‘স্বাধীনতা’ শব্দটার সাথে লাবণ্য প্রথম পরিচয় ছোট্ট বেলায় সেই পতাকা উত্তোলনের দিনে শালপাতায় মোড়া গরম গরম জিলিপি আর সিঙারার সাথে। সেই থেকেই এই দিনটার প্রতি অনেকটা ভালোলাগা জন্ম নেয় লাবণ্যর মনে। কিন্তু কিশোরী বয়সের দোরগোড়ায় আসতেই ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সম্পর্কে লাবণ্যর ধারণা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ততদিনে লাবণ্যর পড়া হয়ে গেছে। তাই আর পাঁচটা নাগরিকের মতই পতাকা উত্তোলনের সময় লাবণ্যর গায়েও কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু কিশোরী লাবণ্যর মনে প্রশ্ন জাগে, ‘দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এই দেশের মানুষ গুলো কি সত্যিই সবাই স্বাধীন?’ সে নিজেই তো স্বাধীন নয়, রাস্তার ধারের আইসক্রিম, টকজল দেওয়া ফুচকা খেতে কত ইচ্ছে করে, কিন্তু মা গলা ব্যথা হবে বলে কখনও সেসব খেতে দেয় না। আরো কত যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে তার ওপর কোনো ইয়ত্তা নেই। মা নিজেই তো স্বাধীন নয়, বাবা আর ঠাকুমার পারমিশন ছাড়া কিছুই করতে পারে না সে। তবে কী বাবা স্বাধীন? আপন মনে ভেবে চলত লাবণ্য। বাবাও যে স্বাধীন নয়, তাকেও যে ঝড় জল ঠেলে যত কষ্টই হোক অফিস যেতেই হয়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শরণাপন্ন হতে হয় ঠাকুমার। ঠাকুমা যে অনেক মোটা মোটা ঠাকুরের বই পড়ে, নিশ্চয়ই বলতে পারবে। ঠাকুমা ছেলের এইসব যুক্তি শুনে তো হেসে গড়াগড়ি। ‘স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা না, স্বাধীনতা মানে স্ব-অধীনতা। ‘স্ব’ মানে নিজের অধীনে থাকাই হল স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ। নিজের বৃত্তি প্রবৃত্তি কে নিজ নিয়ন্ত্রণে, নিজ আয়ত্তে রাখতে পারাই স্বাধীনতা। খুব কঠিন কাজ স্বাধীন হওয়া বুঝলি পাগলী?’ বলে ঠাকুমা লাবন্য’র ঝুঁটিটা ধরে নেড়ে দিয়েছিল সেদিন । অত কঠিন কঠিন কথা লাবণ্য বোঝেনি সেদিন কিছুই , শুধু ভেবেছিল যে বড় হলে সব স্বাধীনতা বোধহয় পাওয়া যায়, যা খুশি তাই করতে পারে বড় রা। কেউ কোনো কিছুতেই বাঁধা দেবেনা তখন।
মাঝে অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের সেই ছোট্ট লাবণ্য আজ ঘোর সংসারী।নামী কোম্পানির ইন্জিনিয়ার অমিত রায় এর বউ, টুটুল আর মিতুলের মা। স্বাধীনতার মানে খোঁজার চেষ্টা আর করে না লাবণ্য। কারণ লাবণ্য এখন বুঝতে পেরেছে স্বাধীনতা অতো সহজে ধরা দেবার নয়। আজ লাবণ্যর অগাধ প্রাচুর্য, অমিত বিদেশেই থাকে বেশীরভাগ । মাঝে সাঝে দেশে আসে। এদিকে লাবণ্য নিজের বিউটি পার্লার চালায়,বাবা মা যতদিন আছে এ শহর ছেড়ে কোথাও যেতে মন চায় না লাবণ্যর । আজ উপায় আছে, কিন্তু ইচ্ছে নেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বা ফুচকা খেতে।জ্বরের মুখে যেমন হাজার পোলাও, কালিয়া সাজানো থাকলেও সামনে তার স্বাদ উপভোগ করা যায় না, তেমনি আধুনিকতার উপাচার হাতের মুঠোয় থাকলেও তাকে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যায় না। বিদেশী কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে। সেই বারণ থাকা সময়ে যে আকর্ষণ ছিল তা আজ হারিয়ে গেছে। ঠাকুমা আজ আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু ঠাকুমার বলা সেদিনের কথা গুলোর মর্ম এখন খানিকটা বোধহয় উপলব্ধি করতে পারে। সত্যিই তো নিজের বৃত্তি প্রবৃত্তি কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নি লাবণ্যও? আর সবার মতই মুঠো ফোনে শুরু হয় দিন, অন্তর্জালে জড়িয়ে সারাদিন কেটে যায়। শপিং মল কালচার, মাল্টি প্লেক্সে সিনেমা এসব গ্রাস করেছে সরল জীবনকে। যন্ত্র নির্ভর জীবন, আধুনিক গেজেটস এ বাড়ি ভর্তি। সত্যি বলতে ও এগুলো চালায়, নাকি ওকেই এই যন্ত্র গুলো চালায় বলা মুশকিল, কারণ একদিন ও এসব ছাড়া আজ অচল লাবণ্যর। স্বাধীনতার স্বাদ আজও অধরা তাই লাবণ্যর কাছে ।
এভাবেই আর একটা ১৫ ই আগস্ট এল লাবণ্যর জীবনে ফিরে। আজ আর লাবণ্যর শালপাতায় মোড়া গরম গরম জিলিপি খাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো নেই, কিন্তু পুজোর শপিং সারতে হবে এই দিনে যতটা সম্ভব, সেই তাড়া আছে। এমন একটা ছুটির দিন মিস করলে আর সময় পাবে না। বেরিয়ে পড়েছে তাই আজও ঝাঁ চকচকে এসি গাড়িতে করে। একটা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে নেমে লাবণ্য গেটে ঢুকতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ওড়নায় টান পড়তে পেছন ফিরে দেখে দুটো বাচ্চা ছেলে হাতে একগোছা ধূপকাঠি হাতে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওদের সামনে আসতেই অপেক্ষাকৃত বড় ছেলে টা বলল ‘ খুব সুন্দর গন্ধ দিদি, দু প্যাকেট নিয়ে দেখো, দশ টাকা করে মাত্র।’ মায়া মাখানো চোখ দুটো যেন লাবণ্যকে কেমন স্পর্শ করে গেল। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘ তোরা পড়াশোনা করিস না? তোদের বাবা মা কোথায়? কী করে?কোথায় থাকিস? ‘ সাগ্রহে ছোট ছেলেটা রাস্তার পাশে একটা জামাকাপড়ের স্টলের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওইটা আমার মামার দোকান, আমাদের বাবা মা নেই, এখানেই থাকি রাতে, আর দিনে ধূপকাঠি বিক্রি করি।’ লাবণ্য ওদের হাত থেকে সবকটা প্যাকেট নিয়ে বলল, ‘গন্ধ ভালো হবে? ঠিক তো? ‘ আনন্দে চিকচিক করে উঠল ওদের চোখগুলো ‘ হ্যাঁ দিদি। ‘ ২০০০ টাকার একটা নোট বের করে দিতেই ওরা বলল ‘ফেরত দিতে পারব না এত টাকা।’ লাবণ্য বলল ‘রেখে দে’, কিছুতেই নিল না ওরা টাকাটা। কিন্তু লাবণ্যর কাছেও আর খুচরো নেই। আজকাল কার্ডে সব পেমেন্ট। লাবণ্য উপায়ান্তর না দেখে শপিং মলে চলে যাবে ভাবছে এমন সময় ওই ছেলেটির দেখানো জামাকাপড়ের স্টলে ঝোলানো একটা কুর্তি দেখে চোখ আটকে গেল। এগিয়ে গেল লাবণ্য। দোকানদার উৎসাহী গলায় বলল ‘আপনাকে দারুণ মানাবে দিদি, পিওর কটন, নিশ্চিন্তে নিয়ে যান।’ খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল লাবণ্য, রাস্তার পাশ থেকে এভাবে কখনো কিছু কেনে নি।লাবণ্যর অস্বস্তি আন্দাজ করতে পেরে দোকানদার আশ্বস্ত করে, ‘একবার নিয়ে দেখুন দিদি, খারাপ হবে না, দাম ও অনেক কম বড় দোকানের থেকে, কিন্তু জিনিসটা খাঁটি। আমাদের মত হকারদের ব্যবসা পত্র তো প্রায় আজকাল বন্ধ হবার জো,এই ছাতার মত গজিয়ে ওঠা শপিং মলের ঠেলায়। একবার নিলে ঠকবেন না দিদি।’ লাবণ্যর আজ খুব ইচ্ছে করছে কেন জানিনা এখানে আরও একটু দাঁড়িয়ে জামাকাপড় গুলো ঘাটতে, এই গরমে এসি ছাড়াও বেশ লাগছে জামা কাপড় গুলো ঘেঁটে দেখতে,এই ছোট্ট দোকানদারের আপন করা ব্যবহার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।
বাড়ি এসে ধূপকাঠি গুলো জ্বালিয়ে নতুন জামা কাপড় গুলো দেখতে দেখতে লাবণ্যর মনটা ভালো হয়ে গেল। অনেক শপিং করেছে আজ লাবণ্য। না শপিং মল থেকে নয়। রাস্তার পাশে দোকান থেকে। ওই বাচ্চা দুটো আজ হয়তো মাংস ভাত খেতে পারবে। এই রকম সব লাবণ্য রাই যদি ওদের হকার মামাদের দোকানে শপিং করে কখনো সখনো তাহলে হয়তো ওরা একদিন স্কুলেও পড়বে।
ধূপের গন্ধে আজ স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে লাবণ্য, বৃত্তি প্রবৃত্তি সব নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে আজ লাবণ্য সত্যিকারের স্বাধীন আধুনিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়েছে। আজ যে লাবণ্যর সত্যি কারের স্বাধীনতা দিবস।
আমি শুধালাম ‘ স্বাধীনতা ‘ কে
তুমি কবে ‘স্বাধীন’ হবে ??
সে বলে যবে
“মিলে সুর মেরা তুমহারা “
সত্যিকারের হবে…
©️শঙ্খচিল