বাবার কথা শুনে মা খুব ভেঙে পড়লেন। চোখে জল এনে কাঁদলেনও খানিক। তারপর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন, আহা রে! এই সময়ই বন্ধ হল কারখানাটা? সামনে যে পুজো! আমি মাকে সান-্বনা দিয়ে বললাম, থাক মা, এবারে আর নতুন জামা আমাদের জন্য না-ই বা কিনলে। আমার আর বোনের গতবারের জামা যে এখনো নতুনই আছে। সেটি পরেই দিব্যি ঠাকুর দেখা যাবে।
শুনে ছলছল চোখে তাকালেন বাবা। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আমাদের গায়েপিঠে হাত বোলালেন।
পাড়ার কাকুরা এসেছিল সেদিন বিলবই হাতে নিয়ে। বাবার নামে ওরা দু’শোটাকা চাঁদা কেটেছিল। মা আমতা-আমতা করাতে ওদের সেক্রেটারি নন’কাকু বললেন, এবারে একটু বেশি তো দিতেই হবে বৌদি ! দিনকে-দিন জিনিসপত্রের যা দাম বাড়ছে। আপনারা যদি একটু সহযোগিতা না করেন-
মা মিনমিন করলেন, কিন’ এবারে যে বড্ড অসুবিধায় পড়ে গেছি ভাই।
বেশ তো, গতবার যা দিয়েছিলেন, তাই দিন তবে। নন’কাকু বললেন।
মা বললেন, তাও যে পারব না এবারে। বলে চোখের জল মুছলেন।
মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকাল ওরা। তারপর বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হল বৌদি, কাঁদছেন কেন? এই দ্যাখো, এতে কান্নাকাটির কী আছে ? চাঁদা চেয়েছি। সম্ভব হলে দেবেন, না হলে-
কথা শেষ করার আগেই নন’কাকুর হাত চেপে ধরলেন মা। তারপর চোখের জল মুছতে-মুছতে শোনালেন বাবার অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার বৃত্তান-।
মায়ের কথা শুনে নন’কাকুরা সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলেন অনেকক্ষণ। কেউ কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। শেষে বিলবইটা নিজের হাতে নিয়ে নন’কাকু নিজেই তাতে দশটাকা লিখলেন। তারপর স্লিপটা ছিঁড়ে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, বৌদি এই নিন। আপনাদের কাছ থেকে কোনো চাঁদাই আমাদের নেওয়া উচিত নয়। তবু মায়ের পুজো; না নিলে নয়। তাই মাত্র দশটাকা কাটলাম।
বাবা প্ল্যান করেছেন পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে এবার একটা বেলুনের দোকান দেবেন। বড়োবাজার থেকে ছ’সাত প্যাকেট বেলুন এনেছেন বাবা। ফুঁ-দিয়ে ফুলিয়ে-ফুলিয়ে বাবা কোনটিকে আপেল, কোনটিকে পেয়ারা, আম বানালেন বসে-বসে। মা-ও হাত লাগালেন। আমি আর বোনও সাহায্য করতে থাকলাম বাবাকে।
বেলুন বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে গতকাল। তাইতো খুশি-খুশি লাগছিল বাবাকে বেশ। আমাকে আর বোনকে একবার কাছে ডেকে বললেন, এমন বিক্রি আর বাকি দিনগুলিতে হলে তোদের একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারি। এ-পুজোয় না হোক, লক্ষ্মীপুজোয় অন-ত পরতে পারবি।
বিকেল হতেই বেলুনের ঝাঁকা নিয়ে বাবা চলে গেছেন মন্ডপে। এটাচি থেকে মা গতবারের পুরোনো শাড়িটা বার করলেন। তারপর সামান্য সাজগোজ করে বললেন, চল, আমরাও একটু ঘুরে আসি।
মায়ের মতো আমিও চোখবুজে দুর্গামায়ের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করলাম। আর মনে-মনে বললাম, আমাদের কি”ছু চাই না মা। নতুন জামা, নতুন প্যান্ট- কি”ছু না। শুধু বাবার কারখানাটা খুলে দাও মা। আমাদের যে বড়ো কষ্ট। অভাব। তারপর চোখ খুলেই দার”ণ অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্য, মা দুর্গা দেখি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, তথাস’ ! তাই হবে খোকা।… তারপর চোখের সামনে দাঁড়ানো মায়ের মূর্তিটা থেকে অদ্ভুত এক দ্যুতি ছড়িয়ে পড়তে দেখলাম আমি। কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ ঘটল আমার শরীরেও। সীমাহীন এক আনন্দে অমনি ভরে উঠল আমার বুকটা। বাবা তখন বেলুন ফেরি করতে-করতে অন্য কোথাও। এদিকে-ওদিকে ছুটতে-ছুটতে আমি বাবাকে খুঁজতে লাগলাম। কথাটা বাবাকে না-বলা অবধি আমার যে শান্তি-স্বস্তি- নেই!
চিত্র সৌজন্য : গুগল