স্বাধীনতা দিবস: তৃতীয় পর্ব

প্রসূন রঞ্জন দাসগুপ্ত
5 রেটিং
1370 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

নয়

পুরনো সব স্মৃতি

14 ই আগস্ট, 2000 ,রাত 11.30

অন্ধকার রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে গাড়ি ছুটে চলেছে, দেবা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে বাঁহাতে একটা সিগারেট নিয়ে উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামবাজার পার্টি অফিস থেকে ফোন এসেছিল, দেবার ছেলে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে, হাতের শিরা কাটা অবস্থায় ওকে কলেজের হস্টেলে দেখতে পায় বন্ধুরা , ওরাই হাসপাতালে খবর দেয়, সেখানে পার্টির একজন দেবাদার ছেলেকে চিনতে পেরে পার্টি অফিসে খবর পাঠায়, ও সেখান থেকে ফোন করা হয়।

           দেবার ছেলে বাবান কে নিয়ে, ওর খুবই গর্ব ছিল, খুবই ভালো ছেলে ও, বাবার কাজের বিন্দুবিসর্গের সম্বন্ধেও জানে না বাবান, আর দেবাও চায়নি তার ছেলে এই লাইনে আসুক, তাই ছোট বেলা থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের বোর্ডিং স্কুলে পড়িয়েছে ছেলেকে, যদিও বাবানের মায়ের সাথে ডিভোর্সের পর অনেকের সাথেই মেলামেশা ছিল দেবার আর এই সব কাজের ও পার্টির সমস্যার জন্য বাড়ির পরিবেশ সুস্থ ছিল না। তাই বাবান কে সে রেখেছিল সবকিছুর থেকে দূরে। বাবান ছিলও মিশনের এক আদর্শ ছাত্র, পড়াশোনার পাশাপাশি গান, ছবি আঁকা ইত্যাদি সবকিছুতেই সে সেরা ছিল, দেবার তো ভয় হত ছেলে সন্ন্যাসী না হয়ে যায়, সেই ছেলের এই অবস্থা কি করে হল, কিছুতেই দেবার মাথায় আসছে না।

           চোখ বন্ধ করে দেবা পুরনো দিনের কথা ভাবতে লাগলো । ছোট বেলায় ও থাকতো বাগুইআটিতে এক কাকার সাথে বাবাকে খুব বেশী পায় নি , স্কুল শেষ করার পর ওরা চলে আসে দমদমের কাছে ।ওর বাবার অনেকগুলো ব্যবসা ছিল যেমন সার,আয়ুর্বেদিক ওষুধ , ফিনাইল ও বাথরুম পরিস্কার করার অ্যাসিড ইত্যাদি। এসব নিয়ে বাবা সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতেন, এর মধ্যে বাবা আবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সব মিলিয়ে ঘরে বাবার না থাকার ও পয়সার অভাব না থাকার জন্য দেবা ছিল বন্ধুমহলের হিরো। তারপর যা হওয়ার তাই হল, সঙ্গ, কুসঙ্গে পরিনত হতে দেরি হল না। প্রথমে বিড়ি, তারপর সিগারেট, মদ-গাজা হয়ে দেবা হাত পাকালো পাউডারে। সেই সময়ে দেশের এক অংশে ছিল হিপি কালচার। ঘুরতে যাওয়ার নাম করে দেবা ওদের সাথে গিয়ে মিশত এবং ওদের হাত ধরেই ড্রাগের নেশা হয় এবং শুরু হয় অবাধ যৌনাচার। সততই এসবের জন্য প্রয়োজন হল প্রচুর টাকার, দেবা শুরু করলো বাবার থেকে পয়সা সরাতে। একদিন যথারীতি ধরা পরে গেল ও প্রচুর বকা খেল। বাবা বলে দিলেন আর পড়াশুনা হবে না তাই ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে, কিন্তু এমন সময় ত্রাতা হয়ে দেখা দিলেন বাবার ম্যানেজার সাহিল চাচা। উনি বাবাকে বললেল “দাদা উঠতি বয়সের ছেলে ভুল করে ফেলেছে, এযাত্রায় ক্ষমা করে দিন, আমায় দায়িত্ব দিন আমি ওকে ব্যবসার সব শিখিয়ে দেব, আপনি দিনদিন যা ব্যাস্ত হয়ে যাচ্ছেন একদিন ওকেই তো হাল ধরতে হবে”।

           এই ভাবে সাহিল চাচার তত্ত্বাবধানে মাস ছয়েকের মধ্যেই দেবা ব্যবসার ঘাঁতঘোঁত সব বুঝে গেল। ওদের কারখানা গুলো ছিল গ্রামে ও সব জিনিস প্যাকিং ও লেবেলিং হত কলকাতায়। কিন্তু যার একবার নেশা হয়ে গেছে, নেশা তাকে টানবেই, দেবা শুরু করলো ব্যবসা থেকে পয়সা সরাতে, যথারীতি কিছুদিন যেতে না যেতেই সাহিল চাচার কাছে ধরা পড়লো, দেবা বেশ ভয়ে ভয়েই ছিল কিন্তু সাহিল চাচা ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল “ আমি জানতাম এই দিন টা একদিন আসবেই, দেখ অতিরিক্ত টাকা যদি রোজগার করতে হয় তবে সোজা রাস্তায় হবে না ব্যকা রাস্তা ধরতে হবে, পারবি কিনা বল “? দেবা সেবার বুঝতে পেরেছিল সাহিল চাচা দেবার বাবার ব্যবসার নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আসলে ড্রাগের ব্যাবসা করে, এবং সেই কারনেই বাবার ছায়াসঙ্গি হয়ে থাকে। দেবা শুরু করলো সেই ব্যবসা, এবং সাবলীল ভাবে মানিয়েও নিল, হাতে পয়সা আসতে লাগলো, সেটা ছিল উত্তপ্ত 70 এর দশক , ড্রাগের পাশাপাশি শুরু হল অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসা । সে সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শরণার্থী এপার বাংলায় আসছিলো, পরের ব্যবসা শুরু হল মেয়ে পাচারের, সব ব্যবসাই ছিল সাহিল চাচার মস্তিষ্কপ্রসূত দেবা ছিল শুধু সহকারী। এদিকে আবার আসল ব্যবসা বাড়ানোর জন্য শুরু হল আয়ুর্বেদিক ওসুধে অল্প করে নেশার জিনিস মেশানো। তবে ব্যবসা যত বাড়তে লাগলো, প্রতিপক্ষ ও বাড়তে লাগলো। একদিন দেবারা ক্লাবে আড্ডা মেরে ফিরছিল এমন সময়ে ওদের ওপর হামলা হল, দেবা অল্পের জন্য পালিয়ে বাঁচল কিন্তু সাহিল চাচা পালাতে পারলেন না, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল ওনার।

           দেবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, কয়েক সপ্তাহ ঘর থেকে বেরতেই পারলো না, মাস দুয়েক বাদে ইজাজ নামে একজন অল্পবয়স্ক ছেলে বাড়িতে দেবার সাথে দেখা করতে এলো, জানা গেল ইজাজ সাহিল চাচার ভাগ্নে কিন্তু ওনার ছেলের মত সে বলল “ দাদা আমি জানি মামু আপনার গুরু ছিলেন, ওনার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে”। দেবা জানল ওরা প্রস্তুত হয়েই এসেছে, 10-12 লোক, এবং অস্ত্র সবই আছে খালি দেবাকে দরকার বিরোধী পক্ষের ছেলেদের শনাক্ত করার জন্য। দেবা বলল “ প্রতিশোধ তো আমিও চাই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জানোই এখন আমাদের এখানে পুলিশের কি কড়াকড়ি হয়েছে, যে লাশ গুলো পরবে, সেগুলর কি ব্যবস্থা হবে? আমি চাই না কোনভাবেই পুলিশ এখানে চলে আসুক, পরিবারের কোন সম্মানহানি তো হতে দেওয়া যাবে না”। ইজাজ হেসে বলল “দাদা সে নিয়ে চিন্তা করবেন না আমাদের আরেকটা ব্যবসা আছে যেটা আমি দেখি, মামু ওটার সম্বন্ধে হয়ত আপনাকে বলার সময় পাননি”।

           এমন সময় রাস্তার ধারে একটা খোলা পাবলিক বুথ দেখে দেবা নেমে পার্টি অফিসে ফোন করলো ও জানতে পারলো ছেলেকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। আবার যাত্রা শুরু হল।     

দশ

কথোপকথনঃ 2

5 ই মার্চ, 2000 , সকাল 9.00

এরমধ্যে ইন্টারভিউ এর কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েছে, সুধাংশুশেখরের ছোটবেলা, বেড়ে ওঠা ও পড়াশুনা শেষ করে এক দাদা ও কয়েক বন্ধু মিলে বাবার অমতেই লঞ্চে করে কলকাতা এসে বাগবাজারের মেসে এসে থাকা অব্দি গল্প এগিয়েছে।

সুধাংশুশেখর বলে চললেন “ তখন আমরা মেসে থাকি , চারিদিকে বিভিন্ন বাবু দের বাড়ি আর সেখানে অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো সারাবছর, আর সেসব অনুষ্ঠানে ছোট খাট কাজ পেয়ে যেতাম, যার ফলে খাওয়া পরার অভাব ছিল না । আর বড় বড় পালাকার, নাছিয়ে-গাইয়ে ও নাট্যকার এর কাজ কাছ থেকে দেখার ও সেখার সুযোগ ছিল। আমরা সেসব দেখতাম আর মেসে ফিরে গিয়ে রিহার্সাল করতাম। বেশ কয়েকটা নাটক পুরো মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। “

সঙ্গীতা বলল “সত্যিই দারুন ব্যপার , তো স্যার সেই সময় কি শুধুই এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না অন্য কিছুও করছিলেন ?”

সুধাংশুশেখর হেসে বললেন “ বুঝতে পেরেছি তুমি কি শুনতে চাইছ, হ্যাঁ বাড়ি বাড়ি অনুষ্ঠানে যাওয়ার অন্য উদ্দেশ্যও ছিল , তোমায় তো আগেই বলেছিলাম পূর্ববঙ্গে থাকতেই ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতি আমার খুবই আগ্রহ ছিল, এদেশে এসেও যুগান্তর গোষ্ঠী তে আমার যাতায়াত ছিল, তখন 1936-37 , গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র মতভেদ চলছিল কেউ কেউ ছিলেন চরমপন্থী মতের বিশ্বাসী আর বেশিরভাগেরই মত ছিল গান্ধীজীর পথেই আন্দোলন চলা উচিৎ। আমরা তরুন রা একটু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলাম যে কোন পথকে সমর্থন করবো। তবে আমার একটা বিশেষ কাজ ছিল বিভিন্ন সভায় কোন কোন সাহেব অতিথি হয়ে আসেন ও ইংরেজদের অনুরাগী কোন কোন বাবু আসেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন সভায় পৌঁছে দেওয়া।

সঙ্গীতা বলল “ আরে স্যার আপনি তো পুরো স্পাই ছিলেন দেখছি “।

সুধাংশুশেখর বললেন “ ওসব স্পাই টাই কিছু না, দেখ আমার কাজ ছিল অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মত, আমি অভিনয়-গান করতে ভালবাসতাম, ওসব করতে করতেই একটু খবরাখবর আদানপ্রদান করা এই তো কাজ। যাইহোক সময় এগিয়ে চলল 1938 এ অনুশীলন সমিতি ভেঙ্গে গেল তারপর 1939 এ সুভাষবাবু গঠন করলেন ফরোয়ার্ড ব্লক তবে আমার মনে হয়েছিল কংগ্রেসে থাকাই শ্রেয় । ওই বছরই একটা অসাধারন নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, সেটা হল শিশির ভাদুরির চানক্য, আহা সে দৃশ্য যেন এখনও মনে লেগে আছে, যাই হোক তার পরই ঠিক করলাম ওনার সাথে দেখা করতেই হবে। তো একদিন সে সুযোগ এলো, বাগবাজারে এক বাড়িতে উনি অতিথি হয়ে এসেছিলেন, সেখানেই ওনাকে আমার কাজ সামান্য দেখাতে পেরেছিলাম, এবং একদিন উনি ডেকে পাঠালেন এবং ওনার ছত্রছায়াতেই আমার থিয়েটারে অভিনয় শুরু হল” ।

সঙ্গীতা বলল “ আর তার সাথে কি আপনি স্পাই এর কাজ চালিয়ে গেলেন ? “

সুধাংশুশেখর বললেন “ সে তো বটেই আমি কংগ্রেসের অধিবেশনেও যেতাম আবার কোথাও কোন ভালো খবর থাকলে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতাম, কারন অভিনয় দেখতে অনেকেই আসতো তার মধ্যেই খবর পাচার হয়ে যেত, কয়েকবার তো ধরা পরতে পরতে বেঁচেছিলাম , পরিনি কারন মেকআপের কারনে আমায় ঠিক করে চেনা যায়নি। তাও একবার পুলিশ ধরে নেহাত সন্দেহের বসেই ধরে মাসছয়েকের জন্য জেলে ভরে প্রচণ্ড অত্যাচার করলো তারপর আবার প্রমানের অভাবে ছেরেও দিলো। এরপর 42 এ গান্ধীজী শুরু করলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলন। আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে ওই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পরলাম। তারপর আস্তে আস্তে অভিনয় জীবনের ইতি ঘটলো । তবে সহকারী হিসেবে নির্দেশনা, সংলাপ পাঠক ইত্যাদি কাজ করতাম ও আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হয়ে পরলাম। এইভাবে বহু সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে 47 এ স্বাধীনতা এলো কিন্তু সাথে নিয়ে এলো দেশভাগের ক্ষত “।

 সঙ্গীতা বলল “ স্যার প্লিজ রাগ করবেন না, আপনার সেই বাল্যবন্ধু শেখ ইব্রাহিমের কোন খোঁজ পেয়েছিলেন এর মধ্যে ?”

সুধাংশুশেখর বললেন “ না না রাগ করার কি আছে ? ওদের বেশ কয়েকজন আত্মীয় সে সময় পাঞ্জাব প্রদেশে থাকতো ও জরির কাজ করত, ও তাদেরই একজনের কাছে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। মাঝে মধ্যে আমাদের মধ্যে চিঠিতে কথাবার্তা হত। আমি আমার অভিজ্ঞতা জানাতাম, ও জানাত ওর অভিজ্ঞতা। তবে কলকাতায় আসার পরে স্বাধীনতার আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়নি “ ।

সঙ্গীতা বলল “ আর স্যার আমি যে লেখাটার কোথা বলেছিলাম সেটা কি লিখতে পেরেছেন ?”

সুধাংশুশেখর বললেন “ হ্যাঁ দারাও দিচ্ছি, বলে ড্রয়ার থেকে একটা চিঠি বের করে সঙ্গীতার হাতে দিলেন। “

সঙ্গীতা চিঠিটা দেখে বলল “ একি স্যার সই করেননি কেন? প্লিজ একটা সই করে তারিখ দিয়ে দিন “।

সুধাংশুশেখর বললেন “ ওসবের আবার কি দরকার একি ব্যাঙ্কের চিঠি নাকি? “

এরপর সঙ্গীতা খুব জোর করায় নিমরাজি হয়ে সই করে তারিখ দিয়ে দিলেন সুধাংশুশেখর ।

এগারো

গুপ্তচর

26 শে আগস্ট 1999, সকাল 10 টা

হাড়োয়া থানায় সাজো সাজো রব, DSP সাহেব আসছেন জরুরি মিটিঙে অন্তত 25-30 জন পুলিশ কর্মী এসেছেন আশপাশের বিভিন্ন থানা থেকে। মিটিং এর আলোচ্য বিষয় হল লাশ ও কঙ্কাল পাচার কান্ডের অবিলম্বে সুরাহা । 12 টায় মিটিং শুরু হোল, DSP শুভ্র মিটিঙের পৌরোহিত্য করলো, সবার বক্তব্য ও পরামর্শ শোনা হল, SI ফারুক বাবু যিনি প্রথম থেকে এই তদন্তের সাথে যুক্ত তিনি বললেন “ সবাই জানেন যে ওদের লোক সব জায়গায় ছড়ানো আছে, তাই জন্য যখনই ওদের বিরুদ্ধে অভিযান করার কথা ভাবা হয় ওরা ঠিক খবর পেয়ে যায় , কারন বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রমান ওরা লোপাট করেছে তাই ওদের হাত অনেক ওপর অব্দি আছে, খবর পাওয়া গেছে শাসক দলের এর কাউন্সিলারের প্রত্যক্ষ মদতেই এই চক্র চলছে, আগে ওরা শুধু কবর থেকে তুলে মৃতদেহ পাচার করত কিন্তু এখন এদের বিরুদ্ধে খুনের লাশ পাচারের অভিযোগ ই বেশী পাওয়া যাচ্ছে , সম্প্রতি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রির শ্যালক কে গায়েব করার অভিযোগ এসেছে এবং তাই রাজ্য সরকার কেও খুব চাপ দেওয়া হয়েছে “।

সুভ্র বলল “হ্যাঁ সে আর বলতে, IG সাহেব ডেকে রীতিমত ধমকে দিলেন, তো ফারুক, আপনি এক্ষুনি বলছিলেন কি যেন একটা ব্রেক থ্রূ পেয়েছেন “।

ফারুক বললেন “হ্যাঁ স্যার আমাদের শাসনের একটি ছেলে আছে কল্লোল, খুবই মেধাবী ও দরিদ্র ঘরের ছেলে ওর বাবা এই থানার উল্টোদিকে একটা ছোট দোকান চালান, সে গতবছর নিজের চেষ্টায় মেডিকেলে পেয়েছে, ছেলেটিকে আমরা থানার উদ্যোগে বেশ কিছু সাহায্য করেছিলাম, সে যাই হোক ও ওর বাবাকে জানিয়েছে যে ওদের কিছু ব্যাচমেট যারা প্রাক্টিকাল পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি তারা নাকি অশোকনগরে কোন এক স্যারের কাছে প্রাইভেটে শিখবে, উনি নাকি প্রত্যেক বছরই এরকম ক্লাস করান। ওদের প্রাক্টিকাল মানেই তো লাশ কাটা এবং আমাদের বিশ্বাস যে ওই ডাক্তারবাবু এই চক্রের কাছ থেকেই ডেডবডি সংগ্রহ করেন। এদের সাহায্যেই এই চক্র টাকে ধরে ফেলা সম্ভব বলে মনে হয় “ ।

সুভ্র বলল “ইন্টারেস্টিং কিভাবে এগবেন ভাবছেন?”

ফারুক বললেন “ কল্লোলকে আমরা ডেকে বুঝিয়েছি যে এটা একটা বড় অপরাধ এবং যদি ও এই চক্রের হদিশ দিতে পারে তাহলে সেটা বিরাট ব্যপার হবে এবং এও আশ্বস্ত করেছি যে ওর অথবা ওর বন্ধুদের কোন ক্ষতি হবে না ‘। যাই হোক জানা গেছে গত 16 তারিখে ওদের একটা ক্লাস ছিল কিন্তু কোন কারনে সেটা 1 মাস পিছিয়ে গেছে, ছেলেটাও ওই  প্রাক্টিকাল এর দলে আছে মানে আমরাই থাকতে বলেছি, ও আমরাই ফান্ডিং করেছি, ও বন্ধুদের বলেছে যে ওর আর প্র্যাকটিস দরকার, এমনিতে ছাত্ররা যখন ওই পাচারচক্রের আড্ডায় গেছিলো, তখনই সেই জায়গার একটা আইডিয়া আমাদের হয়ে গেছে, আমাদের লোক সাদা পোষাকে ওই জায়গায় নজর রাখছে, একজ্যাক্ট এখনও জানি না, তবে আশা করি খুব তাড়াতাড়িই সমস্যার সমাধান হবে ‘।

বারো

স্মৃতিচারন 2

15 ই আগস্ট, 2000

গাড়ি ছুটে চলেছে রাতের পথ ধরে, দেবা আবার পুরনো দিনে ফিরে গেল , ইজাজের থেকে জানতে পারলো সাহিল চাচার আসল ব্যবসা ছিল লাশ গায়েব করার , বাংলাদেশ গঠনের আগে ও পরে প্রচুর রাজনৈতিক হত্যা হয়েছিল এবং সাহিল চাচার বাবা ছিল সেই লাশ গায়েবের মুল হোতা , কিছু লাশ সরাসরই পুঁতে দেওয়া হত ও কিছু লাশ অ্যাসিডে গলিয়ে কঙ্কাল করে সরিয়ে ফেলা হত। এবং যখন সাহিল চাচা , দেবার বাবার ব্যবসার কাজে যুক্ত হলেন তখন ওনার আর সুবিধা হল, এই ব্যবসার ছায়ায় গাঢ় অ্যাসিড আমদানি করাও সহজ হল আবার ব্যবহৃত অ্যাসিড লঘু করে বাথরুমের অ্যাসিড ও ফিনাইল তৈরিতে ব্যবহার হয়ে যেত ও হাড়গোড় গুঁড়ো করে মেশানো হত সারে । এইভাবেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।

এরপর কেটে গেল অনেক দিন। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল হল, দেবার বাবার ক্ষমতাও খানিকটা কমে গেল উনি নিজের জগতেই ডুবে থাকতেন , দেবার হাতে ধীরে ধীরে ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়লো, ও দেবা আইনি ও বেআইনি দুই ব্যবসাই সাফল্যের সাথে চালাতে লাগলো, বিয়ে হল, বাবান এলো ওর জীবনে, দেবা ভেবেছিল ওর উত্তরসুরি এসে গেল।

দেবা ও ইজাজ হয়ে উঠেছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, এমনকি ওদের মুখের ও বেশ খানিকটা মিল ছিল, ওরা বুঝতে পারলো যে পার্টির ছত্রছায়ায় না থাকলে ব্যবসা এগোনো যাবে না, কিন্তু ইজাজের নাম পুলিশের খাতায় আছে এবং ইজাজের ছেলে আনিসুর এর চিকিৎসার জন্য একটু বাইরেও যাওয়া দরকার তাই দেবা শাসক দলের কাজে লেগে পড়লো। দেবার কংগ্রেসি মানসিকতার বাবা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি । বিভিন্ন কারনে মত বিরোধ বাড়তেই লাগলো । তবু ব্যবসার কাজ ভালই চলছিল, এরমধ্যে হঠাৎ একদিন দেবাদের অফিসে আয়কর দপ্তর হানা দিলো, এবং হিসাবে অসঙ্গতির কারনে অফিস সিল করে দিয়ে গেল। সেসব সমস্যা মেটাতে দেবা ও তার বাবা অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিল সব সমস্যা আস্তে আস্তে মিটল, অফিস ও খুলল কিন্তু এই সব খোঁজাখুঁজির জন্য এমন কিছু দস্তাবেজ দেবার হাতে এসে পড়লো যেটা দেখে দেবার পায়ের তলা থেকে জমি সরে গেল। নিজের বাবার সম্বন্ধে যে ইমেজ দেবার মনে ছিল তাতে যেন বড় ফাটল ধরল। সেদিন দেবা বাবার সাথে অনেক্ষন আলোচনা করে দুটো জিনিস ঠিক করলো এক, এই বাড়ি ছাড়বে কারন এক ছাদের তলায় আর থাকা যাবে না, যদিও ব্যবসার ও পরিচিতির কারনে বাবার পরিচয় ও গুড-উইল তার লাগবে, তাই ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকবে , সেটা ওর বাবা ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন ও দুই, ওর ছেলে এই পথে আর আসবে না ।

তেরো

খটকা

5 ই সেপ্টেম্বর, 1999

মামনি আজ অফিস ফেরত নাহুমস থেকে কেক নিয়ে এসেছে, শুভর খুব প্রিয় এটা, আজ শুভ সপ্তাহখানেক বাদে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে, জমিয়ে গল্প করা যাবে, এবং সেদিন শুভ কি নিয়ে ব্যস্ত ছিল সেটাও জানতে হবে।  রাতে খাওয়ার পর মামনি সরাসরিই জিজ্ঞাসা করলো “ কি গো কি হয়েছে বলবে কি না ? শুভ জানতো এই প্রশ্নবান আসবেই ও প্রস্তুতই ছিল এবং মুখে না বললেও শুভ মনে মনে স্বীকার করে ওর বউ যেকোন ঘটনাকে সব দিক দিয়ে ভালো করে বিশ্লেসন করতে পারে। তো ও সংক্ষেপে বলল। মামনি তো শুনে লাফিয়ে উঠলো, বলল “ বল কি এ তো দারুন ব্যপার। কাগজে দারুন রিপোর্ট লেখা যাবে, আমার প্রমোশন আটকায় কে ? “

শুভ সভয়ে বলল “ এখনই আবার কিছু লিখে দিও না, আমার চাকরি টা তাহলে আর থাকবে না , যতক্ষন না পুরো চক্র টা ধরা পরছে, কাক পক্ষিতেও যেন কিছু জানতে না পারে। হাবরা, দেগঙ্গা, হাড়য়া সবজায়গায় আমাদের লোক ঘুরছে, ওই ডাক্তারবাবুকে ফলো করা হচ্ছে, কয়েকজন সন্দেহভাজনকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে এবং ওই ডাক্তারি ছাত্রটিকে বলা আছে কোন খবর পেলেই সাথে সাথে থানায় ফোন করতে। এখন সুধুই অপেক্ষা “ ।

মামনি বলল “জানি গো জানি, আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে, এখন সব ভালো হলেই ভালো “।

মাঝরাতে মামনি টয়লেটে যাচ্ছিল , তখন দেখল বসার ঘরের আলো জ্বলছে, ও গিয়ে দেখল ওর স্বশুরমশাই অভ্রবাবু , মামনির আনা সেই খাতাটার একটা পাতা খুলে কি যেন ভাবছেন। ও গিয়ে বলল “ বাবা শুয়ে পরুন আর কত রাত করবেন ? কি ভাবছেন বসে বসে“

অভ্রবাবু খাতাটা খুলে মামনি কে বললেন “ এই দেখ মা এই সেই বিধায়ক শ্রী সুধাংশুশেখর দত্তগুপ্ত , পাশে দেহের যা মাপ লেখা অবিকল মিলে যাচ্ছে, কিন্তু তাও আমার একটা খটকা লাগছে কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছি না”“

মামনি বলল “ কি খটকা বাবা ?”

অভ্রবাবু “ এই ছবিটায় এমন কিছু আছে, যেটা থাকা উচিৎ না অথবা অন্য কিছু, আমার পুলিশি মাথা বলছে কি যেন একটা আছে ।“

মামনি বলল “ সেটা তো বাবা পরে ভাবলেও চলবে, এখন শুয়ে পরুন, পরে দেখবেন ঠিক মনে পরে যাবে ।“

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল