দুঃসময়

সুজিত চট্টোপাধ্যায়
0 রেটিং
803 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

শহর থেকে অনেক দূরে , ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন । শুনশান। মাইকে পরিচিত ঘোষিকা কন্ঠস্বর থেমে আছে চারমাস।
বিশুর চায়ের গুমটি। নিত্যকার যাত্রীদের কিছুক্ষণের ঠিকানা। ভোর থেকে মাঝরাত একটানা।
এক্কেবারে বন্ধ হয়ে আছে ।

বিশু, গুমটি খোলে না আর। লকডাউন জারি হবার পরেও কিছুদিন খুলে ছিল। পরে যখন বুঝতে পারলো ,
সে যেমন আশা করছে , আসলে তেমনটি হবার নয়। এর মেয়াদ একেবারেই অজানা। তখন থেকেই এক্কেবারে বন্ধ।  ট্রেন বন্ধ। মানুষের যাতায়াত বন্ধ। গুমটিও বন্ধ।
কিন্তু , জীবন তো থাকে না। রোজগার চাই , রোজগার। এই গুমটি চায়ের দোকানের ভরসা তেই বেঁচে ছিল বিশুর সংসার। এখন হাহাকার।
বিশুর একমাত্র রোজগারের লক্ষ্মীঘর।
উড়ন্ত স্বাধীন পাখি , আকাশ ময় উড়তে উড়তে , আচমকা ডানা বন্ধ করে বসে পড়লো গাছের মগডালে। সে খবর পেয়েছে , একটা শিকারী বাজপাখি তাকে তাগ করেছে। সুতরাং নিরাপদ আশ্রয়ে গা ঢাকা দেওয়াই উচিৎ নির্নয়।

  মাঝেমধ্যে বিশু আসে। দেখে যায় চারপাশ। খোঁজে পরিচিত মুখ , আর আশার আলো। তাকিয়ে দেখে, অলস নিশ্চল অকর্মন্য হয়ে পড়ে থাকা রেললাইন গুলো।
বিশু, বন্ধ গুমটিঘর দ্যাখে আর ভাবে। কেজানে , আবার কবে স্বাভাবিক হবে সবকিছু। সেই আগের মতো।গমগমে ব্যস্ততায় রমরম করবে এই ছোট্ট স্টেশন আবারও। ফিরবে বেঁচে থাকার রসদ।

মাটিতে পড়ে থাকা নিরীহ রেললাইন গুলোর সঙ্গে জীবনের অনেককিছুই যেন একাকার হয়ে থাকে। কখনও ব্যস্ততায় , কখনও নিষ্কর্মায়।
বিশুদের নিষ্কর্মা হলে চলে না। ওদের নিত্যকর্ম , নিত্য বেঁচে থাকা। ডাল ভাতের জীবন।
সকাল সন্ধ্যায় লক্ষ্মী গনেশের তেলচিটে মূর্তির সামনে ধুপকাটি ঘুরিয়ে নম নম ঈশ্বর স্বরণ। আর বৃহস্পতিবার করে একটা টিংটিঙে মালা, লক্ষ্মী গনেশের দ্বৈত গলায়।  দোকানের সামনে লেবু লঙ্কার লম্বাটে হয়ে ঝুলে থাকা , বদনজর এড়ানোর তুকতাক।
এইতো আসল। ঘানিটানা জীবনের হাজার ঝক্কি সামলে তাকে স্বরণে রাখাই প্রকৃত সাধন।
ঈশ্বর কে ডাকবে বলে যে সংসার ত্যাগ দিয়েছে , সে তো তাকে ডাকবেই। তাতে বাহাদুরি কোথায়। বরঞ্চ তা না করলেই তার দুর্নাম। ভন্ড।

সবইতো ঠিকঠাক চলছিলো। হঠাৎ,,,, দূর ভালো লাগেনা বাপু,,। একরাশ অভিমান , আক্ষেপ , হতাশা। তবুও মনের কোণায় এতটুকু আশা। পৃথিবী আবার শান্ত হবে। নচিকেতা’র গান।

প্লাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চোখ বোলায় বিশু। বড্ড অচেনা মনেহয়।
অনেক কাছের মানুষ কে যেমন বহুদিন পরে দেখলে চেনার মাঝেও অচেনা প্রকট হয় বেশি করে , ঠিক তেমন।
খাঁ খাঁ নিস্তব্ধতা। যেন সংসার ত্যাগী নিরাসক্ত বৈরাগী। একি তপস্যা , নাকি প্রায়শ্চিত্ত ? বিশু বোঝেনা। সে পন্ডিত নয়, দার্শনিক নয়, জ্ঞানী নয়। সে শুধুই খেটেখুটে খাওয়া সাধারণ সৎ নাগরিক।

স্টেশনের নড়েচড়ে চলে যাবার উপায় নেই , তাই একঘেয়ে একজায়গায় ঠায় পড়ে থাকা।
এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা আর ধুলো।
কিন্তু এ-র ই মাঝে, আর একজনের থাকার কথা। সে গেল কোথায় ?
বেশ মনে আছে , দুদিন আগেও তাকে এখানে ঘুরঘুর করতে দেখেছে বিশু।
বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরেই সে বিশুর গুমটির আসেপাশে আছে। কখনও শুয়ে আছে লেজ গুটিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে। কখনও জিভ বের করে অকারণ হাঁপাচ্ছে বসেবসে।
বিশুর দোকানের খদ্দের তো কম নয়। অনেকেই ওকে রোজ দেখতে দেখতে, কেমন যেন প্রশ্রয় দিয়ে ভাব জমাবার চেষ্টা করতো।
তাদের ছুঁড়ে দেওয়া কেক, বিস্কুট, আলুর দমের আলু , পাঁউরুটি, ডিমের টুকরো , পরমানন্দে চেটেপুটে সাফ করতো সে।
বর্ষায় ছাউনি, কিংবা শীতে উনুন পারের উত্তাপ,  সবই বিশুর গুমটি দোকানে মিলতো অনায়াসে।
লকু বলে ডাক দিলেই , সে বাঁকানো সাদাকালো ল্যাজ নেড়ে নেড়ে বুঝিয়ে দিত, সে জানে, তারই নাম লকু। গেল কোথায় ?
ঠিক তখনই কাজলদির আবির্ভাব। কাজলদিরও গুমটি দোকান রয়েছে এখানে,  এখনো। মুড়ি তেলেভাজা। খুবই ব্যস্ত দোকান,,,, ছিল। কাজলদি ধান্দায় আছে , গুমটি টা বেচে দেবার। মনোমত দাম পেলেই ঝেড়ে দেবে। সব্বাইকে সেই রকমই বলে রেখেছে। কিন্তু পরিস্থিতি যা , কেউ-ই নতুন  করে টাকা ঢালতে সাহস পাচ্ছে না। তাই বিক্রিও হচ্ছে না। পরিস্থিতি আগের মতো থাকলে অনেকেই রাজি হয়ে যেতো। বিশুই হয়তো,,,। জমানো রেস্তো ক্রমশ হালকা হচ্ছে। গচ্ছিত ধন শেষ হলে , অনাহার শুরু হবে।
মরা তো মরা ই। রোগে কিংবা অনাহারে।

নাহঃ,, অহেতুক ভেবে লাভ নেই। বিশুকে ঘরে ফিরতে হবে। রেশন তুলতে হবে। ওই টুকুই অনেক ভরসা। চাল , মানে ভাত। সে বড়ো কম কথা নয়।এই দুর্দিনে ।
  ঘন্টা খানেক হাঁটা। বাস চলছে না। অটো কিংবা টোটো চড়তে ভয় করে। তাছাড়া , ভাড়াও বড্ড বেশি। গায়ে লাগে। দুঃসময় কিনা। আয় নেই। ব্যয় আছে পুরোদস্তুর । বিশুর, বাবা মা বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ছয় জনের ভরা সংসার। কেজানে কী আছে কপালে শেষমেশ।

কিন্তু , সে কোথায় গেল , লকু?
ও কাজলদি , লকু কে দেখছিনা , কোথায় গেল বলতো, জানো , দেখেছ তাকে ?
ওমা, দেখিনি আবার ? খুব দেখেছি। তুমিও দেখো। তোমার ওই গুমটি ঘরের নিচে একবার উঁকি দিয়ে দ্যাখো না,,, বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এতো দুর্ভাবনা কষ্টের মধ্যেও এমন উল্লসিত হাসি কেমন করে কোথা থেকে আসে , কেজানে বাবা।
বিশু একটু থমকে গেল। তারপর নিচু হয়ে দেখলো গুমটির নিচে,,,। আরিব্বাস! ওরে লকু করেছিস কী!
ওরে হতচ্ছাড়া , এখন , এইসময় এতগুলো বাচ্চা বিইয়ে শুয়ে আছিস ? ওফঃ বলিহারি তুই ।
বিশুর কথা শুনে কাজলদি আরও জোরে হেসে উঠলো। বললো,,,,,
ও বিশু,  ভাবনায় চিন্তায় তোমার মাথাটা গ্যাছে গো। আরে , ওকি মানুষ , নাকি ওর লকডাউন আছে ? ওকি আমাদের মতো পাপী মানুষ , যে সুখের মুখে নুড়ো জ্বেলে , বাড়াভাতে ছাই পড়বে ?
ওরা কেষ্টের জীব। বেইমানি , বিশ্বাসঘাতকতা জানেনা। তাই মরণের ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে থাকতে হয়না। বুঝেছো ?
বিশু দেখছে , সদ্যোজাত ছানাগুলো তাদের মায়ের স্তনে মুখ ডুবিয়ে মহানন্দে দুধ পান করছে। ওখানে কোনও মারণ জীবাণু থাবা বসাতে পারবে না।কিছুতেই না।
ও যে স্বর্গের সুধা। অমৃত রস। আকাশগঙ্গা মধু।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল