মনে করো , শেষের সে দিন ভয়ংকর ………..!!
শুরুটা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে ! ভোর চারটে । রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় আসার জন্য প্রস্তুত । বসে আছেন একা তার পূবদিকের ঘরে । কিছুক্ষণ পরে আশ্রমের শিক্ষার্থীদের গান ভেসে এলো তাঁর জানলার সামনে …..
” এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার …. ” তারা গাইতে গাইতে উদয়নের কাঁকুরে রাস্তা পার হয়ে চলে এলো রবীন্দ্রনাথের ঘরের জানলার একেবারে নীচে । এদিকে কলকাতা যাবার সময় চলে এসেছে…..রবীন্দ্রনাথকে চেয়ারে বসিয়ে ধরাধরি করে নামান হলো ।
সেই মুহূর্তে ছেলেমেয়েদের সম্মিলিত গান আবার ভেসে উঠলো : ” আমাদের শান্তিনিকেতন , আমাদের সব হতে আপন …..” প্রায় তিরিশ বছর আগের লেখা এই গান দিয়ে তিনি শেষ যাত্রার দিকে এগিয়ে চললেন ! তখনও তারা গেয়ে চলেছে :
মোদের তরুমুলের মেলা , মোদের খোলা মাঠের খেলা ……
রবীন্দ্রনাথ – কে একটি বাসের মধ্যে স্ট্রেচার ওপরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে । বাসের পাশাপাশি একটি গাড়িতে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও মেয়ে মীরাও চলেছেন ।
রাস্তার দুধারে গ্রামের মানুষজন হাতজোড় করে প্রণাম করে দাঁড়িয়ে আছেন ……!
ব্রিটিশ আমলে ট্রেনে তাঁর জন্য বিশেষ কামরা , যেখানে বসার ঘর ও শোয়ার ঘর প্রস্তুত ছিল ।
রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে । খুব জ্বর । পরের দিন সকালেই লিখলেন একটি কবিতা :
প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে , কে তুমি
মেলেনি উত্তর । ………
রবীন্দ্রনাথ জানেন , অপারেশন করা হবে । রোজই তাকে গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে । তিনি শুনলেন , অস্ত্রোপচারের সময় তাঁকে অজ্ঞান করা হবে না । লোকাল এনাসথেটিকে অসাড় করে অপারেশন করা হবে ।
সেদিন ছিল ৩০ জুলাই । সকালেই হবে অপারেশন,পূবদিকের বারান্দায় অপারেশনের আয়োজন করা হয়েছে । আড়াল দিয়ে টাঙানো হয়েছে সাদা কাপড়ের পর্দা ! তার আগে তিনি লিখলেন :
তোমার সৃষ্টির পথ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী ……
এই দীর্ঘ কবিতা লিখতে লিখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন । রানী চন্দ – কে বললেন , আর পারছি না , বড়ো ক্লান্ত লাগছে …..
অপেরাশন শেষ হলো দুপুর বারোটায় । প্রচন্ড যন্ত্রনা তিনি মুখ বুজে সহ্য করলেন !
এরপর ৪ ঠা আগস্ট পর্যন্ত কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন । কিন্তু পরের দিন থেকেই তিনি সম্পূর্ণ অচৈতন্য হয়ে পড়লেন । কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না । ডা : বিধান রায় এলেন । নির্মলকুমারীকে বললেন , মুখে একটু জল দিন । কিছুটা গেল , বাকিটা গড়িয়ে পড়ে গেল ।
সেদিন ছিল ৭ অগাস্ট । ১৯৪১ সাল।রাত দুটোয় রাণী মহলানবিশ ফোন পেলেন, ভোর চারটে থেকে নিকট আত্মীয়,বন্ধু-পরিজন,প্রিয়জন দলে দলে আসতে লাগলেন। ঠাকুর বাড়ির বাইরে সকাল থেকে কবির অগণিত ভক্তের ভিড়, তারা সব্বাই একটিবারের জন্যে তাঁকে দেখতে চান, তাদের প্রবল জনস্রোতে ঠাকুর বাড়ির মূল প্রবেশ দ্বার ভেঙে পড়েছে।
সকাল সাতটায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কবির শেষশয্যার পাশে বসে উপাসনা করলেন। মেয়েরা গাইছে কবির রচিত ব্রহ্মসংগীত। ন’টা থেকে অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলো। গুরুদেবের পায়ে প্রতিমাদেবী অঞ্জলি ভরে চাঁপাফুল দিয়ে গেলেন। গুরুদেবের পায়ের হাত রেখে রাণীরা টের পেলেন ক্রমশ উষ্ণতা কমে আসছে। তখন ভোরের আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।রবীন্দ্রনাথ শেষ শয্যায় । তাঁর ঠোঁটে একটু একটু করে জল দেওয়া হচ্ছে । তাঁর কানের কাছে বলা হচ্ছে তাঁর প্রানের মন্ত্র :
” শান্তম , শিবম , অদ্বৈতম “
কবির পায়ে হাত রেখে বলা হচ্ছে উপনিষদের মন্ত্র :
” তমসো মা জ্যোতির্গময় …….”
দুপুর ১২:১০ মিনিটে কবি সম্পূর্ণ চলে গেলেন।
নন্দলাল বসু গুরুদেবের শেষযাত্রার পালঙ্ক নির্মাণ করলেন, সহযোগী কে আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বললেন, যা আজ রাজার রাজা নগর পরিক্রমা করে চিরবিদায় নেবেন, বেনারসি চাদর নিয়ে আয়, লাল বেনারসি কাপড়ে সোনালী বুটি দেওয়া চাদর পাতা হল পালঙ্কে। সহস্র জুঁই,বেলের মালায় ঢাকা পড়ল সেই রাজ পালঙ্ক।
গুরুদেবকে সাদা বেনারসি জোড় পোরানো হল, সাথে গরদের পাঞ্জাবি,কোঁচানো ধুতি, গলায় রজনীগন্ধার গোড়ের মালা, কপালে চন্দন। তাঁর চারপাশে শতসহস্র শ্বেতপদ্ম ও রজনীগন্ধা।
তাঁর হাতদুটি বুকের কাছে ছিল,সেখানে দেওয়া হল একটি শ্বেতপদ্ম কোরক। ঠিক যেন ঈশ্বর শুয়ে রয়েছেন নিদ্রামগ্ন হয়ে। কী অপূর্ব তাঁর সেই রূপ !
“পথের শেষ কোথায় ,শেষ কোথায় ,কী আছে শেষে ! এত কামনা , এত সাধনা , কোথায় মেশে ? ……….”
[জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের দোতলায় ” পাথরের ঘর ” বলে পরিচিত রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ কক্ষ।
কিন্তু অনেকের কাছেই এই তথ্য অজানা যে, পাথরের ঘরের পুবদিকের বারান্দায় তাঁর অস্ত্রোপচারের জন্য রীতিমতো একটা অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল।]
চিত্র.১:-কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ- এর প্রয়াণ কক্ষ
চিত্র.২:-অপারেশন থিয়েটারের মডেল