প্রবল বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিল সন্ধ্যের কিছুপর থেকেই। সারাদিনই আজ আকাশের মুখভার।কখনও জোরে,কখনও আস্তে..হয়েই চলেছে।বাইরে বেশ ঠাণ্ডা একটা আমেজ,দরজা জানলা বন্ধ করেও সেটা বেশ টের পেলো সুবর্ণলতা।আচ্ছা,বৃষ্টি অন্ধকার জোলো পরিবেশটার সাথে কী অতিপ্রাকৃতিক যোগ থাকে? নয়তো এরকম দিনগুলোতেই ওর ঠাণ্ডার চেয়ে গা ছমছম বোধটা বেশী হয় কেন..বরাবর..উফ্,কখন যে থাম্…।থমকালো সুবর্ণ,বরাবর?? কই ছোটোবেলায় তো হতোনা এরম,কিংবা কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে..উঁহু,তখনও না। সুবর্ণলতা
ভাবার চেষ্টা করল।
আসলে ভয় পাওয়া নিয়ে এই ফোবিয়াটা একটা উপসর্গ মাত্র,যা ওর ভীষন জোরালো একাকীত্বটাকেই সামনে এনে দাঁড় করায়,সে বোঝে।
অথচ বৃষ্টি তার ভালোলাগার অনুভূতি ছিলো।কলেজ জীবনের বৃষ্টির দিনগুলো ছিল তাদের অপেক্ষার দিন, কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে ঝরে পড়া জলের ফোঁটার শব্দ শোনার দিন।তখন রাতের অন্ধকারেও বৃষ্টি তার ঘরময় মায়াজগত তৈরী করতো।কই তখন তো এই বিশ্রী ব্যাপারটা ছিলোনা।ভয় তখন ওর নয়,ছিলো অন্যতরফে।লোকজানাজানির ভয়,সমাজ,পরিবারের দিক থেকে নিষেধাজ্ঞার ভয়।সুবর্ণ তখন ছিলো খোলা আকাশে উড়তে চাওয়া এক দিগভ্রান্ত পাখি।ভবিষ্যত না জানলেও ভয়লেশহীন হয়ে সারা আকাশ জিতে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিলো মনে।পড়াশুনার পর ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়ে একটা চাকরী জুটিয়ে নিতে পারলেই ভেবেছিল স্বপ্ন সার্থক। বাকীটুকু তো শুধু সুখীগৃহকোনের সংজ্ঞা। প্রথমদিকে বাড়ির অশান্তিগুলোতে নাজেহাল হয়ে থাকতো সে।গালমন্দ কটুকথাগুলোতে রক্তাক্ত হতো স্বত্বা। ধীরে ধীরে বিশ্বাসভঙ্গের চরম নিষ্ঠুর দিকটা সে দেখতে পেয়েছিল। চোখের সামনে সবার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সরে যাওয়া অথচ শুধু ভালোবাসার প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে নিজেকে কার্যত খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল সে।যন্ত্রণা মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।সুবর্ণকে শিখিয়েছিল একজনকে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে অন্যজনকে শুধু অবহেলার বস্তু হয়ে থেকে যেতে হয়।অথচ,সমকালীন সমাজ প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র সমলিঙ্গের কাউকে ভালোবাসার জন্য বিদ্রুপ বা পরিহাসের পাত্রী হতে হবে,এ ভাবনা কোনোদিনই তাকে বিশেষ ভাবিত করে নি। আধুনিক বাগাম্বড় এই সমাজ ভালোবাসাকে বড়জোর জাতপাত আর কিছুটা ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে যাওবা গ্রহন করতে শিখেছে … সমকামিতা প্রশ্নে নৈব নৈব চ।
LOVE KNOWS NO GENDER -এর স্বার্থকতাকে স্বীকার করতে তাবড় আধুনিক মনস্কদেরও বুক কেঁপে যায়। তবুও সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতিই তাকে বাকী সবকিছু অগ্রাহ্য করার সাহস জুগিয়েছিল।আর তাই
সুবর্ণলতা শেষ অব্দি চেষ্টা করেছিল,অদম্য ভালোবাসায় ফিরিয়ে আনতে তাকে,পূরণ করতে চেয়েছিল অর্ধেক দেখা স্বপ্নটাকে।পারে নি।
কাছাকাছি কোথাও খুব জোরে বাজ পড়ল,চমকে উঠল সুবর্ণ।একবার খুব কাছ থেকে বাজ পড়া দেখেছিল সে,জায়গাটা পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল।
চারবছর আগের রাতটাও ছিলো এরকমই একটা বৃষ্টির দিন ,তেরো বছরের হাসিকান্না,সুখদু:খ,আদর আহ্লাদ,সুবর্ণের প্রেম সবকিছুকে কবর দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে যেদিন প্রিয়া বসেছিল,সেদিন তার বেনারসীর লাল রং,সিঁদুরের লাল রং সব একাকার হয়ে সুবর্ণের ভিতরে আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল,যে রং তার অধিকারে থাকার ছিলো, সমাজ পরিবার নিজের মানসিক দৌর্বল্য সবকিছুর অঙ্গুলিহেলনে অপরিচিত এক পুরুষের হাতে তা তুলে দিয়ে প্রিয়া নিজেকে দায়মুক্ত করেছিল। সেদিনও বাজ পড়েছিল হয়ত অদূরে কোথাও,কিন্তু পুড়ে ছাই হয়েছিল সুবর্ণলতার আত্মা।
সুবর্ণের আত্মহত্যার বৃথা চেষ্টা শারীরীক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে হেরে ভূত হয়ে যাওয়া অন্য এক সুবর্ণকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল।নিজেকে সেই প্রথম তার অলৌকিক কিছু মনে হয়েছিল।একাকী নি:সঙ্গ মৃতপ্রায় চিন্তার জগতে ঘুরে বেড়ানো অশরীরী কেউ।
সুবর্ণ উঠে গিয়ে দাঁড়ায় ম্যাড়ম্যাড়ে জৌলুসহীন আয়নাটার সামনে, নিজেকে দেখে হেসে ফেলে সে।সে মৃত নয়,জীবিত। আগের থেকে অনেক বেশী শান্ত..স্হির। সদ্য পাওয়া চাকরীটা,আনুষঙ্গিক ব্যস্ততা তার ক্ষত প্রলেপে কিছুটা সাহায্য করে।অতীতের ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়,কিন্তু সুবর্ণের কাছে তার অতীত কোনো ভুল ছিল না,তাই শিক্ষা নেওয়ারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি কখনও। প্রতিকূল যা কিছু ,সবের সাথে দিনরাত্রি অসম লড়াই চালাতে চালাতে একদিন সে আবিষ্কার করলো,শুধু বলার জন্য না, আক্ষরিক অর্থেই সে একা।বৃষ্টির শব্দ ভালোবাসার মুহুর্তদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে থাকে,মুহুর্তদের বারবার ফিরে পেতে চায় সে,কিন্তু পাশটা শূন্যই রয়ে যায়।
অসহয়তা ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে দু:খ,ক্ষোভ, আত্মগ্লানিতে আর তারপরই কোনো এক মুহুর্ত থেকে গা ছমছমে ভয়ভাবটা ওর ওপর চেপে বসতে থাকে।
একা..একা..বাইরের এই বিশাল পৃথিবীতে সুবর্ণ বড় একা।
বৃষ্টির তোড়টা একটু ধরেছে বোধহয়।আজ সারাদিন ধরেই ৩৭৭ ধারা খারিজের আবেদনে সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সারা দেশ।অনুভূতি ব্যক্ত করার কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গ হতে পারেনা.. আজ থেকে সমকামিতা আর অপরাধ নয়..কাল থেকে শুরু হবে এক নতুন দিন, এক নতুন অধ্যায়।সুবর্ণের কাল সকালের দিকে একটু বেরনো আছে।হঠাৎ কী মনে হল,জামাকাপড়ের ট্রাঙ্কটা খুলে কয়েক বছর আগের উপহার পাওয়া মাল্টিকালারের একটা সিল্কের স্কার্ফ বের করে আনল সে। রামধনু রঙা হয়তো নয়, না হোক.. জীবনের কিছু রং তো মিশে আছে ওতে।সুবর্ণ স্হির করলো এটা গলায় পেঁচিয়েই কাল বেরোবে সে,বৈধতা অবৈধতা,ন্যায় অন্যায়-এর এলোমেলো রংগুলোকে প্রেম আর নির্ভীকতার রং-এ মিলিয়ে দেবে সে-ও। যারা এ’লড়াইয়ে পথে নেমেছে তাদের সেই অদম্য ইচ্ছা আর জেদকে কুর্নিশ জানিয়ে এটুকুই হয়ে থাকবে তার ধূসর জীবনের ক্যানভাসে অর্ধেক আকাশ রামধনু..!
বেশ ভালো
ধন্যবাদ 😊