যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
একটি বাচ্চা ছেলেও হয়তো বলে দিতে পারবে উক্ত শ্লোকটি কোন মহাকাব্য থেকে পাওয়া যায় । ভুভারতে অনেকেই শুনেছেন এই বহুচর্চিত শ্লোকটি । কিন্তু এই চারটি লাইনে লেখা কথাটির প্রকৃত অর্থ কি ? এটা কি শুধুমাত্র একটি ভবিষ্যদ্বাণী ? নাকি সুজনকে আশ্বাস দেওয়া তথা দুর্জনকে ভয় দেখানোর উপায়মাত্র ? এই আধুনিক যুগে, যেখানে সকলের হাতে হাতে technology চলাফেরা করে, সেক্ষেত্রেও কি এই শ্লোকের অর্থ প্রযোজ্য ?
এবার যদি আমি শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থকে হুবহু বর্ণনা করি এবং সত্য হিসেবে ধরে নিই তাহলে হয়তো এই যুগের বহু মানুষই আমার সাথে সহমত নাও হতে পারেন । এমনকি আমার নিজের মনেও নিজের প্রতি বিশেষ কিছু সন্দেহ জাগবে, যে একই মানুষের বারংবার জন্ম, তথা আগের জন্মের কথাগুলো মনেও থাকা – দুইই কি এখনো প্রমাণিত হয়েছে আদৌ ?
জার্মান শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ বলেছিলেন – “The first gulp from the glass of natural sciences will turn you into an atheist, but at the bottom of the glass God is waiting for you.” অর্থাৎ প্রকৃতিবিজ্ঞানের যতটা গভীরে আমরা ঢুকব, ততই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেশি করে বোধ হবে ।
এই যুগে টিভি , খবরের চ্যানেল অথবা কাগজ এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা সকলেই এমন বহু উদাহরণ পেয়েছি যে সমুদ্র অথবা নদীর জলের মধ্যে বিপদে পড়লে বহু জলজ প্রাণী বিপন্নকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে । ডলফিন, কচ্ছপ, তিমি ইত্যাদি প্রাণীরা শুধু মানুষই নয়, অনেক স্থলজ জীবজন্তুরই প্রাণ বাঁচিয়েছে নিশ্চিত সলিল সমাধির হাত থেকে । মানুষের পোষা বহু জীবজন্তুরা মনিবের ভক্ত হয়ে যাওয়ার উদাহরণও অগুনতি । তার মধ্যে গৃহপালিত, বন্য অথবা জলজ জন্তু সবই আছে । আবার আমরা এও জানি, যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আন্দাজ পশুপাখিরা বরাবরই মানুষের থেকে আগে পেয়ে এসেছে । এইসমস্ত উদাহরণের ওপর ভিত্তি করে আমি পুরাণে কথিত একটি বিশেষ ঘটনাকে যদি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তাহলে আশা করি পাঠকরা আপত্তি জানাবেন না । সেই ঘটনার মূল হল বিষ্ণুর প্রথম অবতার, মৎস্য । আমরা সকলেই গল্পটি জানি, যে প্রথম মানুষ, মনু একটি মাছকে সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং সেই মাছটিই বড় হয়ে মনুকে একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছিল । সময় আসলে মাছটি নিজের প্রকৃত রূপ, বিষ্ণুর রূপ ধারণ করে জানান দেয় যে সেইই এসেছিল মনুর রক্ষার্থে । এবার যদি আমি আধুনিকযুগে পাওয়া সত্যঘটনাগুলোর সাথে মৎস্য অবতারের গল্পটির যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করি , তাহলে আমার স্বল্পবুদ্ধিতে এইই দাঁড়ায় যে মাছটি, সে তিমি অথবা দৈত্যাকৃতি যে কোন মাছই হোক না কেন, বুঝতে পেরেছিল যে একটি দুর্যোগ আসতে চলেছে । তাতে তার জীবনের পরিত্রাতা মনুর ক্ষতি হতে পারে । এবং সেই উদ্দেশ্যেই সে সঠিক সময়ে মনুর কাছে হাজির হয়ে গিয়েছিল । এখন পুরাণের বিভিন্ন অংশে এই কথা পরোক্ষভাবে লেখাই আছে যে এই প্রকৃতিই হল ঈশ্বর । বা ঈশ্বরের একটি ব্যক্ত রূপ মাত্র । তাহলে মাছ থেকে মানুষ সকলেই তো ঈশ্বরেরই অংশমাত্র । এবার যদি সেক্ষেত্রে একটি মাছ আমাকে সলিল সমাধি হবার থেকে, অথবা অন্য কোন ভয়ঙ্কর প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করে, আমি কি তাকে ভালবাসব না ? এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার রূপ কি আমার কাছে ঈশ্বর সম হবে না ? হবেই হবে ।
অর্থাৎ এর থেকে আমি কিছুটা ধারণা করতে পারি যে, উক্ত শ্লোকটিতে যা যা লেখা আছে, তার অর্থ শুধুমাত্রই ধর্ম-অধর্ম অথবা ন্যায়-অন্যায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় , সর্বোপরি প্রযোজ্য প্রকৃতির ভারসাম্যের ওপর । ভারসাম্য যখনই নষ্ট হবে, তখনই কোন না কোন বড় দুর্যোগ আসবে, তা বন্যাই হোক, ঘূর্ণিঝড়ই হোক, অথবা কুরুক্ষেত্র থেকে শুরু করে কার্গিল অবধি যেকোন ভয়াবহ যুদ্ধই হোক । এমনকি অত্যাধিক জনসংখ্যার প্রভাবে এবং মানুষের অহমিকা আর মুর্খামির ফলে মহামারীর রূপ নেওয়া পরজীবী জীবাণুও তারই উদাহরণমাত্র । সেই দুর্যোগের মাধ্যমেই নিজেকে ঠিক করবে প্রকৃতি নিজেই । আর যখন সেই ভারসাম্য অতীব ভয়ঙ্করভাবে নষ্ট হবে, অর্থাৎ প্রকৃতির নিজেরও কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে, তখনই মৎস্যপুরাণের কথা অনুযায়ী পৃথিবীর সলিল সমাধি সত্য হতে পারে, অথবা ইতিহাস বইতে লেখা তুষারযুগ । আর সেই সময়ে যেইই আমাদের রক্ষা করবে, সেইই ঈশ্বরসম ।
———-*———-*———-*———-*———-*———-