অত্যন্ত গোপনীয় এক বিষয়। কতই বা ঢাকঢাক গুড়গুড়! হাল আমলে ভারতের তথাকথিত সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত রাজ্য কেরলের শবরীমালা মন্দিরে রজঃক্ষমা নারীদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি চাইতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত ছুটতে হয়েছে, সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের প্রবেশাধিকার দিলেও নানা ছুতোয় তাঁদের প্রবেশ আজও নিয়ন্ত্রিত। সাধারণ মানুষের চোখে পিরিয়ড বা মাসিক এক দূষিত শারীরিক প্রক্রিয়া, পিরিওড চলাকালীন মহিলারা তাই অশুচি! সেজন্য দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও দেওয়া হয় কাগজে মুড়ে, যেন তা এক নিষিদ্ধ বস্তু। আধুনিক পৃথিবীতে এই অবিশ্বাস্য নেতিবাচক ধারণা থাকলেও বরাবর মোটেই তেমন ছিল না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বরং উল্লেখ আছে, বাড়ির মেয়েদের মাসিকের ক্ষমতা অর্জন হলে সময়টি  কিরকম আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করা হত। এককথায় বলা যায় যে, মাসিকের আবির্ভাবে অপার আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। প্রসঙ্গত, তখন বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা এই ক্ষমতা অর্জন করত পতিগৃহেই। তাতে কি! স্বামী সহ তার পুরো পরিবারই আনন্দে মেতে উঠত। বর্তমান বাংলায় যদিও বা এখন এই অত্যন্ত স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াটিকে খাটো নজরে দেখা হয়, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাডুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এই পারিবারিক উৎসবের দেখা মেলে। আলোচ্য নিবন্ধে এবিষয়ে এত কথার কারণ একটাই! অম্বুবাচী নামক উৎসবের জন্ম মধ্যযুগে,এবং তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নারীদেহের মাসিক প্রক্রিয়া। 

            ভারতীয় সমাজে পৃথিবীর একটি মাতৃ রূপ বরাবরই বিদ্যমান। পৃথিবী বা প্রকৃতি মাতৃরূপেই চিহ্নিত হন। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সৌজন্যে কৃষকেরাও জমি তথা প্রকৃতির হাবভাব সমঝেই বরাবর তাঁদের কাজ করে এসেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকের নজর এড়ায়নি যে, বর্ষাকাল অর্থাৎ, মৌসুমী বায়ুর আগমনের পরে মাটি যখন সুজলা হয়ে ওঠে, তখনই সে সুফলা হয়। অর্থাৎ, বর্ষা আগমনের পরেই মৃত্তিকার সৃষ্টির ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এখানেই চলে আসে মানুষের জনন প্রক্রিয়ার সাথে ফসল উৎপাদন পদ্ধতির তুলনা। মাটি বা পৃথিবী যদি মাতৃরূপ হয়, সেই মাতৃরূপের সৃষ্টিক্ষমতা সর্বাধিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় বর্ষাকালেই। 

            প্রবল গ্রীষ্মের পর বর্ষার আগমনে জমি যখন হয়ে ওঠে সিক্ত, কৃষক তথা সাধারণ মানুষ এই সময়টিই পৃথিবী মাকে রজঃস্বলা হিসেবে কল্পনা করে নেন। অম্বুবাচীর আগমনের সময়কাল হিসেবে নানা ধর্মীয় ব্যাখ্যা থাকলেও সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ সেসব নিয়ে মাথা ঘামান না। বাংলা প্রবাদ আছে, ” কিসের বার কিসের তিথি, আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী”। অর্থাৎ, বর্ষার প্রারম্ভেই আষাঢ়ের সাত তারিখ থেকে চারদিন ধরে চলে অম্বুবাচী উদযাপন। মহিলা মাত্রই জানবেন, ঠিক একটি মাসিক প্রক্রিয়ার সময়কাল অনুযায়ীই এই সময়কাল ধার্য করা হয়েছে। এই চারদিন কোনও কৃষিকাজ হয় না, কারণ এই চারদিন পবিত্র, যেকারনে এই দিনগুলোয় পৃথিবী মাকে কর্ষণ করতে নেই। ঠিক যেমন মাসিক কালীন শারীরিক সম্পর্ক ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়, পৃথিবী নামক নারীর ক্ষেত্রেও সেই সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। মাসিকের প্রভাব কেটে যাওয়ার পরের দিনগুলি যেমন নারী শরীরের পক্ষে অত্যন্ত উৎপাদনক্ষম, ঠিক তেমনি অম্বুবাচী পরবর্তী সময়, অর্থাৎ বর্ষাকাল ফসলের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট সময়। কৃষিজীবীরা সেকারণেই পুরুষাঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেন লাঙলকে। পুরুষাঙ্গের সঙ্গে স্ত্রী অঙ্গের মিলনে যেমন সন্তানের সৃষ্টি হয়, সেরকমই জমিতে লাঙল কর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ফসল সৃষ্ট হয়। প্রাণ সৃষ্টির চিরাচরিত দুই প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে আদতে নারীশরীর এবং তার পবিত্রতাকে উদযাপন করে অম্বুবাচী উৎসব। এই লৌকিক কৃষিভিত্তিক উপাচার পরবর্তীকালে স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই ধর্মীয় রূপ পায় এবং অবশ্যই মাতৃ পূজার সাথেই সম্পৃক্ত হয়। বর্তমানে এই উৎসব সর্বাপেক্ষা জাঁকজমক সহকারে উদযাপিত হয় অসমের কামাখ্যা মন্দিরে। মন্দিরের গর্ভগৃহ, যা আদতে একটি প্রাকৃতিক গুহা, থেকে এসময় একধরনের রক্তাভ জলধারা নির্গত হয়, যেটিকে পৃথিবী নামক মাতৃরূপের রজঃক্ষরণ বলে ধারণা করা হয়। ভূবিশারদদের মতে, নতুন বর্ষার জলে পাহাড়ের লাল মাটি মিশেই এই জলধারা সৃষ্টি হয়, তবুও ভক্তি আর কবে যুক্তির কথা শুনেছে! যদিও ভক্তির কারণটি অত্যন্ত নারীবাদী এবং বৈপ্লবিক।  

          অম্বুবাচী তাই, ধর্মমতের উর্ধ্বে উঠে প্রাকৃতিক সৃষ্টির উদযাপনের এক উৎসব। আর কে না জানে, প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টির প্রতীক নারীরাই। নারীদেহের পবিত্র এই শারীরিক ঘটনার উদযাপন এবং তার সঙ্গে কৃষিকাজের মত একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার সংযোগ স্থাপন একটি জিনিস প্রমাণ করে। পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজ সর্বত্র নারীর সম্মান আজও সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। নারীর সৃষ্টিক্ষমতার জয়গান এই অম্বুবাচী।

চিত্র সৌজন্য: গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল