রথের রশি

ঋতুপর্ণা মাইতি
5 রেটিং
2006 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

রথের দিন। বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। ব‍্যস্ত জীবনে এক চিলতে অক্সিজেন নিচ্ছি। মিমি ডাকল। রাস্তা দিয়ে সে রথ টানছে। প্রথম রথের দড়ি হাতে পেয়ে গড় গড় চলছে। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। সিঁড়ির কোনায় আমার পুরনো রথের দিক চোখ পড়ল। আবার ‘মি-মি’ ডাকে ঘুরে তাকালাম। তারপর মিমির সাথে হেঁটলাম। অতীতে….

                        আজ যখন আপনারা এই লেখাটা পড়ছেন আর আমি যখন লিখছি সেটা তখন অতীত। আর একটু অতীতে হেঁটে গেলে বছর দুয়েক আগে চলে যাই রথযাত্রার পীঠভূমিতে… পুরীতে। পুজোর ছুটিতে পুরীতে এসে দুটো নতুন জিনিস লক্ষ্য করবো সেটা আগে থেকে বুঝে এসেছিলাম। বোনের মুখে শুনেছিলাম। বোন পুরাতত্ত্ব বিভাগের একজন গবেষক হওয়ার দরুন পুরি শহরকে নিয়ে একটা পুরো  লিখেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগ থেকে এই গবেষণাটি করা হয়। ওর মুখে শোনা একটি বিষয়ে নিজে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য পুরীর সৈকত থেকে শুরু করে জগন্নাথ মন্দির পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। আপনার আমার সাথে একটা বিষয়ে একমত হবেন। সমুদ্র সৈকত থেকে যখন মন্দিরের দিকে হেঁটে যাওয়া যায় তখন আমাদের জমির উঁচু ভাব বা উচ্চতাটা ভালোই টের হয়। অর্থাৎ কিনা মন্দির উঁচু জায়গায় অবস্থিত এবং পুরোপুরি শহরের মধ্যে মন্দিরটি একটি দেশে অবস্থান করেছে মন্দিরটি মধ্যে যে আমরা চারটে দরজা দেখতে পাই তা ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় মূল মন্দিরটি অবস্থিত। এই পর্যন্ত আমাদের সবার অভিজ্ঞতা আছে। এবার মন্দিরের স্থাপত‍্যের দিকে আপনাদের নিয়ে যাব। মূল মন্দিরের স্থাপত্যে একটা ব্যাপার খেয়াল করলে দেখব যে সেখানে তিনটে তিনটে প্রতীক রয়েছে| তিনটে প্রতীক কি কি? এক. মন্দিরের পাদদেশে জগন্নাথ বা জগতের প্রতিপালক শ্রী বিষ্ণুর পদ্ম যেটি মন্দিরের মূল কাঠামোর ভিত তৈরি করেছে। দুই. হল বিষ্ণু বা নারায়ণের হাতের গদা যা মন্দিরের অক্ষ এবং গৃহ তৈরি করেছে যেখানে বিগ্রহ তিনটি অবস্থান করছে। তিন. মন্দিরের চূড়া টি হল চক্র আকৃতির যার ওপর মন্দিরের ধ্বজা সূচক মন্দিরের মূল অক্ষ বা গৃহ এবং একদম ওপরের সূচক চক্রটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত। সুতরাং শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী নারায়ণের সমস্ত প্রতীকী আমরা মন্দিরে দেখতে পাই। দাঁড়ান দাঁড়ান… সমস্ত প্রতীক কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? না, তার উত্তর হলো আমরা পাচ্ছি না। তাহলে চলুন আমরা শেষ প্রতীকটি অর্থাৎ শঙ্খ প্রতীকটি খুজবো।

            আগের অনুচ্ছেদ এই আপনাদেরকে বলছিলাম পুরীর সমুদ্র সৈকত থেকে মন্দিরের উচ্চতার কথা। তাহলে কী দাঁড়াল মন্দিরটি একটি উচ্চভূমি টিলার উপর অবস্থিত। আমি আগেও বলেছি মন্দিরটি পুরি শহরের একটি দিকে অবস্থিত।দক্ষিণে ঠিক তার কোনাকুনিভাবে স্বর্গদ্বার অবস্থিত। ওপরের থেকে আমরা সমুদ্র সৈকতের দিকে হাঁটতে থাকলে জমির নিচু ভাবো খেয়াল করতে পারি সুতরাং জমির একদিকে ধীরে ধীরে উচ্চতা এবং আরেক দিকে সমুদ্রের তলায় নেমে আসা তা বুঝতে পারছি। সমুদ্রের উল্টো দিকের শহরের অপর পরিসীমা নিশ্চিত করছে ভার্গবী নদী। পুরীর সমুদ্র থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় পাঁচ ক্রোশ এর এবং পুরি শহরটি মোটামুটি দশ ক্রোশ ক্ষেত্রফলেমন্দির ঠিক বিপরীত দিকে আমি যদি আরেকটু কোনাকুনি থেকে চলে যাই তাহলে পাব লোকনাথ মন্দির, সেই মন্দির পুরী শহরের একদম প্রান্তভাগে অবস্থিত এই লোকনাথ মন্দির। এহেন পুরী জগন্নাথ মন্দির কে কেন্দ্র করে ভার্গবী নদী ও সমুদ্রতটকে পরিসীমা ধরে এবং বিপরীত দিকে স্বর্গোদ্বার, দক্ষিণে নীলকন্ঠ মন্দির ও উত্তরের লোকনাথ মন্দির কাছাকাছি এসে যদি আমার একটা রেখা দিয়ে সীমানা টানি তাহলছ দেখব সেই রেখার পুরো ক্ষেত্রফল এর আকৃতি হয় একটি শঙ্খর মত বা শাঙ্কবাকার। এবার আশা করি আমরা আমাদের উত্তর পেয়ে গেছি। নারায়ন এর চতুরর্থ চিহ্নটি হল পুরীর পুরো শহরের ক্ষেত্র-প্রকৃতি। অর্থাৎ শঙ্খের স্ফীত মধ্যভাগের উপর নীলাগিরি টিলার উপর অবস্থিত হল জগন্নাথ মন্দির এবং তার অক্ষ ধরে পূর্বদিকে বিরাজমান নীলকন্ঠ মন্দির এবং উত্তর-পশ্চিমে শঙ্খের মুখে অবস্থিত লোকনাথ মন্দির ও টিলার পাদদেশে স্বর্গদ্বার শহর ক্ষেত্র-প্রকৃতির এই বিশেষ অনুভূতি পুড়ে শহরটি পদব্রজে ভ্রমণ করলে তবেই সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার রাস্তা হতে পারে বলে মনে করি। এবার যখনই পড়ে যাবেন তখনই আমার পুরীর চিত্ররূপ ব্যাখ্যার কথা মনে করে শহরটির সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে একবার ঘুরে নেবেন এই বিশিষ্ট অনুভূতির সাক্ষী হতে। 

                              পুরী যাব আর জগন্নাথ মন্দির দর্শন করব না এরকম তো হতে পারেনা। ভক্তপ্রবীণ মন বলে শ্রীজগন্নাথ দেবই আমাদের টেনে আনেন।“সবই জগন্নাথের ইচ্ছা”। সেখানকার মানুষদের কথায় প্রাচীন মতে যাদেরকে সহিস বলা হয়। সহিস কেন? জগন্নাথ মন্দির এর কেন্দ্র ধরে যদি আটটি রেখা চারিদিকে টানা যায় তাহলে সে আটটি রেখা বা আট দিকের ব‍্যসার্ধকে বলা হয় সহিস। প্রাচীনকালে পুরি ছিল একটি সমুদ্র কেন্দ্র বা বাণিজ্য শহর কিন্তু বর্তমানে পুরীর বেশিরভাগ আদি অধিবাসীরা সবাই মন্দিরের পূজারী বা মন্দির এর সাথে কোনো না কোনো উপায়ে যুক্ত। শিবার এ রকমই একজন পূর্ব পরিচিত সেবায়েত এর সাথে দেখা হয়ে গেল, তিনি দেখেই বোন কে চিনতে পারলেন। কথায় কথায় বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া একটা কথা খুব মনে লেগে গেল । আগুন কত প্রকারের হয়? উত্তর হল দুই। উষ্ণ ও শীতল আগুন  ।তিনি বলতে থাকলেন কেন জগন্নাথ দেবের মূর্তি কাঠের তৈরি।আর কেন আগুনের কথা বলেছি? তিনি বলছেন কাঠের আগুন হল শীতল আগুন আর যদি জগন্নাথের মূর্তি কোন ধাতু কিংবা অষ্টধাতুর হত তাহলে সেই আগুন হত উষ্ণ তাহলে শীতল আগুনে তৈরি মূর্তি জগন্নাথ দেবের। আগুন শীতল কেন – তার উত্তরে তিনি বললেন কাঠের মধ্যে জল আছে এবং কাঠ এর ভূমি থেকে উদ্ভূত। তাই প্রজ্জ্বলণ তার শীতল।

এর মুল ভাবটি হল জগন্নাথ দেব কে তৈরি করা হলো আমাদের জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় তিনটে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এবং মানুষের সাথে তাঁর যোগ সাধিত হল। তিনি আরো বললেন সাধারণভাবে ভাবতে গেলে কাঠের মূর্তি বাস্তবধর্মী চিন্তা নয় কিন্তু পুরি এমন একটা জায়গা যেখানে ভগবান মানুষের হৃদয় বাস করেন এবং মানুষ ভগবান মিলে মিশে একাকার হন।কিন্তু মানুষ মরণশীল তাহলে ভগবান চির বিরাজমান।  সেই কাষ্ঠমূর্তিকে প্রত্যেক 12 বছরে কাঠের মূর্তি পরিবর্তন করা হয় । এবার এর বিশেষ অন্তত নিহিত অর্থ আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি অর্থাৎ ভগবান আবার নতুন ভাবে নতুন অবয়ব নিয়ে আমাদের সামনে অবতীর্ণ হচ্ছেন ঠিক যেভাবে তাঁর ভক্তসকল নতুন অবয়ব নিয়ে আবার জন্মগ্রহণ করেন। কারণ আত্মা অবিনশ্বর…. আত্মার কোন মৃত্যু নেই এবং এখানেই ভগবানের বাস। বিশ্বকবির লেখা দিয়ে শেষ কথা কই-

                   “পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি

                   মূর্তি ভাবে আমি দেব, -হাসে অন্তর্যামী।“

    আমাদের অন্তরে লীন হয়ে আছেন তিনি। সেই অন্তর্যামীর সঙ্গে মুখোমুখি হয় আমরা। বিশ্ব চরাচরের সকলকে নিয়ে জীবনের পথচলা। এই পথের অগ্ৰভাগে তাঁর রথ ও রথের সারথি তিনিই। 

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল