‘পাখির খাবার নেবেন?? পাখি খায়??’ লোকটি রেলিং ধরে বলে গেলো।।। কিন্তু পাখি কই? পাখির দেখা মিলছে না। ভরা সমুদ্রের মধ্যে ভেসেল চলেছে- কচুবেড়িয়া ডকের দিকে ঠিক দক্ষিণ পশ্চিমে।।। বিকেলের ধূসরতায় মিলিয়ে যায় লংলাইন টাওয়ার হারিয়ে যায় ড্রেসিংয়ের শব্দ। ঠিক এই সময়ে সবাইকে অবাক করে দেখে মেলে তাদের- ঝাঁকৈ ঝাঁকে হাজারো ডানা— গাঙচিল উড়ছে আবার জলে গিয়ে বসছে ঢেউয়ে। নিরবিচ্ছিন্ন জলরাশির প্রবল তরঙ্গে ওদের আর পায় কে!এবং আমাদের ও একই দশা। অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গেই “ক্লিক ক্লিক” শুরু হয়ে যায়।।। ‘পাখির খাবার নিন। পাখি ভলো খায়’-
গ্ৰামের মধ্যে দিয়ে আমাদের পথ।।। সন্ধ্যা হয়ে যায়।চারিদিকে অজস্র পোকার ডাক সঙ্গে ঝিঁঝির ব্যাকগ্ৰাউন্ড মিউজিক। ছোটো ছোটো ডোবার উপর আলো জমাট বাঁধে ঘোলাটে জানলার কাঁচের মতো। সরু পিচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বকুল গাছের ওপরে চাঁদকে মায়াজগতের মনে হয়। মনে পড়ে যায় পুরনো সেই বোল যেখানে নিখিল মাস্টার তবলা ঠেকা রাখতেন আর রাধারূপিণী আমি ঘাটে জল আনতাম। আশেপাশের গাছপালা মাঠ-ঘাট আর জলের ঢোবার মধ্যে অদ্ভুত আলো-আঁধারের রঙ্গ তামাশা চলে।।। প্রকৃতির মায়াঘন আবেশে জীবকুলের অনুভব আকারে প্রকাশ পায়, শুধুমাত্র তাই নয় এ এক অদ্ভুত সমাবেশ। একসময় যখন মানুষের সেই বিপ্লব ঘটেনি তখন সে ছিল পশুসতির সাধক ও সঙ্গী তখন সে প্রকৃতির নিয়ম গুলো বুঝতো।।। এখন সে নিজস্ব প্রকৃতি বানিয়েছে। তার থেকে বেরিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির কাছে ছুটতে হয় তাকে। বুঝতে হয় রহস্য।রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতে পায় কোথায় যেনো কাঁসর-ঘন্টা বাজছে। তিথি পড়ে গেছে।।। সময় এসেছে মহাজাগতিক শক্তির আরাধনার। মনে পড়ে যায়-
দৃশ্য এক: পূর্ণিমার রাতের মাহাত্ম্য কথা পুরানে লোকাচারে বর্ণিত আছে।।।স্থানভেদে লোকাচারের প্রকৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান ভিন্ন হয়, যেমনটি প্রকৃতির সংসারেও ঘটে। সেখানে কোনো মানুষ আকৃতির দেবশক্তি বিধাতা হয়ে ওঠে না, সেখানে প্রকৃতিই সব- এক এবং অদ্বিতীয়।।। বিশ্বসংসারে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার মহাজাগতিক কান্ড কারখানায় মনুষ্য প্রজাতির সংস্কার সমন্বয়ের জন্য কিছু বছর পিছিয়ে পৌঁছতে হবে আফ্রিকা মহাদেশে, তানজানিয়ায়। ষোলোটি জাতীয় উদ্যান আছে সেদেশে, যার মধ্যে একজনকে আমরা সবাই চিনি-সেরেঙ্গেটি জাতীয় উদ্যান। পৃথিবীর সবথেকে লম্বা স্থানান্তর হয় সেরেঙ্গেটির বিস্তীর্ণ সমতলে। জাতীয় উদ্যানের মধ্যে বহু জনজাতির বাস। ২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন অমাবস্যার রাতে।।। হ্যাঁ আর ঘাতক সিংহের হাতে। নিশাচার প্রাণীদের দৃষ্টি অন্ধকারে দেখার সহযোগী হয়।।। চোখের আলো সংবেদি ও বর্ণ সংবেদি কোশ থাকে।।। নিশাচরদের আলো সংবেদি কোশ বা রড কোশ প্রায় মানুষের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি থাকে তাই অত্যন্ত কম আলোও ধরা দেয় ও ছবি তৈরি করে এবং একটি অতিরিক্ত অংশ থাকে, আয়নার মতো, যার কারণে জ্বলন্ত দৃষ্টি আমাদের শিহরণ জাগায় আতঙ্কের আবরণ তৈরি করে। এই আবরনের নাম- টাপেটাম্ লুসিডাম্। তাই সিংহ- শিকার উৎসব ও হয়। সিংহের বিচরণ ক্ষেত্র ক্রমশ কমছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও ঘাসজমির অবলুপ্তি সেদেশে মানুষ ও সিংহের সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে।।। দীর্ঘ সামাজ-জীবনের ইতিহাস ও বিস্তার মানুষের বিভিন্ন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে কিন্তু প্রকৃতির কাছে সবাই সমান, তাই একবিংশ শতকের এই ঘটনাটি মনে হয় অনেক পুরনো গল্প।।। প্রকৃতির একটু সহায়তা সিংহের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।।। বহু অভিযোজিত শিকারী সে।। ভুল হয়না তার। তাকে ভুল করাতে হয়। এভাবে তার জন্য পাততে হয় ফাঁদ।।। মানুষের সঙ্গে জটিল থেকে জটিলতর হয় প্রকৃতির সম্পর্ক।
দৃশ্য দুই: পূর্ণিমার উদ্ভাসিত আলোয় আমার প্রিয় পাখি পেঁচা মহা আনন্দে। কেনো??? তাকে আজ খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। সহজেই দেখতে পাবে তার খাবারকে।হ্যাঁ পেঁচা শুধু ঘন অন্ধকারে নয় আলোতেও দেখতে পায়।।। বিশাল চোখ, যা তাদের দেহের ওজনের প্রায় তিন শতাংশ, এবং পিউপিল রন্ধের আলো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। তাই খাবার ও ভয় ভয় থাকে। অতি সন্তর্পণে তারা চলাফেরা করে।।। পুরো শুক্লপক্ষ জুড়ে এই উৎফুল্লতা আমাদের আশা জাগায়।।। ‘ফসলের শত্রু’ বলে খ্যাত ও তাই আমাদের অর্থনীতির হতাশা ইঁদুরের বিনাশকারিনী পেঁচার অধিষ্ঠাত্রীর পুজো করি ঘরে ঘরে প্রতি পূর্ণিমাতে। লৌকিক উপাচার জড়িয়ে থাকে প্রকৃতির ছন্দে।।। আমাদের সংস্কৃতি সংস্কার সেই বৃত্তে আবর্তিত হয়।
ফির চলেছি। গাঙচিলের এবারে আর দেখা পেলাম না ঠিকই, কিন্তু সমুদ্রজাতকের দেখা পেয়েছি তাই মন খুব খুশি।।।তির এখন অনেক দায়িত্ব। সে সেই মহাজাগতিক ক্ষণে দাঁড়িয়ে।।।যেমন চাঁদ-সূর্যের টান ও আমাদের পৃথিবীর উপর তার প্রভাব আছে, এ নিয়ে আমরা সবাই অবগত আছি। চাঁদ সূর্যের আকর্ষণের ফলে পৃথিবীর বিপুল জলরাশির মধ্যে টান ও গভিরতার পার্থক্য ঘটে বা সোজা কথায় জোয়ার-ভাটা আসে। যদি চাঁদ-সূর্য-পৃথিবী এক সরলরেখায় থাকে তখন টান গভীর হয় যদি চাঁদ-সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করে তখন টান কমে যায়, যা যথাক্রমে ভরা ও মরা কোটাল নামে অভিহিত। জোয়ার-ভাটার সাময়িক অনুপাত ও periodicity আছে। একটা ছন্দ কাজ করে। সেই ছন্দে আমরা সবাই ভাসি- কীরকম?!! সাময়িক স্থানান্তরণ নামে একটা ঘটনা ঘটে যেখানে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কাঁকড়ারা উপরের পাড়ে উঠে আসে আবার চলে যায়, ঠিক যেমন ভাবে কোটাল আসে বা বাণ আসে। উপকূলীয় পাখিরাও নিজেদের বাসা পরিবর্তন করে।।। গাঙ্চিল ও আসে যায় এই টানে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূল থেকে আরো প্রায় বারোশো কিমি দক্ষিণ-পূর্বে পাড়ি দিলে পাবো আন্দামান ও নিকোবোর দ্বীপসমূহের কোরাল দ্বীপগুলি যারা ভরা কোটালের সময় সজীব সচল হয়ে উঠে রতিক্রীড়ায়।।। ভালোবাসে তখন সমুদ্রকাঁকড়াও।।। সুন্দরবনের সমুদ্র কাঁকড়ারা বা ম্যানগ্ৰোভ সমুদ্রকাঁকড়ারা সারাজীবন একজন সঙ্গীর প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মেয়েরা ছেলেদের পিঠে বয়ে নিয়ে চলে, ভরা সমুদ্রের কোটালে চলে তীরের দিকে। কোটালের এই সময়ে তরঙ্গ- তরঙ্গে ভেসে চলে আগামীর সংকল্প।।। সমুদ্রের প্রাণেরা কোটালের সময় বেছে নেয় সঙ্গমের আদর্শ সময় হিসেবে।।। কারণ বিপদ এড়ানো যায়।।। শিকার নাগালে আসেনা শিকারীর। কেমনে??? চাঁদ-সূর্যের টানে জল ফুলে ওঠায় জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটে ও এরফলে জলের টানের শক্তি ও তরঙ্গের তীব্রতা আসে। ফলে জননকোশ গুলি অনেক দূরে চলে যায় মানে ছড়িয়ে পড়ে। শিকারির নাগালের বাইরৈ আসে। প্রকৃতিই আমাদের ব্যবহার ঠিক করে দেয়। নির্দিষ্ট করে আচরণ ও দিনলিপি। তা সে আরধনায় হোক বা প্রেম নিবেদনে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
স্বাতী দাস, প্রাণী ভবন,কোলকাতা ভারতীয় প্রাণীবিদ্যা সর্বেক্ষণ
ন্যাশানাল জিওগ্ৰাফিক পত্রিকা ছবি স্বত্ব: স্বাতী দাস
খুব সুন্দর