চলচিত্র সমালোচনাঃ
ছবি- কুম্বালাঙ্গি নাইটস (২০১৯)
পরিচালনা- মধু সি. নারায়নন
অভিনয়ে- ফাহাদ ফাসিল, শেন নিগম, সউবিন শাহির, আন্না বেন প্রমুখ
সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য এবং শোষণের ঝকঝকে এবং বুদ্ধিদীপ্ত চলচিত্রায়ন ২০১৯ সালের অস্কারের মঞ্চে প্যারাসাইট-কে এনে দিয়েছে সেরা ছবির পুরষ্কার। আর একই বছরে একটি ছোট্ট এবং সাবলীল গল্পে সমাজের বৈষম্য এবং ক্ষমতার রাজনীতিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, মালায়লাম ছবি কুম্বালাঙ্গি নাইটস ।
কিশোর ফুটবল-পাগল ফ্রাঙ্কি তার বন্ধুদের নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে লজ্জা পায়, কারণ যে ঝুপড়িতে সে তার তিন ভাই-এর সঙ্গে থাকে, সেটি সেই পুরো পঞ্চায়েতের সবথেকে নিম্নমানের বাড়ি, যদি তাকে আদৌ বাড়ি বলা যায় তো। কুম্বালাঙ্গি দ্বীপের আবর্জনার স্তুপ আর কুকুর বেড়ালের বাসস্থানের উপর নির্মিত, দরজা বিহীন সেই বাড়িটি, যেখানকার বাসিন্দারা সর্বদাই নিজেদের পারস্পারিক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত, গল্পের প্রাথমিক কর্মভূমি। অন্যদিকে দেখতে পাই একটি সুসজ্জিত, মধ্যবিত্ত গৃহকোণ, যেখানে দুই মেয়ে এবং এক জামাইকে নিয়ে বসবাস করেন একজন বয়স্কা মহিলা। বিবাহিত বড় মেয়ে তার স্বামীর থেকে দৃশ্যতই সন্ত্রস্ত। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাড়িটি হোম-স্টে হিসেবে ব্যবহৃত হয় যখন বিদেশি পর্যটকেরা আসেন কেরালা সরকারের নির্বাচিত এই ‘ইকো-ভিলেজ’ পরিভ্রমণে। গল্পের প্রথম আধ ঘণ্টার মধ্যে এই দুটি বাড়ি দুটি ভিন্ন ধরণের সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।
সামি, বাড়ির জামাতা, বাথ্-রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সযত্নে নিজের পুরুষ্টু গোঁপের পরিচর্যা করতে করতে নিজেকেই বলে, “রেমণ্ড- দ্য কমপ্লিট ম্যান”, আর তারপর আয়নায় লেগে থাকা ছোট্ট একটি টিপ (সম্ভবত তার স্ত্রীর ব্যবহৃত) তুলে ফেলে জলে ভাসিয়ে দেয়। চরিত্রটির ভুমিকা দৃশ্যের এই ছোট্ট মুহূর্তটিই খুব সফল ভাবে এই চরিত্রের গতি-প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে চার ভাই-এর ঝুপড়ি বাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই শুরু হয় হাতাহাতি, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়াই। কিন্তু গল্প যতই এগিয়ে চলে, আমরা দেখি হতদরিদ্র নিঃস্ব এই চার ভাইকে পরস্পরের কাছে আসতে এবং জোটবদ্ধ হতে। পরিবারের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে অদ্ভুত ভাবে, সমস্ত সামাজিক নিয়ম-কানুন, জাত-ধর্ম-বর্ণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এবং শেষমেশ ক্লাইম্যাক্স এ পৌঁছে মুখোমুখি সংঘর্ষে উপনীত হয় অন্য পরিবারটির ক্ষমতালোভী সদ্য প্রতিষ্ঠিত গৃহপতির সঙ্গে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে শিশুর মতো কাঁদতে থাকা একজন মৎস্যজীবী, একজন মূক মানুষ, এবং এক সদ্যকিশোর সরাসরি যুদ্ধে নামে সংজ্ঞায়িত পুরুষত্বের একজন ধ্বজাধারীর বিরুদ্ধে।
এই ছবির আত্মা লুকিয়ে আছে তার নারীচরিত্র গুলির মধ্যে- পুরো গল্প জুড়ে যাদের সুক্ষ অথচ জোরালো উপস্থিতি। তরুণী বেবিকে আমরা শুধু মাত্র প্রেম নিবেদন করতেই দেখি না, প্রেমের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করতেও সে পিছপা নয়। ছায়াময়, স্যাঁতসেঁতে সবুজের মধ্যেই তাদের প্রেমের সহজাত স্ফুরণ দর্শকের হৃদয় ছুঁতে বাধ্য। চার ভাই-এর মা, যদিও পুরো ছবিতে তাকে একবারই দেখতে পাই, আমাদের মননে উপস্থিত সমাজ নির্মিত তথাকথিত নিবেদিতপ্রাণ মাতৃমূর্তির ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে।
সামির ভুমিকায় ফাহাদ ফাসিলের অভিনয় অনবদ্য। প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর শক্তিশালী অথচ বিচিত্র উপস্থিতি দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলতে বাধ্য। বেবির ভুমিকায় আন্না বেন, তাঁর সুচারু এবং মনোরম চরিত্রায়নের জন্য প্রশংসার দাবী রাখেন।
ছবির প্রতিটি দৃশ্যই সুন্দর। কেরালার গ্রামজীবনের অপরূপ শ্যামলিমা, যা কিনা আরও বর্ণময় করে তুলেছে যথাযথ নেপথ্য সঙ্গীত, দর্শকের হৃদয়ে খুব সহজেই বাসা বাঁধে। ছবিতে ব্যবহৃত নেপথ্য সঙ্গীত আরও একটি কারণে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। ফাহাদ ফাসিলের চরিত্রটি অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে এই সঙ্গীতের গুণেই। কেরালা ব্যাকওয়াটারের মধ্যে অবস্থিত সুন্দর ছোট্ট গ্রাম আর উপকূলবর্তী নড়বড়ে বাড়িটি, কনরাড বর্ণিত দ্য লেগুন– এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
কুম্বালাঙ্গি নাইটস ছবিটি, যা কিনা মূলত দুটি বাড়ির পটভূমিতে সূক্ষ্মভাবে বিভক্ত, সমাজের লিঙ্গ ভুমিকার নিয়মনীতি নিয়ে একটি শক্তিশালী মন্তব্য পেশ করার পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার শ্রেণীক্রম নিয়ে প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হয় না, সৎ, সঙ্গবদ্ধ এবং সাহসী আক্রমণ যে সেই শ্রেণীক্রমকে ভাঙতেও সক্ষম, তাও তুলে ধরে। পরিশেষে একথা বলাই যায় যে, আলোচনা এবং প্রশংসার যোগ্য এইরকম একটি ছবি, দর্শকের ভালবাসা পাওয়ার দাবি রাখে।