টিচার্স ডে

রাজীব বারুই
5 রেটিং
966 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 12 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

গতকাল যে দুঃখ ও কষ্ট পেয়েছিলাম, আজকেও তার ব্যাথা রয়েই গেল। স্কুলের শেষ বছরে ভেবেছিলাম কিছু সুন্দর স্মৃতি নিয়ে যাব, কিন্তু তার পরিকল্পনা চুরমার হয়ে ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। গতকাল টিচার্স ডে ছিল। কাল যা জানলাম, তা কাউকে বলতে না পারায় খাতায় লিখছি। চার বছর আগে আমাদের স্কুলে শ্রী অরিজিৎ ভট্টাচার্য নামে একজন অঙ্কের স্যার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম। প্রথম দিন তাঁর ব্যবহারে তিনি আমাদের মন জয় করেছিলেন। ভেবেছিলাম সত্যিই একজন মনের মত স্যার পাওয়া গেল। এই চার বছরে তাঁর প্রতি ভালবাসা আমার সাথে যে অন্যান্য ছাত্রদেরও বেড়েছে তা বোঝাই যায়। কারণ টিচার্স ডে দিনটিতে তিনি প্রচুর ফুলের তোড়া, পেন ও মিষ্টি পান। আমিও প্রতিবারের মত এবারও তার জন্য পেন কিনেছিলাম কিন্তু দিতে পারিনি। সেটাই দেওয়ার জন্য যখন স্টাফরুমের দিকে ছুটলাম, তখন দেখলাম সমস্ত টিচার একটা সভার আয়োজন করেছিলেন। তাই আমি বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। অরিজিৎবাবু অনেকদূরে বসেছিলেন। সবার প্রথমে হেডস্যার একটা বক্তব্য রাখলেন। দেরি হবে ভেবে আমি স্টাফরুমের পিছনদিকের জানালার কাছে চলে গেলাম। অরিজিৎবাবুর ঠিক পিছনে রয়েছে এই জানালা। আমি স্যারকে ডাকব তখনই অরিজিৎবাবু উঠে দাঁড়িয়ে হেডস্যারের উদ্দেশ্যে বললেন—“স্যার আমি কিছু বলতে চাই।” আমি তখনই মোবাইল বার করে অরিজিৎবাবুর বক্তব্য রেকর্ড করা শুরু করলাম। ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে উনি এত ভাল ভাল কথা বলতেন, যার সমস্ত শব্দ আমরা অনেকেই খাতায় লিখে রাখতাম। তাই আজকের দিনে তার বক্তব্য অধরা থাকতে দেব – তা আর হয় কি? উনি যা বলেছিলেন তার সমস্ত শব্দগুলো আমি নিচে লিখছি— হেডস্যার—হ্যাঁ, অরিজিৎ বলো।

অরিজিৎবাবু—স্যার আমাকে ক্ষমা করবেন, তবে আমি টিচার্স ডে উদযাপন করতে চাই না।

সুমিতবাবু — কেন? কি হল? চার বছরে প্রথমবার বক্তব্য রাখছ, প্রথমবারেই বিস্ফোরণ!

অরিজিৎবাবু (হেসে)—বিস্ফোরণ নয় সুমিতদা। কারণ হল আমি নিজেকে আর টিচার মনে করিনা তাই।

মিতালিদি—একি তুমি ছাত্রদের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক, আর তুমি একথা বলছ !

অরিজিৎবাবু যে ছাত্রদের সবচেয়ে প্রিয় এক বাকি টিচারের জানেন ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছিল।

অরিজিৎবাবু—জানি, তাই আজ আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তাদের ভালবাসার সঠিক মূল্য আমি দিতে পারছি না। এই যে দেখুন ওরা কত ফুল দিয়েছে আমাকে। ভাবছে যে ওদের ভবিষ্যৎ আমি এই ফুলের মত সুন্দর করব, কিন্তু যে কাঁটা ওরা দেয়নি আমি সেটাই বিঁধিয়েই ওদের কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি।

সুমিতবাবু—কি যে বলছ তুমি? তোমার কি শরীর খারাপ হয়েছে?

আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছিল, স্যারের সত্যিই শরীর খারাপ করেছে।

স্যার বললেন—না সুমিতদা। কোন কিছুই হয়নি। শুধু কষ্ট একটু বেশী হচ্ছে, আমি যা করছি তার জন্য।

হেডস্যার—আচ্ছা অরিজিৎ সত্যি করে বলত বিষয়টা কি?

-স্যার, ওদের সাথে থাকতে আমার ভাল লাগছে না। তাই তাদের প্রতি ক্লাসে আমি বেশ দেরি করে যাই, আর ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই চলে আসি। এমনভাবে ফাঁকি মারি যেন ওরা বুঝতেই না পারে। আর দেখুন আজও এই কথা স্বীকার করতে আমার লজ্জা হচ্ছে না। ভাবি ওরা তো টিউশনেই সব পড়ে ফেলে, তাই আমার ফাঁকি দিলেই কি বা এসে যায়। ওদের পড়া তো সব হয়েই যাবে, আর না হলেই বা আমার কি? পরের ছেলে পরমা……

এরপর স্যার যা বললেন, আমি তা খাতায় লিখতে পারলাম না। আশাকরি পাঠকেরা বুঝে নেবেন। আমি দু-বছর অরিজিৎবাবুর ক্লাস পেয়েছি। তিনি কখনও এরকম ছিলেন না। অঙ্ক করানোর সময় উনি কখনও ঘড়ি দেখতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লাসের সমস্ত ছেলে খাতায় অঙ্ক না করত, ততক্ষণ উনি ক্লাস ছেড়ে যেতেন না। তাহলে কি এই দু-বছরে তিনি ফাঁকিবাজ হয়েছেন। হায়! হায়! আমার শ্রদ্ধেয় স্যার সম্পর্কে আমি একি লিখলাম? পাঠকেরা আমায় ক্ষমা করবেন; তবে সত্যি বলছি আমার মনে তখন এই শব্দটাই ভেসে উঠেছিল। এর পরবর্তী কথাগুলো আমি ঠিক বুঝতে পারিনি; কেন? তার বিচার আপনারাই করুন।

স্যার বললেন—অন্যের সন্তানের শিক্ষার প্রতি আমি ফাঁকি দিচ্ছি। অথচ নিজের সন্তানের শিক্ষকের সাথে আমি ঝগড়া করছি, যে কেন তিনি আমার সন্তানের পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছেন?

আমি এটা বুঝতে পারছি না, যে স্যার তো দু-বছর আগে পর্যন্ত বিয়েই করেননি। এখন যে করেছেন, তার খবরও তো কারও কাছে শুনিনি। তাহলে তিনি কোন সন্তানের কথা বলছেন ! তবে এরপর স্যার যা বললেন, তাতে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা গভীর হয়। কিন্তু স্যারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা গভীরতা হারালো। কেন? তাহলে শুনুন—

অরিজিৎবাবু — শিক্ষকেরা হলেন চাষির মত। প্রতি বছর তারা নতুন ফসলরূপে ছাত্র গ্রহণ করেন। বছরের পরে বছর চাষ করেন এবং পরিপক্ক ফসল রূপে ছাত্রদের সমাজে পাঠিয়ে দেন। শিক্ষকদের দেওয়া শিক্ষাই ছাত্রদের জীবনে অধিকাংশ সময়ে সাহায্য করে। অথচ এতকিছু জানা সত্ত্বেও আমি ওদের সাহায্য করার প্রয়োজন বোধ করছি না। দেখুন না, ওদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক রেজাল্ট বের হওয়ার সময় আমি স্কুলেই আসিনা। ভাবি দূর কি হবে স্কুলে গিয়ে? যার রেজাল্ট সে বুঝবে। এরা আমার কে? এদের সাথে আমার সম্পর্ক কি? কেনই বা এদের জন্য আমি আমার সময় নষ্ট করব? বেশি হলে হেডস্যারকে ফোন করে জেনে নিই স্কুলের রেজাল্ট কিরকম হয়েছে। আরে পাড়া-প্রতিবেশীদের তো বলতে হবে। জানেন স্যার, আমার পিসেমশাই একজন শিক্ষক ছিলেন। আমি ছোটোবেলায় একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—“পিসাই, তুমি তো হেডমাষ্টার নও তা সত্ত্বেও মাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন তুমি স্কুলে যাচ্ছ?”

তিনি হেসে বলেছিলেন— “যেতে তো হবেই। আজ যে আমাদের একটা বড়দিন। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে থাকতে হবে।” আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম—“বড়দিন তো ছাত্র-ছাত্রীদের; তোমার কি?” তিনি বলেছিলেন “আরে বোকা ওদের এতদিন পড়িয়েছি, তাই আজকের দিনে ওদের সাথে থাকতেই হবে। তুই আর একটু বড় হলে সব বুঝবি।”

আমি বলেছিলাম— “তুমি যে ওদের এত ভালবাসো, তারাও কি তোমায় এতটাই ভালবাসে?”

তখন তিনি বলেছিলেন—“মনে রাখবি, প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর সবথেকে পছন্দের একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা থাকেন। হয়ত তাকে অন্যান্যরা পছন্দ করে না, তাই বলে সেই ছাত্র বা ছাত্রী কি চাইবে না, এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে কাছে পেতে। আমাদের কিই বা কাজ আজকের দিনে। যদি কেউ ভাল রেজাল্ট করে; তাহলে তাকে বলব এই তো আর একটু চেষ্টা করবে। আর যদি কারও রেজাল্ট আশানুরূপ না হয়, তাহলে বলব মন খারাপ করিস না। সামনের বার একটু বেশী খাটবি তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“দেখুন স্যার, এতকিছু জানি, তা সত্ত্বেও আমি কিছুই করছি না।

সঞ্জয়বাবু—তুমি কি ঠাট্টা করছ?

স্যার সত্যিই ঠাট্টা করছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন আমাদের মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছিল তিনি সেদিন সবাইকে মার্কশিট দিয়েছিলেন। আমার মার্কশিট আমি তার হাত থেকেই তো নিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে অরিজিৎবাবু ও হেডস্যার বাদে সুমিতবাবু, সৌরভবাবু ও অফিসের বড়বাবু সেদিন স্কুলে ছিলেন। তবে অরিজিৎবাবুর বর্তমান অবস্থার অবনতির কথা ভেবে মনে হচ্ছিল তিনি এখন এরকম কাজ করতেই পারেন।

— না, না সঞ্জয়দা, আমি ঠাট্টা করছি না। চার বছর ধরে যে কষ্ট সহ্য করে আসছি তা বোঝানো মুশকিল। তাই হয়ত এসব বকছি। এখন মনে হয়, আমি শিক্ষক নই; শ্রমিক হয়ে গেছি। আসি, যাই, মাইনে পাই। তাই ভাবছি যে শ্রমিক দিবস বড় করে উদ্যাপন করব। শিক্ষক দিবস পালন করার অধিকার আমার নেই। প্রত্যেক বছর আজকের দিনে সবাই কত ভাল ভাল কথা বলেন, আর আমি ভাবি এবার নিজেকে শুধরে নেব। কিন্তু পরদিন থেকে কথাগুলো যেন পোড়া তুবড়ির মত জৌলুস হারায়। তাই এইবার কেউ কোন ভাল কথা বলার আগে আমি অনেক বাজে কথা বলে ফেললাম। এর জন্য আমি আপনাদের কাছে কোন ক্ষমা চাইব না। কারণ, আপানাদের কোন ক্ষতি আমি করিনি। যাদের করেছি তাদের কাছেও চাইতে পারব না, কারণ তারা হয়ত আমাকে বুঝতে পারবে না। তাই আজ চললাম। কাল থেকে হয়ত একটু শোধরাব নয়ত সেই পোড়া তুবড়ি।

এত কথা বলে স্যার দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আমি ঠিক কি করব, কি বলব বুঝতে পারছিলাম না, তাই বাড়ি চলে আসলাম। এখন ভাবি, কেন আর্টস নিয়ে পড়ছি, যদি অঙ্কটা একটা বিষয় রাখতে পারতাম তাহলে স্যারের এই অবনতি আমি কিছুতেই হতে দিতাম না। আশাকরি পাঠকেরা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। আজ সকালেও আমি ছোট ক্লাসের ছেলেদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি এখনও নাকি একই ভাবে অংক করাতে উদ্যোগী। সাহস করে যখন সঞ্জয়বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন জানলাম অরিজিৎবাবু ফাঁকিবাজ। না, না! এইবার শব্দটি সঞ্জয়বাবু ব্যবহার করেছেন। যে অরিজিৎবাবু বলতেন—স্কুল একটা পরিবারের মত এবং আমরা সবাই সদস্য; সেখানে কিভাবে তিনি এরকম কাজ করতে পারলেন? আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যদি আমার লেখা পড়ে অরিজিৎবাবু সম্পর্কে কোন ভাল ধারণা জন্মায়, তাহলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। কারণ, আমি তার মত একজন শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। তাই আপনাদের সঠিক মূল্যায়ণ আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।।

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Joydeep Banerjee September 29, 2019 at 9:05 am

    দারুন গল্প, সত্যি অনবদ্য।

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল