স্বাধীনতা দিবস- প্রথম পর্ব

প্রসূন রঞ্জন দাসগুপ্ত
4.8 রেটিং
3758 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 4 , গড়ে : 4.8]

পাঠকদের পছন্দ

এক

সাক্ষাৎকার

23 শে জানুয়ারি, 2000 , সকাল 7 টা

আজ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী , গত দুদিন ধরে আজকের দিনটি ভালোভাবে উদযাপন করার জন্য দমদম বেদিয়াপাড়ার নবজাগরণ সংঘে সাজো সাজো রব। ঘন্টাখানেক বাদে শুরু হবে প্রভাতফেরি , ক্লাবের সহ- সভাপতি জগদিশ বর্মণ ওরফে জগাদা ছটা থেকেই মাইক নিয়ে বসে পড়েছেন । পাড়ার ছেলেমেয়েরা দুদিন ধরে গোটা ক্লাব ও ক্লাবের পাশের মাঠ, রাস্তা ইত্যাদি পরিষ্কার করেছে, ছোটো ছোটো জাতীয় পতাকা, বিভিন্ন মনিষী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী দের ছবি দিয়ে সাজিয়েছে। ইলেক্ট্রিশিয়ান ও ডেকরেটার দিয়ে দিন-রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ, আলোকসজ্জা ও সাউন্ড এর কাজ কাল রতেই শেষ হয়েছে। এখন সেই মঞ্চ আলোকিত করে জগাদা বলে চলেছে “ এলাকার সকল অধিবাসীদের আজকের এই পবিত্র দিনের শুভেচ্ছা জানাই, আজ নেতাজির জন্মদিন, সেই উপলক্ষে আমাদের নবজাগরণ সংঘের উদ্যোগে পালিত হবে নানাবিধ অনুষ্ঠান , প্রথম 8 টায় প্রভাতফেরি, তারপর 9 টায়  হবে পতাকা উত্তোলন, তারপর 9.30 টায় শুরু হবে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, বেলা 11 টায় হবে রক্তদান শিবির ও আমাদের নবজাগরণ সংঘের দ্বিতলে নতুন সংগ্রহশালা “সুভাষ কক্ষ” এর উদ্বোধন তারপর সন্ধ্যা 6.30 টায় হবে পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।   অতএব আপনারা একটুও দেরি না করে এখনই প্রভাতফেরির জন্য ক্লাবের মাঠে উপস্থিত হন ও আজকের এই নানাবিধ কর্মযজ্ঞের সুভ সূচনা করুন।

কিছুক্ষণ এর মধ্যেই অনেকেই চলে এলেন নিজের নিজের ছেলেমেয়ের সাথে, ক্লাবের পক্ষ থেকে সবাইকে জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন মনিষীর ছবি দিয়ে তৈরি প্ল্যাকার্ড দেওয়া হল, ব্যান্ডের ব্যবস্থা করাই ছিল , হইহই করে প্রভাতফেরি শুরু হল। সবাই বেড়িয়ে পরার পর ক্লাবের সভাপতি নবারুন বাবু জগাদা কে বললেন “ ওফফ  জগা, তুই সকাল থেকে যা শুরু করেছিস না, কান ঝালাপালা হয়ে গেল, তুই সব্ দিক আরেকবার দেখে নে, পতাকা, শহিদবেদী সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখ, আমি যাই কাকাবাবু কে নিয়ে আসি”।

কিছুক্ষণ বাদে নবারুন বাবুর সাদা গাড়িটি থামল ঝিলবাগানের একটি দোতালা বাগান বাড়ির সামনে, ফটকে নাম লেখা সুধাংশুশেখর দত্তগুপ্তু, এই নামটা দেখলে আজ এই বুড়ো বয়সেও  নবারুন বাবুর কেমন ভয় করে, গেটে দাঁড়ানো হোমগার্ড কে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকাবাবু আছেন তো ?”  হোমগার্ড অবনী মণ্ডল, নবারুন বাবুকে চেনেন অনেকদিনই, উনি হেসে বললেন “হ্যাঁ স্যার আপনারই অপেক্ষা করছেন, যান বারান্দায় বসে কাগজ পরছেন। ঘোরানো সিঁড়ী দিয়ে নবারুন বাবু দোতালায় উঠে এলেন। দোতালায় উঠেই যেটা প্রথম দেখা যায় একটা টেবিলের অপর কাঁচের বাক্সে বাঁধানো একটি তামার ফলক, এটি হল ভারত সরকার প্রদত্ত “তাম্রপত্র পুরস্কার“ যা দেওয়া হহয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। প্রত্যেকবার নবারুন বাবু এই বাড়িতে এলে কিছুক্ষণ এই ফলক টার দিকে তাকিয়ে থাকেন, আর কাকাবাবুর প্রতি স্রদ্ধা যেন আর একটু বেড়ে যায়। তখনই পেছন থেকে চেনা গেল পরিচিত কণ্ঠস্বর “ কি ব্যাপার নব, তুমিই দেরি করলে দেখছি আমি কখন থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি, চল চল। “ কাকাবাবুর গলার আওয়াজ পেয়ে নবারুন বাবু চমকে তাকালেন। সুধাংশুশেখর বাবুর উচ্চতা বেশী নয় , সাড়ে পাঁচ ফুট হবে, চেহারাও  ছোটখাটো, মুখের একপাশে পোড়া দাগ কিন্তু এমনই ব্যাক্তিত্ত্ব যে আজও এই 86 বছরের বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকানো যায় না, সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত এই বিরলকেশ বৃদ্ধ কে দেখলে এমনিই মাথা নিচু হয়ে আসে। নবারুন বাবু, সুধাংশুশেখরকে প্রনাম করে বললেন “ এইতো চলুন কাকাবাবু “, বলে তার হাত ধরতে গেলেন, সুধাংশুশেখর হেসে বললেন “ লোকের হাত ধরে ঘোরার মত অবস্থা এখনও আমার হয়নি নব, শুধু একটা লাঠি লাগে, চল “

পতাকা উত্তোলন পর্ব সুসম্পন্ন হল, এবার শুরু হবে বসে আঁক প্রতিযোগিতা , জগাদা বলছেন “ আজ আমাদের অত্যন্ত আনন্দের দিন কারন আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন আমদের বাংলার তথা দেশের গর্ব , প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা প্রাক্তন বিধায়ক শ্রদ্ধেয় শ্রী সুধাংশুশেখর দত্তগুপ্তু , ওনার আর একটি পরিচয় আছে , উনি একজন সফল ব্যবসায়ী, বহু মানুষ  কে উনি দেখিয়েছেন নিজের পায়ে দারানোর পথ, এই ক্লাবেরও উনি একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং উনি আমদের সকলের অভিভাবক , আমাদের কাকাবাবু। প্রত্যেকবার বিভিন্ন ব্যাস্ততার কারনে অথবা শারীরিক সমস্যায় উনি আসতে পারেন না, কিন্তু এবার আমরা ওনাকে পেয়েছি, এ আমাদের অনেক সৌভাগ্য । উনিই আজ তোমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন তারপর ওনার হাতেই শুভ উদ্বোধন হবে আমাদের সংগ্রহশালা সুভাষ কক্ষের”।

বসে আঁক প্রতিযোগিতা শেষ হল, পুরস্কার প্রদানের আগে সকলে সুধাংশুশেখর বাবুকে কিছু বলতে অনুরোধ করলন, উনি বললেন “ এ আমার সৌভাগ্য যে আমার আদর্শ নেতাজীর জন্মবার্ষিকীতে আমি আমাদের আগামী প্রজন্মের মুখমুখি হয়েছি, বয়সের কারনে এখন বেশি কথা বলতে পারি না, কিন্তু এটুকুই বলবো , এটা তোমাদের সৌভাগ্য যে তোমরা স্বাধীন ভারতে জন্মেছ, আর তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের এই দেশকে আর উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। “

সুধাংশুশেখর বাবু 5 মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে পুরস্কার বিতরণী ও উদ্বোধনের পর্ব সম্পন্ন করে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে নবারুন বাবুকে বললেন “ নব তাহলে বাড়ির দিকে যাওয়া যাক, আমার ওষুধের সময় হয়ে গেছে “। নবারুন বাবু বললেন “আরে কাকাবাবু আপনার সাথে দুজন দেখা করবেন বলে অপেক্ষা করছেন, আপনি সংগ্রহশালাতে ছিলেন তাই গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন “। সুধাংশুশেখর বাবু নবারুন বাবুর সাথে গাড়ির কাছে কিয়ে দেখলেন একজন মাঝবয়সী লোক আর একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে অপেক্ষা করছেন। সুধাংশুশেখরবাবু সামনে যেতেই দুজনে ওনাকে প্রনাম করলেন, তারপর একগাল হেঁসে বয়স্ক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “ স্যর চিনতে পারছেন ? “ সুধাংশুশেখরবাবু ওনাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন “ অভ্র তোমায় ভুলে যাব, তুমি আমায় কতবার বাঁচিয়েছ “ নবারুন বাবু জানতে পারলেন এই অভ্র অর্থাৎ অভ্রতনু পাল ছিলেন কাকাবাবুর দেহরক্ষী, যখন কাকাবাবু বিধায়ক ছিলেন এবং নকশাল আমলে ববেশ কয়েকবার সুধাংশুশেখরের প্রান বাঁচিয়েছেন তিনি, সম্প্রতি চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন । ওনার ছেলে সুভ্রদীপ বর্তমানে WBCS পরীক্ষার GR-B লেভেল পাশ করে হাড়োয়া তে পুলিশের DSP পদে কর্মরত এবং সঙ্গের মহিলাটি হলেন ওরই স্ত্রী অর্থাৎ অভ্রবাবুর পুত্রবধু সঙ্গীতা। সঙ্গীতা বর্তমানে মুগ্ধবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে, এবং অভ্রবাবুর মুখে সুধাংশুশেখরের গল্প শুনে শুনে ওনার একরকম ফ্যানই বলা চলে। আজ সঙ্গীতা নিজের শ্বশুরমশাই কে সঙ্গে নিয়ে  এসেছে এক বিশেষ অনুরোধ নিয়ে। সুধাংশুশেখরবাবুর বিপ্লবীজীবন তথা কর্ম জীবনের এক ধারাবাহিক ইন্টার্ভিউ করতে চায় মুগ্ধবাজার এবং সঙ্গীতার ওপর পরেছে তার দায়িত্ব । ওরা সুধাংশুশেখরবাবুর বাবুর বাড়িতেই গেছিলেন, গিয়ে সুনেছেন উনি এখানে আছেন তাই এখানেই চলে এসেছেন। সুধাংশুশেখরবাবু প্রথমে আপত্তিই করলেন , বললেন “ আজ এত বছর বাদে এসবের আবার কি দরকার, আমার শরীর ও ভালো যাচ্ছে না, আর বয়স হয়েছে পুরনো দিনের অনেক কথা ভুলেই গেছি , মনে হয় না আমি পারবো “। এই শুনে নবারুন বাবু, অভ্রবাবু এবং ক্লাবে সবাই যারা কথাটা সুনতে পেয়েছেন সবাই মিলে সুধাংশুশেখরবাবুকে বললেন “ না কাকাবাবু না করবেন না, আপনার বর্ণময় জীবনের কতটুকু আমরা জানি,    আমরা জানি আপনি পূর্ববঙ্গ থেকে এখানে এসেছিলেন একই সঙ্গে চরমপন্থী ও নরমপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, আবার পরে আমাদের এই বেদিয়াপাড়ায় আপনি পূর্ববঙ্গ থেকে আগত অসহায় মানুষদের স্বাবলম্বি করার জন্য শুরু করেন বিভিন্ন ব্যবসা , তো আমরা সবাই জানতে চাই আপনার কথা, দয়া করে না করবেন না”। সকলের কাতর অনুরোধে শেষে রাজি হলেন সুধাংশুশেখরবাবু, হেসে সঙ্গীতাকে বললেন “ ঠিক আছে মা তাই হবে, সকালের দিকে  আমার শরীর ভালো থাকে, তুমি রোজ ৮ টা নাগাদ ঘন্টাদুয়েকের জন্য আসতে পারো, এর থেকে বেশিক্ষন কথা বলা আমার পক্ষে কষ্টকর, তবে এটুকু বলতে পারি যা শুনবে খুব একটা খারাপ লাগবে না “। সবাই আনন্দে হইহই করে উঠলো।

দুই

তোরঙ্গ অভিযান

23 শে আগস্ট 1999, দুপুর 2 টো

নতুন অভ্যাস মত আরতি সেন দুপুরের খাওয়া শেষ করে টিভিতে খবরের চ্যানেল চালিয়ে নিজের ইজিচেয়ারে বসলেন।  আগে কলেজের অধ্যাপনার ও গবেষণার কাজের চাপে টিভি দেখার সুযোগ প্রায় হতোই না, কিন্তু গত বছর চোখে সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তার জানান এতদিন অল্প আলোয় পড়াশোনা করে আরতি দেবীর দুটি চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এরকম চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে অন্ধত্ব অনিবার্য। তারপর ডাক্তারের পরামর্শে ও একমাত্র মেয়ে মামনির অনুরোধে আরতিদেবী কলেজ থেকে রিটায়ারমেন্টের দুবছর আগেই স্বেচ্ছাবসর নিলেন। এখন মেয়ের বিয়ে হয়েছে, সবসময়ের পরিচারিকা সম্পাকে নিয়ে আরতি একাই থাকেন, মেয়ে অবশ্য মাঝেমাঝেই অফিস ফেরত দেখা করে যায়।

সেদিনও রোজকার অভ্যাস মত আরতি দেবী খবরের চ্যানেল চালিয়ে চোখ বন্ধ করে খবর শুনছিলেন ও বিরক্ত মনে ভাবছিলেন যে রাজনীতির কুটকচালি ছাড়া এদের আর কোন খবরই নেই , এমন সময় আচমকাই শুনলেন “ ব্রেকিং নিউজ, রূপবানী থিয়েটারের পেছনে ভেঙ্গে পড়লো শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি, আহত দুই, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন পুরসভার কর্তারা , মোতায়েন আছে পুলিশ “। খবরটা শুনেই তিনি চমকে উঠলেন কারন ওই এলাকায় প্রাচীন তম বাড়িটাই হল আরতি দেবীর বাপের বাড়ি, পুরসভা বেশ কয়েকবছর আগেই “ বিপজ্জনক বাড়ি” র সাইনবোর্ড লাগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু ওই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না, সবাই নিজের নিজের ফ্ল্যাটে থাকে , বাড়িটা হয়ে উঠেছিল মদ ও জুয়ার আড্ডা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়ের অফিসে ফোন করে খবর টা দিলেন , তার মেয়েও মিডিয়ার সঙ্গেই যুক্ত, তাই আরতি দেবী মেয়েকে ব্যপারটা একটু দেখতে বললেন।

সন্ধ্যাবেলা মেয়ে এসে জানালো ওনার আশঙ্কাই সঠিক, আরতি দেবীর বাড়িটিই ভেঙ্গেছে, কাল থেকেই পুলিশি পাহারায় পুরসভা সম্পূর্ণ বাড়িটি ভাঙ্গার কাজ শুরু করবে। আরতি মেয়েকে জিজ্ঞেস “ হ্যাঁরে আমাদের জিনিস গুলোর কি হবে রে “। মামনি বলল যে সে দেখে এসেছে, জিনিস আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ওই বাড়িতে তাও যদি কিছু পাওয়া যায়, পুলিশ থানায় নিয়ে রাখবে, সেখান থেকে নিয়ে আসতে হবে।

সাত দিন ধরে চলল বাড়ি ভাঙ্গার কাজ, আরতি দেবীর মন খুবই খারাপ এই কয়েক দিন, যদিও প্রায় 30 বছর ওই বাড়ির সাথে কোন সম্পর্ক নেই, জামাই এর অকাল মৃত্যুর পর বিধবা মেয়ে বাইরে কাজ করতে যাবে এটা আরতি দেবীর বাবা কোনোদিনই মেনে নেননি, তাই ওই বাড়িতে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল না, তবুও পৈত্রিক ভিটে বলে কথা। সাত দিন পরে একদিন মামনি এলো গাড়িতে করে বিরাট একটা ময়লা ও জং ধরা ট্রাঙ্ক নিয়ে, আরতি দেবী রে রে করে উঠলেন, “ এসব কি জঞ্জাল নিয়ে এলি বাড়িতে “ বলে চিৎকার করে উঠলেন। মামনি হেসে বলল ‘ মা এটা জঞ্জাল না, এটা সোনার খনি, ওই বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে, আমি অনেক ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছি, ট্রাঙ্কের অপরের নামটা দেখ, ও স্যরি আমিই পড়ে দিচ্ছি, Property Of Prodyut Laha “। আরতি অবাক হয়ে বললেন “ বলিস কি রে বড় জেঠুর ট্রাঙ্ক, দেখেছিস ভেতরে কি আছে “। অবাক হওয়ার মতনই ব্যপার, কারন আরতি দেবীর বড় জেঠু ছিলেন বিরাট গুণী মানুষ , বয়সে তিনি আরতি দেবীর বাবার থেকে প্রায় ২০ বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি ছিলেন অসামান্য এক চিত্রশিল্পী, তবে তাঁর আসল পেশা ছিল মেকআপ, তিনি ছিলেন মিনার্ভা থিয়েটারের মেকআপ আর্টিস্ট এবং ছোট্ট আরতি বাবার কাছে শুনেছিলেন যে তাঁর জেঠু শিশির ভাদুরির সাথে কাজ করেছেন। তো সেই মানুষের ট্রাঙ্ক পাওয়া মানে বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। মামনি জানালো যে সে দেখার সময় পায়নি, এবং আজ রাতে সে এবাড়িতেই থাকবে, ও রাত্রে মা ও মেয়ে মিলে একসাথে করবে তোরঙ্গ অভিযান।

রাতে হাতুড়ি, ফিনাইল, ঝাঁটা ও বড় একটি প্লাস্টিকের শিট নিয়ে মা ও মেয়ে ট্রাঙ্ক খোলার কাজে লেগে পড়লেন, প্রথমে তালা ভাঙ্গা হল, তারপর প্লাস্টিকের ওপর ট্রাঙ্কটি উল্টে, তারপর পোকা ও ইঁদুর তাড়িয়ে ওর মধ্যের জিনিস গুলো পরীক্ষা করার কাজ শুরু হোল। পাওয়া গেল প্রচুর কুচি কুচি করে কাটা কাগজ, একটা হিসেবের ডায়েরি , অনেকগুলি তুলির পেছন দিককার অংশ, অনেক গুলো পোকায় কাটা বই এবং একটা খাতা পাওয়া গেল যেটা ধাতুর পাত দিয়ে বাঁধানো এবং তাঁর ওজন কয়েক কেজি তো হবেই। এবং সত্যি বলতে ওই খাতাটি ছাড়া বাকি সবই জঞ্জাল।

সব ময়লা পরিস্কার করে মাকে শুইয়ে মামনি রাতে নিজের ঘরে খাটে হেলান দিয়ে ওই খাতাটা নিয়ে বসলো, প্রথম কয়েক পাতা অপাঠ্য, কিন্তু তারপর দেখল এক এক পাতায় এক এক জনের নাম, স্বল্প পরিচয়, শরীরের পুঙ্খানুপুঙ্খ মাপ এবং পোশাক তৈরি করতে কতটা কাপড় লাগবে তার বেশ সুন্দর বিবরন দেওয়া। মামনি বুঝতে পারলো এ হল তার মায়ের জেঠুর থিয়েটারের পোশাকের মাপের খাতা। মামনি বেশ আগ্রহ নিয়ে খাতাটির পাতা উল্টাতে লাগলো ।

তিন

দুঃসংবাদ

14 ই আগস্ট, 2000 ,রাত 11 টা

টাকির একটি বিলাসবহুল অনুষ্ঠানে উদ্দাম নাচ গান চলছে, নতুন একটি ছবির গান চলছে “ এক পল কি জিনা…” এই গানে সবাই নাচছে, ভিকি ও চোখ বন্ধ করে দুহাত তুলে নাচছিল, এমন সময় সে অনুভব করলো ঘাড়ে ও কোমরে হিমশীতল স্পর্শ , কানের কাছে কেউ ফিস্ ফিস করে বলল “ চুপ চাপ বাইরে চল , দাদা গাড়িতে অপেক্ষা করছে, একটুও আওয়াজ করলে গুলি চালিয়ে দেব, গানের আওয়াজে কেউ কিচ্ছু শুনতে পাবে না”।ওদের সাথে ভিকি বেড়িয়ে ক্লাবের পেছনে এলো, গিয়ে দেখল অন্ধকারে একটা বড় SUV গাড়ির দরজা খুলে  বাঁ হাতে একটা গ্লাস ও ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বসে আছে দাদা অর্থাৎ রুলিং পার্টির দাপুটে কাউন্সিলার দেবা দা, গাল ভর্তি পাকা দাড়ি ও মাথায় কাঁচাপাকা চুল আর চোখ জবাফুলের মত লাল। গাড়ির চারিদিকে দাঁড়িয়ে অন্তত চার- পাঁচ জন ছেলে। ভিকি কে দেখে দেবাদা হেসে কাছে ডেকে বোললো “ কিরে দূরে কেন কাছে আয় তোর মুখ কতদিন দেখি না”। ভিকি কিছু না বুঝেই এগিয়ে গেল, হঠাতই দেবাদার চোখের ইশারায় চারদিক থেকে চার জন এসে ওর হাত পা ও নাক চেপে ধরল, ভিকি শ্বাস নিতে হাঁ করতেই দেবাদা হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ওর জিভে চেপে ধরল।ভিকি যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার দেখল, কাটা কাটা গলায় দেবাদা বলল “ কিরে শুনলাম তুই নাকি বড় সাপ্লায়ার হয়েছিস, আমার থেকে পাউডার নিচ্ছিস না, নিজের মাল মার্কেটে চালাচ্ছিস? “ ভিকি আর্তনাদ করে বলল “ না গো দাদা তুমি ভুল শুনেছ “। দেবাদা অট্টহাস্য হেসে বলল “ দেবব্রত কোনোদিন ভুল শোনে না, চিন্তা নেই আমি জানি তুই আর এই ভুল করবি না” এ কথা বলে পাশে দাঁড়ানো এক সাগরেদ কে বলল “ যে হাত দিয়ে ও অন্যের ড্রাগ বেচেছে সেই দুটো হাতের দশটা আঙ্গুল একটা একটা করে ভেঙ্গে দে “। সবাই মিলে ভিকি কে ধরে গলির আর ভেতরে নিয়ে গেল, এদিকে চারিদিকে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের তীব্র আওয়াজে ভিকির বুকফাটা চিৎকারও চাপা পড়ে গেল। দেবা আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এই ব্যবসায় তার গুরু সাহিল চাচার কথা, উনি বলেছিলেন এই কাজে নরম হওয়ার কোন জো নেই, আজ যদি ভিকি কে অল্পের ওপর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত, তাহলে কাল এরকম 100  টা ভিকি তৈরি হয়ে যেত।

এমন সময় গাড়ির মধ্যে রাখা সেল ফোনটি বেজে উঠলো, এটা শুধু রাখা স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য, ফোন ধরার জন্যও পয়সা দিতে একেবারেই ভালো লাগে না দেবার, কিন্তু এই নম্বর যে অতি পরিচিত, ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে পরিচিত গলায় কেউ বলে উঠলো “ দেবব্রত বাবু বলছেন………………”। ফোন নামিয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বললেন “ ওকে ছাড়, গাড়ি স্টার্ট কর, হাসপাতাল যেতে হবে”। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাব দাদা ?” দেবাদা বাইরের দিকে মুখ করে বলল “আর জি কর“।

 

চার

ক্যাড্যাভার

মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা  খুবই চিন্তার মধ্যে আছে, কারন তাদের মনে হচ্ছে অ্যানাটমি বিষয়ের প্র্যাক্টিক্যালে তারা কেউই পাশ করবে না কারন শব ব্যবচ্ছেদ করার মত মৃতদেহই তারা সেরকম পায়নি, এবছর তারা 150 জন ছাত্র আর সারা বছরে মাত্র 6 টা ডেডবডি পাওয়া গেছে, তাই কয়েকজন ছাড়া প্রায় কেউই কিছু দেখতে পায়নি, নিজে হাতে ব্যবচ্ছেদ করে অন্ত্র বের করে আনা তো দুরের কথা, কারন এদেশের মানুষ ধর্মীয় সংস্কারের কারনে দেহ দানের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নন আর আইনি বাধ্যবাধকতায় বেওয়ারিশ লাশ এনে কেটে ফেলা যায় না। যথারীতি একদিন রেজাল্ট বেরল এবং দেখা গেল দুই তৃতীয়াংশই ফেল করেছে।

পার্থ খুবই মনমরা হয়ে পড়লো এই ফল দেখে, ছোট থেকেই ক্লাসের ফার্স্ট বয়, জয়েন্ট এন্ট্রান্সেও র‍্যাঙ্ক খুবই ভালো ছিল, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ওর রেজাল্টেও লাল কালির দাগ পরবে। সিনিয়র দের সাথে পরামর্শ করলো ওদের ব্যাচের অনেকে, সিনিয়র রা বলল যে এটা প্রত্যেক বারেরই সমস্যা, এবং উপায় একটা আছে, যদি ওরা রাজি থাকে। উত্তর 24 পরগনার আশোকনগরের কাছে এক বয়স্ক ডাক্তারবাবুর চেম্বার আছে যিনি একসময় পুলিসের ফরেন্সিক এক্সপার্ট ছিলেন, উনি প্রাইভেটে অ্যানাটমি প্র্যাক্টিকাল ক্লাস নেন, ওনার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

পার্থরা কয়েকজন ওই নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করলো , স্যার রাজি হলেন নির্দিষ্ট ফিসের বিনিময়ে। পার্থ জিজ্ঞেস করলো যে “ ডেডবডি কোথা থেকে জোগাড় করতে হবে”। স্যার বললেন “ সব লোক ঠিক আছে যাদের কে বডি স্ন্যাচার বলা হয়, যারা বিভিন্ন কবরস্থান থেকে মৃতদেহ তুলে সরবরাহ করে, যদিও ব্যপারটা সম্পূর্ণ বেআইনি কিন্তু এদের ছাড়া মানুষ ডাক্তারি পাশই করবে না, তবে ওরা সরাসরি এখানে আসবে না, পুলিসের ঝামেলা হতে পারে, নির্দিষ্ট দিনে চেম্বারের এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নির্দিষ্ট যায়গায় গিয়ে ওদের লোকের থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হবে, এবং ওদের কয়েকজনকে সঙ্গে যেতে হবে নাহলে পচা-গলা বডি গছিয়ে দেবে, আর এ জিনিস তো আর ফেরত হয় না “। পার্থ সভয়ে বলল “ স্যার আমাদের বডি আনতে যেতে হবে ?”, স্যার বললেন “ সাধারন লোকের মত বডি বডি কোর না, মেডিকেল টার্ম ব্যবহার কর, ক্যাড্যাভার বল”।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল