দূর্গা

প্রসেনজিৎ ঘোষ
4.7 রেটিং
1011 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 3 , গড়ে : 4.7]

পাঠকদের পছন্দ

এদিকটায় সন্ধে নামলেই যেন বাকা চাঁদ যেনো তার স্ব মহিমা প্রকাশে ব্যাকুল হতে ওঠে। সূর্যের নিয়ন রাঙা আলোর সাথে জোৎস্নার প্রতিযোগিতা প্রতিদিনই অন্ধকারের দানবকে জিতিয়ে দেয়। তারপর সারাটা রাত ধরে শুধু অন্ধকারের একার রাজত্ব । তার বিপুল সাম্রাজ্যের কাছে আর যেন কেউই প্রতিদ্বন্দ্বী হবার সাহস দেখায় না। মাঝে মাঝে স্ফুলিঙ্গের মত কিছু দাবানল আলেয়ার মত জ্বলেই নিজ লজ্জা ও হীনমান্যতায় আপনিই নিভে যায়। সময়ের গভীরতার সাথে সাথে আরো নিগূঢ় হয় অন্ধকারের ব্যাপ্তি। একটা অর্ধেক দিন তার কাছে পরাজিত হয়ে থাকতে হয় সকলকে।

এদিকটা শহরে আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে এখনো বঞ্চিত।দিনের আলো শেষ হবার পর আর এখানে বৈদ্যুতিন আলোর রোশনাই ফুটে ওঠে না ।কেরোসিনের পলতে, যতটুকু অগ্নিশিখা ধরে রাখতে পারে তার দ্যুতিতেই পরিবারের মানুষ গুলোর মুখ চেনার মত কাজ চলে যায় মাত্র।

দামোদরের প্রত্যন্ত এ প্রান্তে ছোট্ট এক গ্রামে কয়েক ঘর দর্মা বেড়ার মাটির চালের তলেই শীন’প্রায় কিছু মানুষের বাস।সোহাগী ও সোরেন মান্ডী তাদেরই এক ঘরের বাসিন্দা।

গায়ে গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা অসম্পূর্ণ এ গ্রামের খোঁজ রাজধানীর মসনদে বসে থাকা রাজদন্ডধারী মানুষ তো দূর, প্রতিবেশী গ্রামের মানুষ গুলোই কেউ তাদের খোঁজ রাখে না।সকলেই যেনো তাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে।সময়ের তালে তালে এগিয়ে যাবার পরিবর্তে সোহাগী সোরেনদের মত মানুষেরা যেন দামোদরের বুকে জমে ওঠা চড়ের মত সীমাবদ্ধ স্রোত বিমুখ হয়ে বেড়ে চলেছে।

নতুন চাকরি নিয়ে সদ্য একমাস আমার এখানে বসবাস।

সরকারি প্রকল্পের দায়িত্ব হাতে নিয়ে তা সম্পূর্ণ করা যে কতটা কঠিন তা আমার মত হাতে গোনা কিছু মানুষেরাই জানে। কাজের সুত্রে সারাটা জীবন পরিবারের থেকে আলাদা থাকতে হয়। কোনো এক জায়গায় সাময়িক আস্তানা গেড়ে সেখানকার মানুষদের সাথে আত্মিক হতেনা  হতেই আবার নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমাতে হয়।

আর তাই কোনো জাগাতেই এখন আর মন স্থীর থাকেনা। মেশিনের মত কাজ করে কাজ শেষ করার দিন গোনার অপেক্ষা করতে করতেই মাথার চুলের রং পাল্টে যায়।

তবে এবার এই জায়গাটা যেন একটু আলাদা।চারিদিকে সবুজ, আদিমতার একটা ছাপ যেনো  সর্বদা বিদ্যমান। আর হইতো তাই মনটা একটু অন্যরকম হতে উঠেছে। কেমন যেনো একটা ভালোলাগা ভালোলাগা ভাব জন্মেছে বুকের ভেতরেই।

এবছর  রাজ্যে কোথাওই খুব একটা বেশি বৃষ্টি হয়নি ।

ফলে চাষের অবস্থাও খুব একটা আশানুরূপ নয়।এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষি নির্ভর ও ভাগ চাষের উপর নির্ভরশীল।কিছুজন আবার দুবেলা যোগালি ও মজুরির কাজ করেও দিন যাপন করে। কখনো কোনো শহুরে কাজের অর্ডার যদি আসে , অথবা সরকারি প্রকল্পের কাজ যদি শুরু হয় তো এদের বেশ কিছুটা মাস অন্নজলের সংস্থান হয়। নচেৎ সেই চেনা রুটিনেই দিন কাটে বছরের পর বছর। তবে এবছর বৃষ্টি না হলেও এদের মনের আবেগধরা একটুও কমেনি, আর তার প্রধান কারণ আমার তত্ত্বাবধানে হতে চলা সরকারি প্রকল্পের কাজটি। তবে এদিকটায় অথবা এরকম প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে কাজ করে সবচাইতে বেশি সুবিধা হলো, এখানে মজুরের অভাব কখনই হয় না। পারিশ্রমিক যতই কম হোক না কেন, মজদুর পাওয়া বরাবরই সুলভ।

বেকারত্ব ও অভাব তাদের কে যেন বাধ্য করে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে, যা আমার মত মানুষের চোখকেও কখনো কখনো ভিমড়ি খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।

সোহাগী ও সোরেন স্বামী স্ত্রী দুজনেই  সরকারি প্রকল্প শুরু হবার প্রথম দিন থেকেই তাদের নাম লিখিয়ে দিয়ে গেছিলো।শুধু তারা নয় নদিচড়ের তীরে কোনোভাবে গড়ে ওঠা অসম্পূর্ণ এ গ্রামের প্রায় কমবেশি সকলেই নাম লিখিয়েছে।কি ছেলে কি মেয়ে, আবাল বৃদ্ধ সকলের নামই তাতে আছে। আর আমি যে প্রকল্প নিয়ে এসেছি তাতে মজুরির কাজের জন্য যে পরিমান মজুরের প্রয়োজন তাতে এখানের সকলেই কমবেশি কাজ জুটে যাবে।অনেক বড়ো বড়ো প্রকল্পে কাজ করার হাতছানি থাকলেও আমি এদের সাথে কাজ করার লোভ কোনোদিন ছাড়তে পারিনি। আর তাই হয়ত এভাবেই বনে বাড়াতে পরে থাকি। এইরকম সহজ সরল মানুষ গুলোর পাশে থেকে, তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে দিনের শেষে তাদের হাতে মজুরির টাকাটা যখন তুলে দিই ,ঠিক সেই সময় তাদের  ক্লান্ত ঘর্মাক্ত , চোখে কালসিটে পড়ে যাওয়া , রোদে পোড়া মুখের সহজ সরল অনাবিল হাসিটা

যেন স্বর্গসুখ এনে দেয়।কখনো কখনো নিজেকে ভগবান এর দূত বলে মনে হয়। আর হয়তো তাই আমি না  একাজের থেকে দূরে থাকতে পেরেছি , না ঘর সংসার এর মায়াজালে নিজেকে আটকে রাখতে পেরেছি।

আমার এখানে আগমন মাস খানেক হলেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে সবে দিন সাতেক হলো। সোহাগী ও সোরেন সহ গ্রামের প্রায় সকলেই প্রথম দিন থেকেই কাজ পেয়েছে। কাজও এগিয়েছে বেশ ভালই গতিতে।আমিও দুবেলা ভীষণ ভাবেই কাজের সাথে নানান ভাবে জড়িয়ে থাকি।সরকারি টাকায় আমার জন্য তিনবেলা আলাদা করে খাবার বরাদ্দ থাকলেও আমি কোনোদিনই আলাদা করে কোনো সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসিনি।আগামীতেও হয়তো করবো না। আর তাই আমিও আমার সাময়িক পরিচিত এই শ্রমিক বন্ধুদের সাথেই তাদের রান্না করা খাবার ভাগ করেই এতদঅবধি খেয়ে এসেছি। এখানেও সেই ব্যাবস্থাই করেছি।

ইদানীং দুবেলা রোদে জলে পুড়ে কাজ শেষ করে স্নান করে পরিষ্কার হয়ে নিয়ে বিকেলের দিকে একা একাই বেরিয়ে পড়ি, খুব কাছ থেকেই বয়ে চলা  দামোদর নদীর পার ধরে সন্ধ্যা ভ্রমণে।

এবছর বৃষ্টি তেমন একটা না হাওয়াতে দামোদর তেমন ভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠেনি। নদীর পাশে বাঁধানো ইটের পাকা রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যা ভ্রমণে যে  সুখ আছে তা শহরের বুকে বড়ো হতে ওঠা ছেলেমেয়েরা কোনোদিনই বুঝবেনা।

দামোদরের গা ঘেঁষে বেশ কিছুটা চড়ের জমি।আশপাশের গ্রামের স্থানীয় কিছু বাসিন্দারা সেই জমি ভাগ করে নিয়ে তাতে ধান পাট আলু এসব চাষ করে থাকে।ছোট ছোট ক্ষেতগুলোর গা ঘেঁসে বেড়ে উঠেছে ঘনও কাশ এর বন। শরৎ এখনো পুরোপুরি আসেনি,সবে বর্ষা শেষের। মুখে। কিন্তু তাও কাশের সাদা পালক গুলো পরন্ত সূর্যের রাঙা আলোয় যেন এখনই মাথা তুলে দুলছে যেন দেবীর আগমনের অপেক্ষা করছে।

প্রতিদিনই সন্ধ্যা ভ্রমণে শেষে যখন ফিরে আসতাম বেশ কিছু বাচ্চা মেয়েদের মাঠে ছাগল চড়াতে দেখতাম। ছাগলগুলো খুব ছোট যেন শাবক ছানা। প্রথমে তেমন ভাবে গুরুত্ব দিইনি।কিন্তু ইদানিং একটি মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়াতে হয়। মেয়েটি অন্যান্য মেয়েদের মত ছাগল চড়ায় না। কিন্তু সে মাঠের সকল ছাগল চড়ানো মেয়েদের দূর থেকে দেখে। দেখে মনে হয় যেন কেউ ওই বাচ্চা মেয়ে গুলোকে এক্ষনি ধরে নিয়ে যাবে আর ওই মেয়ে তাদের পাহারা দিচ্ছে।এভাবেই সে সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী হয়ে তাদের সাথেই দিন কাটায়।

মেয়েটির বয়স বেশি  নও ,বোধ করি তেরো কি চোদ্দো হবে। তবে বেশ দিধাঙ্গী।গায়ের রঙ বেশ ফর্সা।মাথায় কোঁকড়ানো চুল। চোখ গুলো টানা টানা। অন্যান্যদের চাইতে বেশ আলাদা দেখতে। মুখের আদলটাও অনেকটা যেন দেবী প্রতিমার মতন।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে তেমন বিশেষ কাজ আর থাকে না। যেহেতু আমি আবার পুরো প্রকল্পের প্রধান তাই শ্রমিকবর্গও বিশেষ কেউ আমার ঘরের দিকে ঘেঁষে না।

জানিনা হয়ত তারা প্রধানের কাছে আসাটায় সংকোচ অথবা ভয় অথবা লজ্জাই বোধ করে একটু বেশি।

রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম সন্ধ্যার পরে তো তেমন বিশেষ কিছু কাজ থাকেনা। যদি গ্রামের বাচ্চা গুলোকে একটু বই পত্তর কিনে পড়াশুনার জন্য উৎসাহিত করতে পারি তাহলে বেশ হয়, অন্তত শিক্ষার আলোর স্বাদ তো বাচ্চা গুলো পাবে। জানিনা মনের মধ্যে এমন ভাবনা কেনো আসছিল। প্রতিমা স্বরূপ ওই বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে এরম ভাবনা আসছিলেন কিনা তাও জানিনা। তবে একটা দুশ্চিন্তাও মনের মধ্যে আসছিল সেটা হলো সেই বাচ্চা গুলো কি আদৌ পড়াশুনা করে? স্কুলে যায়? পড়তে শুনতে পারে? শুধু তো ওই কটা বাচ্চাদের আলাদা করে লেখাপড়া শেখানো যাবেনা। সাহায্য করলে সব বাচ্চাদেরই করতে হবে। কিন্তু গ্রামের মানুষজন আমার এই কাণ্ড কারখানা সরল মনে মেনে নেবে কি? আমি বাইরে থেকে এসে এখানে এসব করতে চাইলে তারা এর পেছনে কোনো অন্য অভিসন্ধীর গন্ধ খুঁজবে নাতো? মনে মনে এও ভাবলাম যে আমি বললে গ্রামবাসীরা আমার কথা ফেলতে পারবে না , কিন্তু কতটা সঠিক হবে আমার এই কাজ? এসব ভেবেই মাথা যখন গুলিয়ে আসছিল মন স্থীর করলাম, ভালো কাজ যখন করতে চাইছি একবার বলেই দেখি না।  একবার সকালে শ্রমিক দের সাথে কথা বলে নেবো, মনে মনে এই ঠিক করে শুয়ে গেলাম।

রাত্রে ঘুম ঠিক মত হলো না। সারারাত সেই বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়েই ভাবলাম। অমন দেবী প্রতিমার মত মুখ, অমন সুন্দর সুশ্রী অমন ফর্সা ওমন মেয়ে এরম একফালি নদীর চড়ে বনে বাদাড়ে আদিবাসীদের ভিড়ে কি করে হয়? নাকি সেই মেয়ে অন্য কোথাও থেকে এসছে? কিছুতেই যেন আমি দুয়ে দুয়ে চার করতে পারলাম না।

সকালে কাজে যোগ দিয়েই ঘোষণা করলাম আজ বিকেলে কাজের শেষ কেউ বাড়ি যাবে না। একটি বিশেষ ঘোষণা আছে। সকলে একটু অবাক হলো আমার অকস্মাৎ এমন ঘোষণায়। কাজ শুরু হয়েছে সবে মাত্র দিন সাতেক হয়েছে। তারই মধ্যে এরম কি বিশেষ ঘোষণা থাকতে পারে,তা করো বোধগম্য হলো না। কিছুটা কানাঘুষোও হলো। এ কি রে বাবা! কি হবে ? ওভারটাইম করাবে নাতো? এমনকি এমন ও কানাঘুসো করলো যে – বাবু লোক কমিয়ে দেবে। এত মাইনে দেবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

সন্ধ্যেতে কাজ শেষ করে সকলে হাজির হলো আমার ঘরের সামনে ।এত লোককে একসাথে জমা হতে দেখা আমার আগেও অভ্যেস আছে।আমি আমার ঘরের সামনের উচু চাতালের মত জায়গাটায় উঠে বসে সকলের উদ্দেশে কাল রাত্রের আমার ভাবনাটা উপস্থাপন করলাম।

আমি ভাবতে পারিনি আমার ঘোষণায় তারা এমন উৎফুল্ল হবে ।সকলের মুখেই আনন্দের হাসি ছলকে উঠলো।মনে মনে ভাবলাম এরা ছেলেমেয়ের পড়াশুনার ব্যাবস্থা হবে এটা জেনে যত না খুসি তার চাইতেও অধিক খুশি করো চাকরি বা মাইনে কম হয়নি এটা জেনে। আমি গ্রামের কতেক জন বয়স্কে কে ডেকে তাদের উপর দায়িত্ব দিলাম সময় মত সমস্ত ব্যাবস্থা করার। তার সাথে আমি বললাম আমার সন্ধ্যা ভ্রমণের সময় দেখা বাচ্চা মেয়েগুলোর কথাও। বললাম তারাও যেনো বাদ না পরে এটা খেঁয়াল রাখতে।

হঠাৎ গ্রামবাসীরা জেনেও দুহাত পিছনে সরে গেলে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত নিস্তব্দতা যেন ভেঙে চুরমার হলো মুহূর্তে।সবাই একসাথে যেন প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলো না বাবু এ হয় না।

চরের মেয়েগুলোর কথা বলতে যে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া জুটবে তা আমি আঁচ করে উঠতে পারিনি। সাথে সাথে মনের মধ্যে বড়োই কৌতূহলও জন্মালো। যে হটাৎ  এমন কি হতে পরে যার জন্য গ্রামের সকলে একবাক্যে কেঁপে গেলো।আমি এবার একটু কৌতুহলের বসেই এক পা এগিয়ে এলাম।প্রবীণ সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললাম কি হলো? আপনারা এমন কেনো বলছেন? ওরাও তো আপনাদেরই গ্রামের বাচ্চা, সকলে যদি পড়াশুনা করে, তাহলে ওরা কেনো বাদ যাবে? কি দোষ ওদের?”

পিছিয়ে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে বললো ” আপনি ওদেরকে বাদই দিন। ওরা অশুভ!

আমি উৎসুক  দৃষ্টি। তে বললাম – অশুভ? কিন্তু কেনো? একজন বয়স্ক মহিলা আমার দিকে একটু বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে ফের একবার ভিড়ের মধ্যে এক ঝলক দৃষ্টি চালিয়ে  নিয়ে নিচু গলায় বললো – “আপনি নতুন একানে। আপনি জানেন না কিছু। ওদের সাথে নিলে বিপদ বাড়বে! “

আমি যেন মুহূর্তে মুহূর্তে আরো বেশি করে অবাক হচ্ছিলাম তারপর একটু স্বাভাবিক হয়ে ভারী গলায় বললাম  – “আপনারা আমায় সবটা না জানালে , আমার কিছু করার নেই। আমি ওদের কে পড়াশুনার জন্য ডাকবোই, আপনারা নিজে ডেকে আনলে ভালো, যদি না পারেন তাহলে আমি নিজেই যাবো ওদের কাছে। “

বুঝলাম আমার কথায় কাজ হয়েছে। ক্রমেই যেনো  আমার ঘরের সামনের ভীড়টা পাতলা হতে গেলো। মনে হলো যেন এমন কিছু ঘটনা এর পেছনে আছে। যা এরা বলা তো দুর শুনতেও ভয় পায়। এমতাবস্থায় আমার কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছিলাম না । কিন্তু এদিকে মাথায় যেন রোখ চেপে গেছে। কিছুতেই সবটা না জেনে ছাড়ব না। মানুষ যখন সবচাইতে অসহায় পরিস্তিতির মধ্যে পরে , হয়ত তখনই তার মনের মধ্যে সবচাইতে বেশি আত্মরক্ষার কৌশল জেগে ওঠে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। আমি ক্রমে পাতলা হতে আশা ভিড়ের মধ্যে থেকে সবচাইতে বয়স্কও একজনের হাত চেপে ধরলাম। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম  – আপনি এখানে সবচাইতে বয়স্ক আপনার জানা নেই এমন কিছু নেই , সকলে চলে গেলেও আপনি আমায় নিরাশ করবেন না। আমায় সবটা বলুন , আমারও জানা দরকার। আমি এখানে কাজ করতে এসছি, পরিবার পরিজন ছেড়ে , কিছু হয়ে গেলে?

বুঝলাম কথায় কাজ হয়েছ। ভদ্রলোক কি বুঝলেন জনিনা, সকলের থেকে একটু সরে এসে তিনি একবার আমার দিকে দেখলেন। তারপর তার জরাজীর্ণ পায়ে একপা দুপা করে এগিয়ে এলেন ঘরের ভেতরের দিকে। এতদমধ্যে যে ভীড়টা আমার ঘরের কাছে কিছুক্ষন আগেই জমা হয়েছিলো নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেলো। সকলেই একটা অজানা কিছু ভয়ে সরে গেলো। যেন ভিড় টা আর নেই দেখেই ভদ্রলোক একটু বুকে বল পেলেন। আমার ঘরের দাওয়ার উপর বসে একটা বিড়ি পকেট থেকে বের করলেন।তারপর সন্তর্পনে সেটাকে জ্বালিয়ে দেশলাইটা পকেটের ভেতর পুরে দিয়ে একগাল ধোয়া বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে হাঁটু দুটো জড়সর করে , কিঞ্চিৎ যেনো নিজেকে কুঁকড়ে নিয়ে তারপর শুরু করলো ..

বাবু আপনি শহরের মানুষ, জানিনা কতটা বিশ্বাস করবেন এসবের কিন্তু এ বড়োই নিষ্টুর কাহিনী। এ কাহিনী আজকালকার নতুন ছোকরাদের ও বিশ্বাস করতে সময় লাগে। বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে আপনি এর বিচার করতে পারবেন না। কিন্তু এ ঘটনা পুরো ভাগ সত্যিই ।আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। তখন ইংরেজরা এদেশে পূর্ণদম্ভে শাসন শোষণ করছে। সমস্ত ভারত জুড়ে তাদের সে দোদণ্ড প্রতাপ রাজত্ব। নীলচাষ বন্ধ হতে গেছে তাও প্রায় সত্তর বছর।কিন্তু বাংলার বুকে নীল সাহেবরা তখনও মরে যায়নি। নীলকর সাহেবদের উপরও ইংল্যান্ডের রনির শাসন চলতো বটে কিন্তু। তা কেবল এ নামে মাত্র। বাংলার বুকে নানান জায়গায় নীলকর সাহেব বা তার পরিবারের এক অলিখিত শাসন চলতো। অন্যান্য সাধারণ সাহেব দের থেকে তাদের টাকা পায়সা প্রভাব প্রতিপত্তি সবই যেনো একটু বেশিই ছিলো। শুধু সরকারি হিসেবে তারা ক্ষমতার অলিন্দ ছিলনা, কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষ দের সেই দোদণ্ড শাসন, অত্যাচার আর আর তার সাথে কিছু ছোট ছোট জমিদারের সম্বলিত শাসন যেন তখনও প্রজাদের উপর  একা গাঢ় দীর্ঘশ্বাসের কালো ছায়া ফেলে রেখছিল। থানা পুলিশ আদালত সবই ছিল , কিন্তু সত্যিই বলতে কারোরই বুকে সে সাহস ছিলনা সেই অবধি পৌঁছায়।

এত অবধি বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন, তারপর আরো কয়েকবার বিড়ির সুখটান নিয়ে আবার বলল – দামোদর তখন সেই রকম ভয়ংকরতার সাথে বাংলার বুক চিড়ে বয়ে চলছে। প্রতিবছরই বরষায় তার উপচে পড়া জলে দুই কুল ভেসে যায়।তখন এদিকটায় এতো চড় ছিলো। না।ছলছল করে তার বুক দিয়ে জল বইত।দামোদরের ভয়ংকর গ্রাসের ভয়ে কেউই তার দুপাশে বসবাস করার সাহস পায়না। তবে হা শুধু একঘর কলোনিরই সাহস হয়েচিল সেই চড়েও ঘর  বেঁধে বাস করার। অসম্ভব তাদের সাহস। তেমনি অসম্ভব তাদের মাছ ধরার কৌশল।

আদিবাসী না অন্য কিছু, কি জাত ,কেউ  কিছু জানত না। সব কিছুই তাদের আলাদা। আচার বিচার অনুষ্ঠান সব আলাদা।

এতক্ষণ আমি চুপ করে শুনছিলাম। এবার কৌতূহলের বসে বলে ফেললাম ” তাহলে ঐ বাচ্চা মেয়েগুলো কি ওই কলোনির?আমার চোখে উত্তর পাওয়ার খিদে  যেন জ্বলতে লাগলো। ভদ্রলোক একবার আমায় দেখলো ।একটু থামলেন, ঢোক গিলে বিড়ির শেষ সুখটানটা নিয়ে মাথা নাড়িয়ে শুধু ইসারা করলো হু।ওরাই একমাত্র বাস করতো।

আমার কৌতুহল দেখে ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন – এভাবেই বেশ কাটছিল একঘর দুইঘর করে বেশ কিছু ওদের কলোনির লোক এলো বাস করতে ওই চড়ে।

ফাঁকা চড়‌ যেন আস্তে আস্তে মাথা চারা দিয়ে উঠছিলো। অল্প অল্প করে তারা চাষ বাস ও শুরু করলো। ছোট ছোট জায়গা জুড়ে ধান আলু চাষ হতে শুরু করলো

আমি কখনো বিড়ি খাইনা। কিন্তু উত্তেজনা যেন আমার অলিন্দ নিলয় এর মধ্য দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো।খানিকটা নেশার ঘোরেই একটা বিড়ি জ্বালিয়ে বললাম তারপর? ভদ্রলোক বলে যেতে লাগলো – জানেন বাবু এটাই ওদের কাল হলো! ভদ্রলোকের গলা ধরেছে।গলা যেন ক্রমেই ভারী হতে শুরু করেছে। বুঝতেই পারলাম উনি যেন স্মৃতির মেঘ গুলো আবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।

দৃষ্টি স্থীর রেখে ভদ্রলোক বললেন – হটাৎ একদিন নীলকর সাহেবের কোনো এক পরিবারের কোনো এক যুবকের চোখ পরলো সেই চড়ের দিকে।প্রথমটায় তেমন গুরুত্ব দিলো না কেউই।বেশ কিছু দিন পর বসত বাটি বাড়তে থাকায় আর চাষ বাস যেই ভালো রকমের হতে শুরু করলো একদিন সেই ইংরেজ এলো ঘোড়ায় চেপে। সমস্ত চড় ঘুরে দামোদরের জমিদারের কাছে গিয়ে জানাল পুরো ব্যাপারটাটা।জমিদার ও পালকি চেপে লোক জন নিয়ে এসে ঘুরে গেলো চড়ের এ প্রান্ত। জমিদার খাজনা লোভী হলেও নদীর বুকে একফালি চড়ে বসবাসের জন্য খাজনা আদায়ের কোনো ফরমান জারি করল না। হয়ত দামোদরের এ চরের মূল্য তার চোখে তেমন ভাবে পরলো না,কিংবা সে সেই জনজাতি সম্পর্কে কিছুটা জন্য আগে থেকে। কিন্তু বাধ সরল সেই ইংরেজ। সে বিলেতের লোক , নদী চড়ের খেতী সম্পর্কে সে সব জানত। সে এসে ফরমান জারি করল, নদী চড়ে যারা বসবাস করে তাদেরকে আলাদা করে খাজনা দিতে হবে সেই ইংরেজকে। যদি কেউ খাজনা দিতে না পারে তাহলে তার এই চড়ে বসবাস সম্ভব নয়। জমিদারের খাজনার চাইতেও সে খাজনা কতেক গুন বেশি। যথারীতি চড়ে গজিয়ে ওঠা কলোনির মধ্যে চাপান উতোর শুরু হলো।

কেউ জানত না তারা কোথা থেকে এখানে এসেছে ।শোনা যায় তারা নাকি পাহাড়ি দেশের কোনো এক জায়গায় আগে বসবাস করতো। এখানকার নীয়ম কানুন তারা জানত না। তাদের পক্ষে জমিদারের কাছে যাওয়াও সম্ভব ছিল না, কারণ জমিদারের প্রজাদের মধ্যে তারা পরে না। আর নদীর ধারের এই নতুন গজিয়ে ওঠা চরের উপর এখনো অবধি কোনো শাসকের শাসনও ছিল না। উদ্বৃত্ত একফালি জমিকে সবাই উপেক্ষা করতো।কিন্তু সেই ইংরেজ ছাড়ার পাত্র নয়। বন্যা হোক, ভেসে যাক আর যাই হোক জমিতে থাকতে হলে তাকে ভাগ দিতে হবে এই ছিল তার বিধান।

কলোনির লোক এত সাতপাঁচ কিছু বোঝে না । তারা যেন উপেক্ষা করে গেলো সেই সাহেবের ফরমান।কয়েক মাস অপেক্ষা করার পর সেই ইংরেজও এক এক করে ডেকে পাঠালো সব কটি ঘরের মালিকদের।শুরু হলো তাদের উপর নির্যাতন।প্রথম প্রথম শুধু মারধর, তাতেও কাজ না হওয়ায় আগুনে পুড়ি়য়ে দেওয়া হতে লাগলো ঘরবাড়ি খামার গুদাম ঘর পশুপাখি। কয়েকঘর মানুষ কিছু কিছু ভেট নিয়ে ইংরেজ এর কাছে দিয়ে শান্তি কিনতে চাইলো বটে কিন্তু তাতেও কিছু হলো না। জমিদার যেন সব দেখেও না দেখার অভিনয় করে গেলো, এই জমি তে তার কোন আগ্রহ ছিলো। না। তাই সেদিকে তার দৃষ্টি না দিলেও চলবে এই ভেবে চুপ করে রইলো। আর এদিকে সেই ইংরেজ এর অত্যাচার যেনো ক্রমেই বেড়ে বেড়ে দ্বিগুণ তিনগুণ হলো। দামোদরের এই চড় হলে গেলো ইংরেজের কাছে প্রতিশোধের আখড়া। শুরু হলো নির্যাতন। প্রথম প্রথম জোর করে ফসল কেড়ে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো, তারপর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা ক্রমে তা বেড়ে বেড়ে এমন একটা জায়গায় এসে দাড়ালো যে শেষে কিছু না পেলে জোরপূর্বক ঘর হতে যুবতী নারী ও মহিলাদের টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো।অপহরণ যেন হলে উঠলো নিত্য দিনের ব্যাপার।

দৈহিক সুস্বাস্থ্যবতি হলেই রাতের অন্ধকারে তার ঠাই হলে যেতে লাগলো সেই ইংরেজ এর নৈশ আসর ঘরে।এমন কি কখনো কখনো তো কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তার দেহ কদিন পর ঠিক ওই দামোদরের জলে পাওয়া যেত। নিত্য নতুন যেন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই যেতে লাগলো।

বয়ষ্ক ভদ্রলোক একসাথে এতটা কথা বলে যেন হাঁপিয়ে গেছিলো।একটু হাফ ছেড়ে কেসে নিয়ে তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলল – এরপরই শুরু হলো সেই অভিশপ্ত সময়।ইংরেজের অত্যাচারে নির্যাতিত, অতিষ্ট হয়ে কয়েক ঘর বাসিন্দা চড় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু সবাই তি পারলো না। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তারা বেছে নিলো প্রতিবাদের ভাষা।

চড়ের বাসিন্দারা আসলে কে , কি জাত, কি তাদের আচার বিচার ,  তাদের দেবতাইবা কি , অনুষ্ঠান এর নিয়ন কি এসব কিছুই সে সময় অন্যান্য দের কোনো ধারণা ছিলো না। আর ঠিক সেই বারেই ঘটলো সে মহা সাংঘাতিক ঘটনা, মহাপ্রলয়। চড়ের সমস্ত মানুষ জড়ো হলো নদীর ধারে। সময় টাও ঠিক এই শ র ত এর মতই।

নদীর ধারে ধারে কাশের বনে সাদা সাদা কাশ ফুল মাথা দুলিয়ে দেবীর আগমনের বার্তা দিচ্ছিল।ঠিক সেই সময়ই তারা এক কৌশিকী অমাবস্যার রাতে দামোদরের মাটি দিয়ে গড়ে তুললো এক ভয়ংক র মূর্তি। দামোদরের তীরেই তার প্রতিষ্টা হলো। রাতের অন্ধকারে শুরু করলো তার পুজো। সারারাত ধরে সেই পুজো হলো।বলি দেওয়া হলো এক হাজার ছাগল শাবক, ও পঞ্চ নরমুন্ড। সারারাত ধরে মাদল বাজিয়ে সম্পূর্ণ পৈশাচিক পদ্ধতিতে যজ্ঞ করে বেশ ধুমধাম এর সাথে সারা হলো সেই পুজো।

বিভৎস সে দেবী মূর্তি। ঠিক যেন দুর্গা প্রতিমার মত দসভূজা।এক হাতে নরমুণ্ড, এক হাতে খড়গ, এক হাতে বর্ষা, একহাতে তির ধনুক।লাল জিভ বের করা কালো চোখের জলন্ত  সে প্রতিমূর্তি।সে মূর্তির রপ দেখলে আজও মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়।এভাবেই সেই মূর্তির পুজো সেরে পরদিন দামোদরের জলেই ভাসিয়ে দেওয়া হলো সেই প্রতিমা। ঠিক যেমন আমাদের বিসজ’ন হয় ঠিক তেমনি।

মুখ থেকে আপনা আপনি যেন তারপর কথাটি বেরিয়ে এলো।প্রবীণ ভদ্রলোক তারপর বলল – তারপর শুরু হলো সেই মহাপ্রলয়। শুক্ল পক্ষের যে প্রথম ভোরে সেই প্রতিমা নদীর জলে বিলীন হলো।ঠিক তার দশদিন পর। দশমীর রাত্রে দমদর যেন কালনাগিনীর মত ফণা তুলে গর্জে উঠল। শরৎ এর সেই কোমল রাত্রে শুকিয়ে আসা নদীটা যেন আকাশ প্রমাণ ঢেউ নিয়ে ভাসিয়ে দিল তার দুই কুল। তছনছ করে দিল তার বেলাভূমির সমস্ত অস্তিত্ব ।খর কুটর মত ভেসে গেলো দুই তীরের আস্তানা।নদীর গর্ভে একে একে  দুই পাশের সমস্ত গ্রাম শহর ভেসে গেল, ভেসে গেল সেই জমিদাড়ির অর্ধেক আর সেই ইংরেজ এর সমস্ত টা।

মনে মনে ভাবলাম তাহলে তো সেই কলোনিও নিজেকে নদীর গ্রাসে আহুতি দিয়েছে। ভদ্রলোক যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই উত্তর দিল – সব শেষ হলো, কিন্তু শুধু রয়ে গেলো ওই এক টুকরো কলোনি । সেই থেকে আজ একশো বছর। সময়ের সাথে সাথে নদী শুকিয়েছে। চড় বড় হতে হতে আজ এত বড় হয়েছে। বসত বাড়িও আবার গড়ে উঠেছে দুদিকে। দেশ স্বাধীন হযেছে । ইংরেজও এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ক্রমে যেন সেই অভিশপ্ত কলনিও আয়তনে কমেছে অনেক। কিন্তু একেবারে শেষ হয়নি। আজও কয়েক ঘর থেকে গেছে।  তারা আজও বেঁচে আছে ।কোনো এক অলৌকিক শক্তি যেন তাদের আজও বাঁচিয়ে রেখেছে।

ভদ্রলোক একমিনিট চুপ থেকে তারপর বললো – অলৌকিক নই ,  আসলে পৈশাচিক শক্তি ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে এখনো। ওরা অশুভ সাধনার সাধক। বাবু আপনি ওদের থেকে দূরে থাকেন। এই বলে ভদ্রলোক শেষ করলেন।

    ################

পরদিন খুব সকালে আমি প্রকল্পের কাজে না  গিয়ে সোজা গিয়ে পৌঁছলাম সেই নদিচড়ে। একটু খোঁজাখুঁজির পরই খুঁজে পেলাম সেই বাচ্চা মেয়েগুলোকে। আমাকে দেখে ওরা যেনো একটু অবাক হল। হয়তো এখানে কেউ অনেক দিন আসেনি তাই হয়তো ওদের চোখে আরো একটু বিস্ময়। দু একঘর আরো খুঁজে তারপর খুঁজে বের করলাম সেই দেবীর মত ছোট্ট মেয়েটিকে। ডেকে কাছে বসালাম। কোনো কিছু না জানার মত করেই জিজ্ঞেস করলাম – নাম কি?

খুব শান্ত স্মিত কোমল গলায় সে উত্তর দিল – দুর্গা। 

দুর্গা নামটা শুনেই আমি যেনো আরো অবাক হলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। খেয়াল করলাম তার সেই চোখ যেনো মায়াবী এক বন্ধন। আগুনের মত জ্বলন্ত। খুব বেশিক্ষণ সে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিয়ে আবার বললাম – তোর ঘর যে পুরো ফাঁকা। কেউ নেই তোর ঘরে? তোর বাবা মা কোথায়? সকলে ছাগল চড়ায় তুই চড়াস না? স্কুলে যাস? 

কৌতূহলের বসে বলে চলা আমার এত  গুলো প্রশ্ন শুনে সে যেনো একটু চঞ্চল হতে হয় উঠলো। তারপর ধীর গলায় আবার বলল – না আমার কেউ নাই! শুধু এই সখিরাই আছে আমার। অন্যান্য মেয়েদের দেখিয়ে বললো এই এরা সব আমার সখী। আর ওই সব ওদের ছাগল ছানা। প্রতি বছর ছাগল গুলো বাচ্চা দেয়। ওদের কেই ওরা ওই মাঠে চড়ায়। এরা কেউ স্কুলে যায়না। আমিও যাইনা। যেতে হয় না। এই ছাগল শাবক গুলো যখন বাড়তে বাড়তে পুরো এক হাজার হবে, আমার সখিও পাঁচ জন  হবে। সেদিন আবার পুজো হবে এই নদীর চড়ে। আমরা সেইদিন টা র জন্য অপেক্ষা করে আছি।

বুকটা হটাৎ চ্যাট করে উঠলো। আমি ভয়ে সরে এলাম একটু । যেনো একটা না শুনতে চাওয়া কথা শুনে ফেলেছি। ভয়ে কাপা কাপা গলায় বললাম  – পুজো? কি পুজো?

সরল একটা মিষ্টি হাসি খেলে গেল মেয়েটির মুখে।

অনাবিল খিল খিল হাসিতে নদিতট কেপে উঠলো। কানে যেন একটা মায়াবী গলা ভেসে এলো   – কিচ্ছু জানে না। বোকা ছেলে আমার, কার পুজো আবার? দূর্গা পূজো আমার পুজো।

দামোদরের ঢেউ যেনো আছরে পড়ারা শব্দ হতে লাগলো নদীর তীরে। ফোঁস ফোঁস করে ঢেউ এর শব্দ যেনো ভেসে যাচ্ছিল বাতাসময়। দূরে নদীর ধার ঘেঁষে কাশের বন গুলো যেনো মাথা দুলিয়ে আগমনীর বার্তা দিচ্ছিল। পূব আকাশ যেনো ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছিল। 

মহালয়ার সেই মনোমুগ্ধকর কণ্ঠ যেনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সমস্ত আকাশ বাতাস জুড়ে – 

আশ্চিনের এই আনন্দ মোহে……

সৃষ্টির শ্রী বিনাশিনি ……

দেবী দূর্গা……..

                     ~~   সমাপ্ত ~~

কলমে : প্রসেনজিৎ ঘোষ

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল