আমরা এবার মখমলি সবুজ ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে চলেছি মাঠের উত্তর দিকটায় । গোটা স্টেডিয়ামটা আজ ফাঁকা , অথচ কাল ফাইন্যালে গোটা স্টেডিয়ামে লোক গিজগিজ করবে । মাঠে প্র্যাকটিসে মত্ত কিছু প্লেয়ার । আকাশের গোলাপি রঙটা ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে আসছিল । মাঠের একদম উত্তর প্রান্তে যেখানে স্টেডিয়ামটা শেষ হয়েছে , সেখানে একটা একতলা বিল্ডিং দেখলাম । এটাই ক্রিকেট ক্লাব ঘর ।ছোট হলেও বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর । ভেতরে টিউব লাইট জ্বলছে বুঝতে পারছিলাম । ঝট করে একটা কথা মনে পড়ে গেল , আজ সকালে স্টেডিয়ামে ইন্দ্রদা দূরবীন দিয়ে মাঠের উত্তর দিকটাতে কিছু একটা দেখছিল । আমার মনে হল ইন্দ্রদাকে একবার কথাটা জিজ্ঞেস করে দেখা দরকার । কিন্তু সেটা আর বলতে হল না , ইন্দ্রদার পরের কথা থেকেই সেটা বোঝা গেল ।
“ সুমিত , সকালে একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম জানিস , একটা পাগলাটে গোছের লোক এই ক্লাবটার ভেতরে ঢুকে গেল , তবে কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এল । ”
“ কখন ? ”
“ সকালে যখন তোদের ব্যাটিং চলছিল , সবাই খেলা দেখতে মত্ত ছিল । আমি স্টেডিয়াম থেকে দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করেছি । হতে পারে তোদের চেনা জানা কেউ । ”
“ তাহলে কি … ”
“ এই পাগলটার সাথেই কাল আমাদের পার্কে দেখা হয়েছিল । ও বলছিল , এখানে নাকি চোরাকারবার হয় । আর সেজন্য আমাকে সাবধানও করে দিয়েছে । ”
“ বলিস কি রে ইন্দ্র । শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবার ? ”
“ এখন ক্লাবে গেলে গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহর দেখা পাওয়া যাবে ? ওনাদের কাছে যদি কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যায় । ”
“ কিন্তু ওনারা তো কাল ফিল্ডে আম্পায়ারিং এ ব্যস্ত ছিলেন । ”
“ এদিকে এসেছি যখন চল একটু দেখা করেই যাই । কিন্তু আসল ব্যাপার একদম ফাঁস করবি না সুমিত । এমন ভাব করবি যেন মনে হয় আমরা ঘুরতে এসেছি । ”
( ৪ )
“ বাঃ একদম ঘুরতে ঘুরতে ক্লাবে চলে এসেছেন আপনারা । তারপর বলুন ইন্দ্রজিৎ বাবু দার্জিলিং কেমন লাগছে ? ” … তপেন গুহ বলে উঠলেন ।
আমরা তিনজন ছাড়া ক্লাবঘরের মধ্যে ছিলেন ম্যাচের দুজন আম্পায়ার গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহ । দুজনে চেয়ারে বসে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন । আরো চারজন কমবয়েসি ছেলে কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করছিল । কথায় কথায় জানলাম গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহই এ ক্লাবের হেড । রুমটা খুব অগোছালো । বাঁদিকে একটা র্যাকে হলুদ ফাইল ভর্তি । লাল সিমেন্টের মেঝের উপর কিছু এ ফোর সাইজের প্রিন্ট করা কাগজ ছড়ানো ছেটানো । চার পাঁচটা কম্পিউটার রয়েছে যেখানে বসে কিছু পাহাড়ি যুবক মন দিয়ে কাজ করছে । আসবাবপত্র প্রায় নেই বললেই চলে , তবে অনেকগুলো নীলকমল চেয়ারের ছড়াছড়ি । আমরা আসার পর শ্রীকান্ত বলে একটা বাঙালি ছেলে আমাদের চেয়ার দিয়ে গেল বসবার জন্য । তপেন গুহর প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রদা বলল …
“ দার্জিলিং ঘুরতে আসাটা এবারে আমার প্রথম নয় তপেনবাবু , তবে আমার এই ভাইটির সঙ্গে প্রথমবার । ”
গণেশ ঘোষ ইন্দ্রদার উদ্দেশ্যে বলল … “ আপনিই তো সেবারে দার্জিলিঙে একটা খুনের কেসের সুরাহা করলেন । তখন থেকেই আপনাকে চিনি । তা এবারে দার্জিলিং কি ঘুরতে এসেছেন , নাকি গোপনে কিছু গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন ? ”
“ স্রেফ হাওয়া বদল । তবে এখানে থাকলে কিছু মাথা খেলানোর মত সামগ্রীও জুটে যেতে পারে । আমার এই অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌম্য মনে করে , আমি নাকি যেখানে যাই সেখানেই রহস্যের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় । ”
তপেন বাবু বললেন … “ তা এখানে মানে কি আপনি এই ক্লাবের কথা মিন করতে চাইছেন ? ” … বলেই উনি হাসলেন ।
“ হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে । ” … ঘরের সবাই এখন নিস্তব্ধ , কম্পিউটারের কাছে বসা ছেলেগুলো টাইপ করা বন্ধ করে দিয়েছে । ইন্দ্রদার গলার স্বর হালকা কিন্তু দৃঢ় ।
গণেশ বাবু একটু পরিবেশটাকে সামাল দেবার জন্য কথা ঘোরালেন … “ আপনাদের জন্য চা কফি টফি কিছু বলি ? ”
“ নো থ্যাঙ্কস । আর একদিন এসে দার্জিলিং টি খেয়ে যাবো , বাট নো কফি । সকালের কফিটা বেশ কড়া ছিল । আমরা একটু অসময়ে এসেই হয়তো আপনাদের বিব্রত করছি । তবুও একটা কথা আপনাদের না জানালেই নয় গণেশ বাবু এবং তপেন বাবু … আপনাদের ক্লাবে চোরাকারবার হয় ? ”
“ হোয়াট ? চো রা কা র বা র । ” … গণেশ ঘোষ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছিল । কথাটা শোনামাত্রই চমকে উঠল ।
ইন্দ্রদা বলল … “ কাল একটা খ্যাপাটে গোছের লোক একথা বলছিল । ”
গণেশ ঘোষ আবার চমকে উঠে তপেন গুহর দিকে আড়চোখে তাকালো ।
“ পাগলাটার মাথায় কি টুপি ছিল ? ” … গনেশবাবু জানতে চাইলেন ।
“ হ্যাঁ । ” … ইন্দ্রদা উত্তর দিল ।
“ তার মানে সেই একই পাগলা । ”
“ মানে ? ”
“ হ্যাঁ , কদিন থেকেই লক্ষ্য করছি ক্লাবের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে , ক্লাবের কাছে এসে ঘুরঘুর করছে । এতদিন ব্যাপারটা খতিয়ে না দেখলেও আজ আপনার কথা শুনে বেশ ভাবতে হচ্ছে তো । ”
ইন্দ্রদা আর কথা বাড়াল না । পাগলটা যে ক্লাবে ঢুকেছিল সেকথাও বলল না । টেবিলের উপর থেকে একটা প্রিন্ট করা কাগজ তুলে নিল … টুর্নামেন্টের সমস্ত ম্যাচের লিস্ট । আমিও ঝুঁকে পড়ে কাগজটার উপর দৃষ্টিপাত করলাম । সব ম্যাচই শিবতলা স্টেডিয়ামে । কিছু কিছু ম্যাচ আবার ডে নাইটের । তবে লক্ষণীয় বিষয় হল এটা যে , জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে যে যে দলের ম্যাচ হয়েছে , কোনোটাই ডে নাইট নয় । যদিও ব্যাপারটা অবাক হবার মত কিছুই নয় তবুও আশা করি ইন্দ্রদার সেটা নজরে পড়েছে । আমরা যে ঘরটাই বসেছি তার ঠিক পেছনের দিকে একটা দরজা রয়েছে , দরজাটা খোলা । ইন্দ্রদা ওইদিকে একবার তাকাতেই সুমিত বিশ্বাস বলে উঠল …
“ ঐ ঘরটাতে ক্রিকেটের সব সরঞ্জাম ব্যাট , বল , উইকেট ইত্যাদি রয়েছে । ”
ইন্দ্রদা বলল … “ আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে একবার ঐ ঘরটা দেখা যায় ? ”
ওনারা আপত্তি করলেন না । আমরা ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম । ঘরের ভেতরটা অন্ধকার । তপেন গুহ টর্চ মেরে আলো দেখাচ্ছেন । ঘরে কোনো জানালা নেই তাই আলো প্রবেশ করতে পারে না তাছাড়া বাইরে ততক্ষণ অন্ধকার হয়ে গেছে । আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ইঁদুর জাতীয় কিছু একটা পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল । আমি শিউরে উঠলাম ।
গনেশবাবু বললেন … “ কিছু নয় , এ ঘরে ছুঁচোর উৎপাত আছে । ”
ইন্দ্রদা সবার অলক্ষ্যেই ফিক করে হেসে উঠল । আমি মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম । আবছা টর্চের আলোতেই তপেন গুহ ঘরটার আনাচকানাচ দেখাচ্ছিলেন । ঘরটা একটা গুদাম ঘরের মতই বলা যায় , ভিজে কাঠের সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছিল মাঝে মধ্যে । একজায়গায় দেখলাম পনের ষোলোখানা ব্যাট সাজানো রয়েছে , ভিন্ন ভিন্ন সাইজের , কোনোটা ভারী কোনোটা হালকা । ইন্দ্রদা সব নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো , তারপর বলল …
“ এখান থেকেই প্লেয়াররা ব্যাট সংগ্রহ করে ? ”
গনেশবাবু বললেন … “ হ্যাঁ । তবে কেউ চাইলে পারসোন্যাল ব্যাটও বাইরে থেকে আনতে পারে । ”
ঘরের মধ্যে ছোট ছোট বস্তা রয়েছে দেখলাম , ভেতরে অনেক বল , এক একটা বস্তাতে তাও প্রায় পঞ্চাশ ষাটটার মত বল । টর্চের আলো ফেলতেই বলগুলো দেখলাম কর্কের তৈরি । ইন্দ্রদা নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ দেখল তারপর কি জানি ভেবে মুচকি হাসল ।
ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল … “ সব বল খেলা হয় ? ”
তপেনবাবু উত্তর দিলেন … “ সব হয় না । তবে হারিয়ে টারিয়ে গেলে বল তো লাগে , তার জন্যই … ”
“ বল মাঠে খেলা চলাকালীন কি দিয়ে যাওয়া হয় ? নাকি আম্পায়াররা বল নির্বাচন করে বেছে দেন ? ”
“ বল মাঠে আমরাই নির্বাচন করি । ডিপেণ্ড করে কত ওভার খেলার পর বল হারিয়েছে বা নষ্ট হয়েছে । অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে আমাদের বল সিলেক্ট করতে হয় । ”
এরপর ঘরের উইকেট বেল সব ইন্দ্রদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল যেন কোনো অজানা রহস্যের ক্লু খোঁজার প্রচেষ্টায় রয়েছে । মাঝে মাঝে ইন্দ্রদার আচরণে এবং সুমিত বিশ্বাসের বোকা বোকা কথাগুলো ভেবে বেশ বিরক্তি আসছিল । ম্যাচ হারার কারন খুঁজতেই ইন্দ্রদা এই অন্ধকার দমবন্ধকরা ঘরে তদন্ত চালাচ্ছিল নাকি চোরাকারবারের সন্ধান করছিল সেটাই মাথাতে আসছিল না । ইন্দ্রদাকে এরকম বোকা বোকা রহস্যের পেছনে ধাওয়া করতে এই প্রথম দেখলাম ।
তপেন গুহ বললেন … “ ভাবছি এবারে ফাইন্যাল ম্যাচটা পুরোটাই ভিডিও রেকর্ডিং করাবো । পরের বার থেকে থার্ড আম্পায়ার ডিসিশন মেকিং এরও ব্যবস্থা রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে । ”
ইন্দ্রদা এবার বাম হাতে একটা থাই প্যাড ও ডান হাতে একটা গ্লাভস তুলে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল … “ তাতে আমার সুবিধেটাই বেশি তপেন বাবু । ”
“ মানে ? ”
ইন্দ্রদা মুখে হাসি এনে বলল … “ কারন ফাইন্যালের দিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত নাও থাকতে পারি , জরুরী দরকার আছে । তাই পরে ম্যাচটা দেখতে পাবো । একটা ফাইন্যাল ম্যাচের সি ডি কপি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন তো ? ”
( ক্রমশ:)