প্রথম পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibos-part1/
দ্বিতীয় পর্বের লিংক ;
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibas-part2/
তৃতীয় পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota_dibos_3/
চোদ্দ
কথোপকথনঃ 3
12 ই এপ্রিল , 2000 , সকাল 9.00
ইন্টারভিউ এর কাজ প্রায় শেষের পথে আর কয়েকটা সিটিং লাগবে। স্বাধীনতার পর সুধাংশুশেখরের বিবাহ, সন্তানলাভ ও ব্যবসার শুরু অব্দি লেখা হয়েছে।
সুধাংশুশেখর বলে চলেছেন “ তারপর আগের দিন যা বলেছিলাম তখন 52-53 সাল , বাংলায় নতুন সরকার চলছে , আমারও নতুন সংসার জীবন , পাশাপাশি ব্যবসার কাজও শুরু করেছিলাম, বাংলায় তখন কৃষির উন্নতি হচ্ছে, তাই আমার সারের ব্যবসা ভালই চলছিল, আমার কারখানা ছিল গোবরডাঙায় তবে স্বাধীনতার পর আর রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক রাখিনি, নতুন সংসার ও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটছিল “।
সঙ্গীতা বলল “ তো স্যার তখন আপনি কোথায় থাকতেন ?”।
সুধাংশুশেখর বললেন “ আমি বাগবাজারেই একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, তবে বাড়িতে কমই থাকা হত , সেখানে আমার গিন্নি ছেলেকে নিয়ে থাকত , আমি ব্যবসার কাজে বাইরেই থাকতাম। “
সঙ্গীতা বলল “ তো স্যার এইখানে কবে শিফট করলেন “।
সুধাংশুশেখর খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন “ সে কিছুদিন পরে, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর , যদিও সে কথা মনে করতে আমার ভালো লাগে না, তবু সেই ঘটনা আমার এই কাহিনির একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা তাই বলতেই হয়। তবে তার আগে তৎকালীন পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমায় একটু বলে নি, তোমরা হয়ত পড়েছ 52 সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনে গুলি চালনার পর থেকেই পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব অনেক বেড়ে যায় 54 সালের নির্বাচনের পর তা আরও বৃদ্ধি পায়, যেহেতু আমার ওই দিকে প্রচুর পরিচিতি ছিল, তাই আমি এদিকে থেকেও ওই আন্দোলনের সাথে খানিকটা জড়িয়ে গিয়েছিলাম , গোবরডাঙ্গায় আমার কারখানায় কিছু পূর্ববঙ্গের লোক কাজ করতেন , তারা আমার অনুমতিতেই অনেক কে আশ্রয় দিয়েছিলেন যাদের পূর্ববঙ্গে প্রানের আশঙ্কা ছিল । আবার 47 এর পর মতুয়া সংগঠনের অনেকেই ফরিদপুর থেকে এসে গোবরডাঙ্গার পাশেই ঠাকুরনগরে পাকাপাকি বসতি স্থাপন করে , ওদের মাধ্যমেও আমার ব্যবসার অনেক কাজ হত আবার ওদেশে খবর ও সাহায্যও পাঠানো হত। এরপর একদিন ব্যবসার কাজে গোবরডাঙ্গায় গিয়েছি, সেবার পরিবার সঙ্গে ছিল, গিন্নির ইচ্ছে ছিল জায়গাটা ঘুরে দেখার, কিন্তু সে ঘোরাই যে শেষ ঘোরা হবে তা কে জানতো। আসলে কি হয়েছিল আমার ওই কাজের জন্য আমি নাকি পাকিস্তানের কিছু কর্তাব্যক্তির কাছে খুব অপ্রিয় হয়ে গিয়ে ছিলাম, তাই ঢাকা থেকে আমায় নিকেশ করার জন্য বিশেষ লোক পাঠানো হয়েছিল ও সেই লোক আমার কর্মচারী দের ভিড়ে মিশে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সেদিন আমার ঘরেই সকলের জন্য রান্না হয়েছিল, কারখানায় নতুন এক কর্মচারীর রান্নার হাত নাকি খুব ভালো, সেই রান্না করেছিল যদিও আমার সাথে তার দেখা হয়নি কারন মতুয়া দের কয়েকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আমি ওদের সাথে বিভিন্ন আলোচনা করছিলাম, ওরা আবার প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছিল, ওদের একজন সম্প্রতি বাবা হয়েছে সেই আনন্দে, তো আমি ওদের সাথেই খেয়ে নি। মাঝরাতে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখলাম আমার স্ত্রীর মুখ দিয়ে গোঙ্গানির মত আওয়াজ বেরোচ্ছে ও অল্প রক্ত উঠছে, আমি চিৎকার করে লোকেদের ডাকলাম কিন্তু কেউ সারা দিলো না, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে একটা জোরে আওয়াজ পেলাম দৌড়ে গিয়ে দেখলাম উনুনের সামনে আমার সবসময়ের লোক উল্টে পরে আছে আর উনুনের পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল, এতো আমার বাল্যবন্ধু ইব্রাহিম , সে বলল “ কিরে শুধু চিনতে পারছিস ? নিজের দেশে যা করছিলি, কর, আমার দেশের পেছনে লাগতে গেলি কেন ? হেড অফিস থেকে আদেশ এসেছে তোকে ও তোর সকল অনুচর কে শেষ করার এবং আমার ওপর দায়িত্ব পরেছে এই কাজের, সবাই তো শেষ হয়েই গেছে, খাবারে বিষ মেশানো ছিল, এবার তোর পালা “। এই কথা বলেই ও একটা ছুরি নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমি একটু সরে গেলেও পুরো ধাক্কাটা সামলাতে পারলাম না, উনুনের ওপর গিয়ে পড়লাম, মুখটা ঝলসে গেল, আমি উঠে দাড়াতেই ইব্রাহিম আবার ঝাঁপালো কিন্তু রান্নাঘরে কিছু একটা পরে ছিল, তাতে ওর পা হড়কে গেল এবং ও খানিকটা বে কায়দায় আমার ওপর এসে পড়লো, আমি মুখের তীব্র যন্ত্রণায় ওকে একটা ধাক্কা দিলাম, সেই ধাক্কায় ওর হাতের ছুরি ওর গলায় লাগলো, তার পরেও ও ছুটে আসতে চাইল, তখন আমি ওকে আরেকটা ধাক্কা দিলাম, এবার ও গিয়ে পড়লো উনুনের ওপর “।
এই বলে সুধাংশুশেখর একটু থামলেন, এক গ্লাস জল খেলেন , খেয়ে একটু চুপ করে বসে থাকলেন।
সঙ্গীতা বলল “ কিন্তু স্যার ইব্রাহিম এরকম কেন করলেন, আপনি বলেছিলেন উনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন, তারপর উনি পাকিস্তান এর চর কিভাবে হয়ে গেলেন ? “
সুধাংশুশেখর বললেন “ তুমি হয়ত জান না পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় আসলে লাহোরে অবস্থিত ও সেটা পাকিস্তানে, পড়াশুনায় ও খুবই ভালো ছিল, সেখান থেকেই হয়ত সরকারের নজরে এসে গিয়েছিল যাই হোক সে রাতে যখন রান্না ঘর থেকে শোয়ার ঘরে এলাম ততক্ষনে সব শেষ “। বেড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করে পরিচিত কয়েকজন এলো, তারাই আমায় সেবা শুশ্রূষা করলো, সেদিন আমার গিন্নি ছাড়া আরও 17 জন মারা গিয়েছিল, পুলিশি ব্যপার ওরাই সামলে নিয়েছিল। এর পরেই আমি ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসি। বাগবাজারের বাড়িতে আর ফিরিনি পরিচিত এক জনের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে রেলপুকুরে একটা বাড়ি ভাড়া নি তার অনেক পরে 70 এর শুরুতেই এই বাড়িটা করে এখানে চলে আসি “।
সঙ্গীতা বলল “ এরপর আপনি গোবরডাঙ্গায় কবে গেলেন ? “
সুধাংশুশেখর বললেন “ আমি কোনদিনই আর গোবরডাঙ্গায় ফিরিনি, আমি দমদমেই আমার ব্যবসা স্থানান্তরিত করি, তবে মুল কারখানা ওখানেই ছিল অনেক বছর , আমার পূর্ববঙ্গের খুব কাছের এক ভাই সাহিল, ই ওদিকটা দেখতো , আমি তখন একটু অন্য রকম হয়ে গেছিলাম, কয়েক বছর বহু তীর্থে ঘুরেছি, সাধু সন্তের কাছেও গেছি সামান্য মানসিক শান্তির জন্য কিন্তু কোন লাভ হয়নি তারপর একসময় আবার ব্যবসায় মনোনিবেশ করি। রাজনীতিতেও আমার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু এই সময়েই “।
পনেরো
বিপর্যয়
7 ই অক্টোবর, 1999
তিন বার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত আজ হবে পার্থদের ক্লাস, ওরা তো একবার ভেবে ছিল সব টাকা বুঝি গেল, সুব্রত বাবু নাকি আউট অফ স্টেশন ছিলেন, সে যাই হোক ওরা সবাই দুপুর 3 টের মধ্যে স্যারের চেম্বারে পৌঁছে গেল, আধ ঘণ্টা বাদে একটা এ্যাম্বুলেন্সে করে বডি চলে এলো। যারা নিয়ে এসেছিল, তারা বলল “আপনারা কাজ সেরে নিন আমরা বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি, শেষ হলে বলবেন নিয়ে চলে যাবো “। ওদের ক্লাস শুরু হল, হঠাৎ বাইরে কিছু গোলমাল শোনা গেল, সবাই চমকে উঠলো, স্যার বললেন “দারাও আমি দেখছি “ , বলে যেই দরজা খুললেন , সাথে সাথে 7-8 জন লোক ভেতরে ঢুকে পড়লো এবং হিমশীতল গলায় বলল “ কেউ নড়ার চেষ্টা করবে না, আমরা থানার থেকে আসছি, তোমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে “। বলে সবাইকে নিয়ে একটা পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেল ।
পার্থর মাথায় যেন বাজ পড়লো, এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, ও কোন দিন স্বপ্নেও ভাবেনি। পুলিশ সারারাত জেরা করলো, ওরা যা যা জানতো সব বলল, তাও পুলিশ বলল যে ওদের পরের দিন কোর্টে তোলা হবে। তবে ওদের সবাইকে ঘরে খবর দিতে দেওয়া হল, পার্থ বাড়িতে ফোন করলো কিন্তু কেউ ধরল না। পরের দিন ওদের কোর্টে তলা হল, ওদের তিন দিনের পলিশি হেফাজত হল। দুদিন বাদে পার্থর বাবা দেখা করতে এলেন, পার্থ অভিমানে কোন কথাই বলল না, কিন্তু ওর বাবা পার্টি করতেন, তাই প্রভাব খাটিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন।
কালীপুজোর পর ওরা আবার কলেজে যোগ দিলো, সব কিছুই যেন ধামা চাপা পরে গেল, সবাই যেন সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করলো, কিন্তু পার্থ পারলো না। ওর জীবনে যে বিপর্যয় ঘটে গেল তার থেকে ও যেন আর বেরতেই পারছিল না।
ষোল
ঘটনাপ্রবাহ
অক্টোবর-ডিসেম্বর , 1999
পরের দুটো মাস যেন সুভ্রর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। 7ই অক্টোবর ভোরে কল্লোল ছেলেটি হাড়োয়া থানায় ফোন করে জানিয়েছিল সেদিন বিকেলেই ওদের ক্লাস আছে, আগেরদিন রাতেই কনফার্ম হয়েছে, ফারুক সঙ্গে সঙ্গে সুভ্রকে ফোন করে জানালো, তারপর দুপুর থেকেই থানায় কন্ট্রোল রুম সেটআপ করা হল, কল্লোলরা হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই পুলিশের একজন ওদের ফলো কোর্টে লাগলো। এরপর অশোকনগরে ওরা যখন ওই ডাক্তারবাবুর ঘরে ঢুকে গেল তখন পুলিশের লোকটি লোকাল থানায় খবর দিয়ে দিলো , সাথে সাথে কয়েকজন বাড়িটিতে লক্ষ্য রাখতে লাগলো , এরপর ঘণ্টাখানেক বাদে একটি এ্যাম্বুলেন্স বাড়িটাতে ঢুকল আবার কিছুক্ষণ বাদেই বেড়িয়ে গেল, পুলিশের একটা দল একটা সাধারন গাড়িতে ওই এ্যাম্বুলেন্স টাকে ফলো করতে লাগলো। প্রথম দলে ফারুক নিজে ছিল, ও নিজে ওই ডাক্তারের বাড়িতে রেইড করে মৃতদেহ আটক করে ও প্রচুর পুরোনো নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে, এবং উপস্থিত সকলকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। দ্বিতীয় দল এ্যাম্বুলেন্স এর পিছু করে পৌঁছায় ওদের মূল ঘাটিতে সেখান থেকেও কিছু নথি, কয়েকটি কঙ্কাল হেফাজতে নেয় ও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর শুরু হয় দফায় দফায় জেরা । ডাক্তারি ছাত্রদের জেরা করে কিছু জানা যায় নি, আবার ধৃত ছাত্র দের মধ্যে পার্থ নামে একটি ছেলের বাবা নাকি রুলিং পার্টির কাউন্সিলার ছিল, তাই শুভ্রর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওরা ছাড়া পেয়ে যায়, কিন্তু শুভ্ররই অর্ধাঙ্গিনীর জন্য এও খবরটি কাগজের শিরোনামে চলে আসে, এবং আদালতের বাইরে তোলা ছাত্রদের একটা ছবি ও কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়।
ওই চক্রের লোকগুলোকে জেরা করে আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হল, ওদের আরও অনেকগুলো ঘাঁটির সন্ধান পেল পুলিশ। বাজেয়াপ্ত হল অনেকগুলো কঙ্কাল ও কয়েকটি মৃতদেহ। তবে এদের মূল পান্ডা আনিসুরের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। রাজ্য জুড়ে যেন শোরগোল পরে গেল।
ওই ডাক্তারের নথি ঘেঁটে সেরকম কিছু পাওয়া যায় নি, তো উনি যে গত দশ বছর ধরে এই কাজ করছেন তার প্রমান পাওয়া গেছে তবে কঙ্কাল ও মৃতদেহ পাচার চক্রের সাথে ওনার কোন যোগ পাওয়া যায় নি। তাই ওই সব নথি শুভ্র বাড়ি নিয়ে যায়নি। অন্যান্য নথি ঘেঁটে এই পাচার চক্রের প্রায় পুরো নেটওয়ার্কের ও সমস্ত হিসেবের খোঁজ পেয়ে গেল পুলিশ, প্রচুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিশ পাওয়া গেল, সেগুলো সব সিল করা হল ।এরপর আরেকটা নতুন সুত্রে তদন্ত শুরু হল, এদের খাতার মধ্যে গোবরডাঙ্গার আর একটা অন্য কারখানার খাতাও পাওয়া গেল, সেটি একটি সার-অ্যাসিড-ফিনাইল ইত্যাদির কারখানা, পুলিশ সেখানে রেড করে দেখল সেটি একটি ছোট কারখানা, এলাকার অনেকে সেটিকে সেখ ইব্রাহিমের কারখানা বলেই জানে, কিন্তু তাকে কেউ চেনে না। ওই কারখানার নথি পরীক্ষা করে পুলিশ দেখল যে পরিমান গাঢ় অ্যাসিড ও অন্যান্য জিনিস বাইরে থেকে আনানো হয়েছে, এই কারখানার প্রোডাকশান তার অনুপাতে কিছুই না, আবার সারের নমুনা পরীক্ষা করে তার মধ্যে আবার মানুষের হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেল। কারোর বুঝতে বাকি রইল না এই কারখানাটা আসলে ওই কঙ্কালের ব্যবসার ফ্রন্ট, এর আড়ালেই আসলে ওই পাচারের ব্যবসা চালাত। তারপর সেই কারখানার সবাইকে জেরা করা হল , কর্মীরা সবাই জানে তাদের কারখানা কে লোকে ইব্রাহিমের কারখানা বলে, কিন্তু তারা কেউ ইব্রাহিমকে দেখেনি। তারা মালিককে চেনেই না, তবে আনিসুর ভাই কেই তারা চেনে তবে তার সাথে মাঝে মাঝে একজন মাঝ বয়সি লোক মাঝে মাঝেই দেখত এবং ওই সারের কাঁচামাল হিসেবে ওই হাড়ের গুঁড়ো কোথা থেকে আসতো সেটা ওরা কেউ জানে না সেটা কারখানার সবচেয়ে পুরনো কর্মী দেওয়ারিই জানে, এবং ওই হাড়ের গুঁড়ো মানুষের না অন্য প্রানীর সেটা ওদের পক্ষে জানাও সম্ভব ছিল না তবে ওরা অনেকবার দেখেছে যে এই কারখানার অ্যাসিড ম্যটাডোরে অন্য জায়গায় পাচার হয়ে যেতে । কারখানার পুরনো এক কর্মচারী দেওয়ারির কথায় অনেক অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছিল ফারুক, ওকে টানা ও দিন জেরা করা হয় ও শেষে বেশ চাঞ্চল্যকর দুটো তথ্য পাওয়া যায়, এক ওই যে ব্যাক্তি আনিসুরের সঙ্গে আসতেন তার নাম দেবা, সবাই দেবাদা ডাকতো এবং উনি পার্টির এক দাপুটে নেতা, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হল উনি জানেন যে হাড় কোথা কোথা থেকে আসে এবং সেগুলো যে মানুষের হাড় তাও উনি জানেন।
তবে উনি জানতেন যে যাদের কাছ থেকে উনি এই হাড়ের গুঁড়ো কেনেন কারা কবর থেকে লাশ চুরি করে, যেগুলো আস্ত থাকে সেগুলো কঙ্কাল হিসেবে চড়া দামে বিক্রি হয় এবং যেগুলো গোটা থাকে না বা আংশিক নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো গুঁড়ো হয়ে কারখানায় আসতো।ওর কাছ থেকে যে কটা ঘাঁটির খোঁজ পাওয়া গেল সব পুলিশ আগে থেকেই জানতো, শুধু দেওয়ারি বলেছিল যে সে শুনেছে বল্লির বিলের দক্ষিনে নাকি অনেক লাশ পোঁতা আছে, দেওয়ারি আনিসুরের কাছে শুনেছে, এই তথ্যটাই পুলিশের কাছে নতুন ছিল। ডিসেম্বরের শুরুতে দেওয়ারির সুত্র অনুযায়ী গোবরডাঙ্গার বল্লির বিলের কাছে পুলিশ অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করে সত্যিই প্রায় 20-25 টি কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করলো। আবার রাজ্যজুড়ে আলোড়ন পরে গেল, মিডিয়া এই ঘটনাকে দ্বিতীয় মহেঞ্জোদরো আখ্যা দিয়ে ফেলল। কঙ্কাল গুলিকে ফরেনসিক টেস্টের জন্য পাঠানো হল এবং জানা গেল কঙ্কালগুলি 60-70 এর দশকের। সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো যে কতদিন ধরে তাহলে এই চক্র কাজ করছে। একটা জিনিস কমন ছিল যে দুটো জায়গারই পুরনো দস্তাবেজে সেখ ইব্রাহিম এর সই আছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল কে এই ইব্রাহিম ? কে চেনে তাকে।
সুভ্র দুদিন ছুটি নিল, বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম করবে, এই দুমাসের দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর ওর গিন্নির একটা আবদার আছে, যদিও সেটা বেআইনি, ওর বউ মামনি ওরফে মুগ্ধবাজার পত্রিকার জনপ্রিয় সাংবাদিক সঙ্গীতা কেসের পুরনো সব রেকর্ড একটু দেখতে চেয়েছে। আর যদি আলোচনার মাধ্যমে কেসের নতুন কোন সুত্র বেড়িয়ে আসে তাহলে সেটা উপরি পাওনা হবে।
সতের
কার্যসমাপ্তি
17 ই জুন , 2000 , বিকাল 4.00
আজ সঙ্গীতার কাজ মোটামুটি শেষ হল, দুপুর থেকেই ও ছিল ওখানে, সুধাংশুশেখর আজ অনেকক্ষন ধরেই কথা বলেছেন। উনি বলেছেন যে গোবরডাঙ্গার ওই দুর্ঘটনার পর আর ওখানে ফেরেননি , তখন বাগুইআটি রেল্পুকুরের কাছে এক আত্মীয়ের কাছে ছেলেকে রেখে উনি অনেক তীর্থে ঘুরেছেন ও ফিরে এসে ওখানেই অনেকদিন ছিলেন। পরে দমদমের কাছে নোয়াপাড়া ও বেদিয়াপাড়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন, মশলা, ফিনাইল, সার ইত্যাদির 60 এর দশকের শেষের দিক থেকেই এই অঞ্চলে পূর্ববঙ্গ থেকে অনেকে আসতে থাকেন ,এদের কে নিয়েই সুধাংশুশেখর নিজের ব্যবসা কে এগিয়ে নিয়ে যান। সময়ের সাথে সাথে অনেক উদ্বাস্তু মানুষ এখানে আশ্রয় নেন। সুধাংশুশেখর ছিলেন এদের অনেকের কাছে ত্রাতার মতন, অনেককেই তিনি প্রথমে আশ্রয় ও পরে দিয়েছিলেন জীবিকার খোঁজ , এই জন্য তিনি এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, রাজনীতির সাথে তো আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন। 70 সালে বেদিয়াপাড়ায় বাড়ি করে চলে আসার পর ওই এলাকা থেকে ভোটে দাঁড়াবার প্রস্তাব আসে এবং উনি নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন।
সুধাংশুশেখর বলেছেন “ ওই সময়ই অভ্রতনুর সাথে আমার পরিচয়, খুবই ভালো ছেলে ছিল ও এবং খুব সাহসী , সেই সময়ে ও চারিদিকে ঝামেলা লেগেই থাকতো, ও অনেকবারই আমায় রক্ষা করেছিল “।
সঙ্গীতা বলল “ তো স্যার তারপর আপনি আর রাজনীতিতে ছিলেন না কেন ? “
সুধাংশুশেখর বললেন “ 77 এ রাজ্যে পালাবদলের পর আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে সরে যাই, শরীর ও খারাপ হতে থাকে , ছেলে তখন বড় হয়ে গেছে, ও একসময়ে আমার হাত থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিল আমি টুকটাক সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকতাম , থিয়েটার দেখতে যেতাম, লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করতে যেতাম এই সব নিয়েই থাকতাম। গত কয়েক বছর ধরে চোখের দৃষ্টিও কমে আসছে। এভাবেই চলছে যেকোনো একদিন থেমে যেতে পারি “।
সঙ্গীতা বলল “ না স্যার এরকম বলবেন না, তবে একটাই প্রশ্ন আছে, আমি এতদিন ধরে আসছি, আপনার ছেলেকে তো কখনও দেখিনি, বা আপনি তার কথাও খুব একটা বলেন না এটা কেন ? “।
সুধাংশুশেখর বললেন “ অনেক বছর আগে একটা বিষয়ে আমাদের মত বিরোধ হয় তারপর থেকে ও আর আমার সাথে থাকে না, মাঝে সাঝে আসে, তবে সে কয়েকমাস বাদে বাদে, বলতে পারো আমাদের মধ্যে সম্পর্ক নেই “।
সঙ্গীতা বলল “ ওরে বাবা তো সে কিরকম মত বিরোধ যে এত বছর ধরে বাবা ছেলের সম্পর্ক খারাপ, একটু বলবে স্যার যদি কোন অসুবিধা না থাকে, আর আপনার ছেলের নাম কি? ওনার কি কোন ছেলে মেয়ে আছে? কি করে ? “
সুধাংশুশেখর বললেন “ আমার ছেলের নাম দেবব্রত। ওর এক ছেলে আছে পার্থ, ও এখন ডাক্তারি পরছে , তবে তোমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না ওই মতবিরোধের কারনটা একান্তই ব্যক্তিগত, ওটা বলতে পারছি না দুঃখিত “।
সঙ্গীতা বলল “ ঠিক আছে স্যার , আমাদের কাজ প্রায় শেষ। তবে একটা দুঃখ আমারও আছে ভেবেছিলাম আগামী 15ই আগস্টের সংখ্যা থেকে আপনার এই ইন্টার্ভিউ ধারাবাহিক ভাবে ছাপাতে পারবো, সেটা হচ্ছে না, সেই সময়ের জন্য অন্য একটা আর্টিকেল শর্টলিস্টেড হয়ে গেছে, সেই দিনটা অবশ্য আমার ছুটি , আমি এক কাজ করবো সেই দিন এসে আপনাকে ফাইনাল কপি টা দেখিয়ে যাবো। কোথা দিচ্ছি শিশু দিবস থেকে আপনার গল্প ধারাবাহিক ভাবে কাগজে বেরোবে “।
সুধাংশুশেখর বললেন “ কোন ব্যপার না, সে হতেই পারে, তুমি 15ই আগস্টে এলে একটু বেলায় এসো, সকালে আবার ওই ক্লাব থেকে ডাকতে আসবে “।
(চলবে)
চিত্র সৌজন্য : গুগল