কাজকর্ম সব মিটিযে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মাথা টা তুলল শান্তনু। দু চোখ জালা করছে, মাথা টা ধরে আছে। তা ওদের আর দোষ কি? গত তিন সপ্তাহ যা অত্যাচার টা গেছে ওদের ওপর! এই যে নতুন কাজ টা ওর ঘাড়ের ওপর ঠেলে দিযেছিল ওর বদমেজাজী টেকো বস, তারপর শান্তনু কে সব দাযিত্ব নিয়ে করতে হয়েছে। গত তিনটে উইকএন্ড অফিসে আসতে হয়েছে তাকে। শনি – রবিবার অফিস আসতে হবে শুনলেই মেজাজ টা খিঁচরে যায়, তার ওপর পর-পর তিন সপ্তাহ! আজ শুক্রবার, সব কাজ শেষ, শান্তনুর মনে ফুর্তি। এই উইকএন্ড টা কিছুতেই নস্ট করা যাবে না।
সব কাজ টাজ বস কে বুঝিয়ে দিল শান্তনু। টেকো লোকটা চোখ গোল-গোল করে তাকিয়ে ছিল। শান্তনুর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এক জোরসে ঘুঁষি মেরে লোকটার টাক ফাটিয়ে দিতে, বহু কষ্টে সামলায় নিজেকে। গাড়ির চাবি পকেটে পুরে ক্যান্টিনে গেল শান্তনু। তার বসার জায়গা ৩০ তলাতে, ক্যান্টিন ৬০ তলাতে। তারপর আবার মাটির তলায় ১০ তলা নামতে হবে, তার গাড়ি ওখানে পার্ক করা আছে। একটু সময় লাগবে, তা লাগুক। যত দেরীই হোক না কেন বাড়িতে রিনি তার জন্য অপেক্ষা করবে। এই দিক দিয়ে শান্তনু নিশ্চিন্ত, রিনির চোখে ঘুম নেই।
কফি টফি খেয়ে, একটু আড্ডা মেরে একটু দেরি করে বেরোল শান্তনু। পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে। এই ইলেকট্রিক গাড়ি গুলো চালিয়ে মজা আছে – শব্দ নেই, ধোঁয়া নেই, ঝাঁকুনি কম। শান্তনু ফুর্তিতে শিষ দিতে দিতে ড্রাইভ করছিল। তার প্ল্যান করা আছে উইকেন্ড – কাল সকালে সে আর রিনি যাচ্ছে সুন্দরবন। একটা লজ বুক করা আছে, শানিবার টা থাকবে, রবিবার বিকেলে ফেরত্। দারুন মজা হবে, দারুন। রিনিকে জিগ্গেস করার কিছু নেই, সে কখোনো না বলে না।
শান্তনুর ফ্ল্যাট নিউ টাউন এর নতুন আপার্টমেন্ট গুলোর একটাতে – ৪৩ তলায়| অফিস আর ফ্ল্যাট এর মাঝে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সে স্পিড এ গাড়ি চালাচ্ছিল| রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল ইলেকট্রনিক হোর্ডিং| নানান কোম্পানির বিজ্ঞাপন তো আছেই, আর আছে সরকারের ঘোষণা – “আপনারা নির্ভয়ে এগোন, গভর্মেন্ট সব দায়িত্ব নেবে”| সব দায়িত্ব? শান্তনু মনে মনে হাসলো| টাকা পয়সা দিলেও কেউ এগোবে না| হুঁ হুঁ বাবা, কে আর ঝামেলায় জড়ায় ইচ্ছে করে?
ফ্ল্যাট এর বেল দিলো শান্তনু| ৫ সেকেন্ড ও দাঁড়াতে হলো না, রিনি দরজা খুললো| মুখ ভর্তি হাসি| এই হাসি মুখ দেখলেই শান্তনুর মন ভালো হয়ে যায়| কখনো রাগ বিরক্তি ভরা মুখ দেখেনি সে, দেখবেও না| ৩ বছর ধরে রিনি আছে ওর সাথে|
“দাড়াও আমি ফ্রেশ হয়ে আসি” বলে শান্তনু বাথরুমে ঢুকে গেল|
বেরিয়ে দেখে তার বাড়িতে পরার জামা কাপড় সব রেডি করে রেখেছে রিনি| তার কখনো ভুল হয় না|
“চা না কফি?” রিনি জিজ্ঞেস করলো|
“কফি দাও কফি” বলে শান্তনু বসার ঘরে গিয়ে টিভি চালালো|
রিনি কফি নিয়ে এলো, দুজনে অনেক্ষন বসে হাবি জাবি গল্প করলো| পলিটিক্স, সিনেমা – নানান প্রসঙ্গ| রিনির সাথে গল্প করেও সুখ – সব ব্যাপারেই কথা বলতে পারে| কোনো তাড়া নেই, বিরক্তি নেই|
এগারোটা নাগাদ রিনি বললো – “খেয়ে নেবে এবার?”
“হ্যাঁ খেয়ে নিই, কাল সকালে আমরা বেরোবো বুঝলে? কাল আমরা যাচ্ছি সুন্দরবন, পরশু ফিরবো|”
“তাই? দারুন তো!” রিনির চোখ চক-চক করছে আনন্দে|
“হ্যাঁ, আমার ব্যাগ গোছাতে হবে – দুদিনের জামা কাপড়|”
“সে রাতে আমি গুছিয়ে দেব| এখন খাবার তা গরম করে নিয়ে আসি|”
“আচ্ছা|”
রিনি খাবার গরম করতে গেল| শান্তনু বসে টিভি দেখছে| নানান চ্যানেল, আর মাঝে মাজেই সরকারি বিজ্ঞাপন – সেই এক কথা| এই যদি রিনির জায়গায় অন্য কেউ থাকতো, কাল যাওয়া নিয়ে কত ঝামেলাই না হতো| আগে বলোনি কোনো? জিনিস কি কি নেবো? টাকা কত লাগবে? – হাজার প্রশ্ন, ঝামেলা| নিজের বয়স্ক আত্মীয় স্বজন দের দেখেছে শান্তনু|
প্রায় আধ ঘন্টা পরেও রিনি আসছেনা দেখে শান্তনু অবাক হলো| সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল| তাড়াতারি উঠে কিচেনে গেল|
রিনি মাইক্রোওয়েভ এর সামনে দাঁড়িয়ে, পাথরের মতো স্থির| চোখ বন্দ| ছুটে গিয়ে ডান হাতের তালু টা তুলে দেখলো শান্তনু – যা ভেবেছে তাই| লাল আলো জ্বলছে নিবছে| মানে চার্জ শেষ|
শান্তনুর মাথা টা গরম হতে শুরু করলো| কালকের প্ল্যান কি হবে? এদিকে এতো রাত হয়েছে| নাঃ, এক্ষুনি বেরোতে হবে, প্ল্যান ক্যানসেল করা যাবেই না|
১০ মিনিটের মধ্যে দেখা গেল শান্তনু রিনি কে পশে বসিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে জোরে | “জীবনসাথী”-র রিচার্জ সেন্টার গুলো ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, চিন্তা নেই| বছর ৩ আগে এই জীবনসাথী থেকেই রিনিকে নিয়ে এসেছিলো ও| পারফেক্ট জীবনসঙ্গী রিনি – কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো রাগ, বায়না | উন্নত মডেল এর রোবোট রিনি – শান্তনুর মন মেজাজ বুঝতে পারে, সেইমতো রিঅ্যাক্ট করে | কোনোদিক দিয়ে বোঝা যায় না ও মানুষ না | ওর মধ্যে শুধু সাংসারিক কাজ না, প্রোগ্রাম করা আছে নানা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, সাধারণ জ্ঞান| কথা বলেও সুখ|
সমস্যা একটাই – ২/৩ মাস পর পর চার্জ দিতে নিয়ে আস্তে হয় এদের সেন্টার এ| শান্তনু অফিসার কাজ এর চাপে ডেট টা ভুলে গেছিলো| চার্জ শেষ হয়ে গেলে লাল আলো জ্বলতে নিভতে থাকবে| এ ছাড়া রিনি সম্পর্ণ একজন নারী| যাকে পেলে একজন পুরুষের সারা জীবন চলে যায়|
শান্তনু গাড়ির স্পিড আরো বাড়ালো| চার্জ এর ব্যাপার টা মিটিয়ে বাড়ি ফিরে একটু ঘুমোতে হবে| কাল সুন্দরবন যেতেই হবে, এই উইকেন্ড কিছুতেই নষ্ট করবে না সে|
শান্তনুর মতো অসংখ্য মানুষ আজ রোবোট জীবনসঙ্গী নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে| সরকার চিন্তিত – জনসংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে| তারা নানাভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে – বিজ্ঞাপন দিচ্ছে| “স্বাভাবিক মানুষ জীবনসঙ্গী নির্বাচন করুন| বিয়ে করুন| আপনারা নির্ভয়ে এগোন, গভর্মেন্ট আপনাদের সন্তানের সব দায়িত্ব নেবে|” এই বিজ্ঞাপন গুলো টিভি তে আসে, রাস্তার ধারের বোর্ডে ঝলমল করতে থাকে| কিন্তু লাভ হয় না| মানুষ আজ তাদের রোবোট জীবনসঙ্গী নিয়েই ব্যস্ত|