জগন্নাথের সাথে রথযাত্রা আর রথযাত্রার সাথে ওড়িশার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । কিন্তু ওড়িশার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী রথযাত্রাটি কিভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে(History Of Rathyatra In Bengal) ঢুকে পড়ল সেটা আমরা অনেকেই জানিনা। আজ সেটাই একটু জেনে নেব।
হাওড়ার বাঁদুরি পরিবারের জগন্নাথ রথের দিনেও মাসির বাড়ি যায়না। পরিবারের ৬০০ বছরের রীতি বাঁদুরি পরিবারে জগন্নাথ দেব, রথের দিন বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেলা ঘুরে আবার নিজের বাড়ি ফিরে আসে।পরিবারের প্রথম পুরুষ সূর্য কুমার বাঁদুরি এই রথযাত্রার প্রচলন করেন।
প্রাচীনত্বের নিরিখে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রথযাত্রা কম প্রাচীন নয়। ১৭১৯ সালে বড়িশা গ্রামে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রথযাত্রা শুরু করেছিলেন রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরী। সেসময় ন’টি চূড়াবিশিষ্ট রথে শালগ্রামশিলা নিয়ে যাওয়া হত জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার পরিবর্তে।পরবর্তীকালে ১৯১১-এ জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ ও একটি ত্রিতল রথ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৪ থেকে মূর্তি গুলিকে রথের সময় হীরালাল বসুর বাড়িতে (যেটিকে জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’ ধরে নেওয়া হয়) নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮৪ সাল নাগাদ স পুরী থেকে কারিগর এনে নতুন রথ তৈরি করা হয়।
১৭৪০ সালে হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার রথ উৎসব শুরু করেন মধুসুদানন্দ।পুরীর রথের সঙ্গে গুপ্তিপাড়ার রথের প্রধান পার্থক্যই হল, পুরীর রথকে জগন্নাথ দেবের রথ বলে। আর গুপ্তিপাড়ার রথকে বলে বৃন্দাবন জীউর রথ। এখানকার রথের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এখানে ভান্ডার লুট হয়।রথযাত্রায় ভারতবর্ষের কোথাও এই ভান্ডার লুট হয়না।
মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথের ঐতিহ্যের কথা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়।মহিষাদল রাজ পরিবারের রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর সহধর্মিণী রানি জানকী রাজত্ব ভার গ্রহন করেন।১৭৭৬ সালে রানি জানকীই এই রথযাত্রা শুরু করেন।তৎকালীন সময়ে এই রথ তৈরিতে খরচ পড়েছিল প্রায় ৬৪ হাজার টাকা।
১৮৩৮ সালে এক লক্ষ ২২ হাজার ১১৫ টাকা খরচ করে রুপোর রথ বানিয়ে রথ যাত্রা শুরু করে রানি রাসমণি। সেই রথের সঙ্গে ছিল দু’টি সাজানো ঘোড়া, একটি সারথি এবং চারটি পরী। এগুলিও ছিল রুপোর। এই রথযাত্রা শুরু হয় ১৮৩৮ সালে। রথযাত্রা উপলক্ষে সে যুগে যুঁই ফুলের মালা কেনা হত কম করে আড়াই থেকে তিন মণ। আগে জানবাজারের রানি রাসমণির বাড়িতে হলেও এখন এই রথযাত্রা হয় দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে।
প্রায় দুশো বছর ধরে দর্জিপাড়ায় রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে হয়ে আসছে কূলদেবতা রাজরাজেশ্বরের রথযাত্রা। বাড়ির সকলে এ দিন চামর দিয়ে বাতাস করতে করতে তিন বার রথকে প্রদক্ষিণ করেন। পুজোয় করবী ফুল দিয়ে হোম করা হয়। এই উপলক্ষে দেওয়া হয় হরির লুঠ। রথের আর এক ঐতিহ্য ইলিশবরণ। নোড়ার উপর জোড়া ইলিশ রেখে ছোট মাছটির মাথায় সিঁদুর দেওয়া হয়। পরে ধানদূর্বা দিয়ে মাছ দু’টিকে বরণ করা হয়।
১৮৬২ তে নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জিউর রথযাত্রা শুরু হয় যা আজও চলছে। সূচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা তমলুকের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। এ প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা না বললেই নয়।১৮৬২-র রথযাত্রার দিনই শুরু হয় শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট ট্রেন চলাচল। সেই সময় এই রথযাত্রা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে রথের সময় বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করত। ই রথযাত্রাকে নিয়ে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ১৮৭৫-এ রথ উপলক্ষে ছুটি নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নৈহাটির বাড়িতে এসেছিলেন। ঠিক সেই বছরই রথের মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটি শুনে বঙ্কিম নিজেও মেলার মধ্যে মেয়েটির অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনাটির কয়েক মাস পরেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘রাধারানি’ উপন্যাসটি।
বউবাজার অঞ্চলে গোবিন্দ সেন লেনে জগন্নাথ বিগ্রহ ও রথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চুনিমনি দাসী প্রায় ১২৫ বছর আগে। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল এই রথে সাবেক শিল্পরীতির নমুনা দেখা যায়। রথের চার দিকে আছে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, এক বার পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট এক খণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহটি।প্রতি বছর পুরী থেকে পাণ্ডারা আসেন রথ উপলক্ষে।
কোলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসে আজও প্রাচীন রীতি মেনে মা লক্ষ্মীর ঘর থেকে আরতি করে রথযাত্রার শুভ সূচনা হয়। এর পরে রথে বসিয়ে জগন্নাথের মূল পুজো হয়। একে বলে ‘দাঁড়ে ভোগ’। এতে থাকে সন্দেশ, ফল ইত্যাদি ভোগ। তার পরে রথের রশিতে টান পড়ে। রথের মহাপ্রসাদের মধ্যে থাকে জগন্নাথবল্লভ, খাজা, গজা, খয়েরচূড়, নিমকি, কটকটি ইত্যাদি। আর ৫৬ ভোগের মধ্যে থাকে সাত-আট রকমের ডাল, ভুনিখিচুড়ি, শাক, নারকেলের পদ, বড়া, বড়ি, ঘণ্ট, ছেঁচকি, পরমান্ন ইত্যাদি। আর থাকে কাসুন্দি ও আচার। এ বাড়ির রথ বাড়ির বাইরে বেরয় না, বাড়ি সংলগ্ন নীলমণি উদ্যানেই টানা হয়।
উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলার সংযোগস্থল কাঁচরাপাড়ার রথতলার কৃষ্ণরাই-এর রথযাত্রা বিশেষ ঐতিহ্যপূর্ণ। শোনা যায়, কৃষ্ণরাই বিগ্রহটি বহু প্রাচীন। পুরনো মন্দিরটি নদীগর্ভে বিলীন হলেও, এখানকার জমিদার বীরেশ্বর নন্দীর পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি কাঠের রথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
#বাংলার_কিছু_বিখ্যাত_রথযাত্রা:=============================
#মাহেশ_ও_রথযাত্রা:-
=============================
৬২৩ বছরে পা রাখল মাহেশের ঐতিহ্যের রথযাত্রা। হুগলির শ্রীরামপুর শহরের মাহেশের রথযাত্রা আস্ত এক ইতিহাস। মাহেশের রথযাত্রা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।ইতিহাস বলছে, পুরীতে যাওয়ার পথে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’বলে আখ্যা দেন।
বলা হয়, প্রাচীনতায়, ঐতিহ্যে পুরীর পরেই মাহেশের স্থান। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ উপন্যাসে মাহেশে রথের মেলার উল্লেখ আছে। এই রথযাত্রা বহু মনীষী এবং রাজার স্মৃতিধন্য। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং এসেছেন এখানে। শ্রীমা সারদাদেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অনেক মানুষ রথের বিখ্যাত মেলা পরিদর্শনে এসেছেন |
শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির থেকে মাহেশেরই গুন্ডিচা মন্দির (মাসির বাড়ি) অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিশাল রথটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেবো। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।” এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
রথটি তৈরি করে দেন এক মোদক। ১৭৫৪ সালে রথযাত্রায় এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি জেলার দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু। তিনি রথের ব্যয়ভার বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। পরের বছর তিনি পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করে দেন। রথ চলাচলের জন্য মাহেশ থেকে বল্লভপুর পর্যন্ত দেড় মাইল রাস্তাও তৈরি করে দেন। তখন থেকেই ওই পরিবার রথের দায়িত্ব নিয়ে আসছেন।
মাহেশের জগন্নাথদেবের মন্দির নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করেন দেওয়ান কৃষ্ণরামবাবুর এক বন্ধু। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বাসিন্দা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রথ জীর্ণ হয়ে পড়ে। কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে নয় চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটিতে সেই কাঠের রথটি আগুনে পুড়ে যায়। এর পরে বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করান। মার্টিন বার্ন কোম্পানি রথটি তৈরি করে। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা।
১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। সেই থেকেই বছরের পর বছর ধরে এক ভাবে ওই রথ চলছে। চার তলবিশিষ্ট রথটি সম্পূর্ণ লোহার কাঠামোর উপর কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতা ৫০ ফুট। ওজন ১২৫ টন। ১২টি লোহার চাকা রয়েছে। এক একটি চাকার বেড় ১ ফুট। চার তলায় দেবতাদের বিগ্রহ বসানো হয়। তামার দু’টি ঘোড়া রথের সামনে লাগানো হয়।
এখানে ধুমধান শুরু হয়ে স্নানযাত্রার দিন থেকেই। প্রচুর দুধ-গঙ্গাজলে স্নান করে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার জ্বর আসে। আরামবাগ, গোঘাট এবং ঘাটাল থেকে তিন জন কবিরাজ আসেন। তাঁদের দেওয়া পাঁচনে ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন তিন দেবতা। রথযাত্রার এক দিন আগে রাজা হিসেবে অভিষেক হয় জগন্নাথের। সোজা রথের দিন রথে চাপিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গুন্ডিচাবাটিতে। মাহেশে গুণ্ডিচাবাটিকে বলা হয় কুঞ্জবাটী বা মাসির বাড়ি। অনেকে ভাবেন রথে চেপে জগন্নাথ তাঁর মায়ের বোন মাসির বাড়িতে আসেন। আসলে জগন্নাথ সখী পৌর্ণমাসির কুঞ্জে যান। অস্যংখ্য ভক্ত রশি টেনে রথকে জিটি রোড ধরে মাসির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। রথ চালানোর জন্য বিউগল কাসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। থামানোর জন্য বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হয়।
আটদিন ধরে সেখানেই চলে পুজোপাঠ ও ভোগ নিবেদন। প্রতিদিন প্রভুকে খিচুড়ি, নানারকম ভাজা, সাদা অন্ন, ডাল তরকারি, চাটনি, পায়েসের বোগ দেওয়া হয়। আর থাকে প্রভুরপ্রিয় মালপোয়া। সন্ধের ভোগে থাকে লুচি হালুয়া। আজ দূরদূরান্ত থেকেমানুষ আসেন মাহেশের রথযাত্রায়। রথ থেকে ভক্তদের ছোড়া হয় প্রসাদি কলা, বাতাসা, নকুলদানা। এখানে রথের মেলা চলে প্রায় একমাস ধরে।
=============================
#গুপ্তিপাড়া_ও_রথযাত্রা:-
=============================
আগামীকাল রথযাত্রা।সারা দেশ জুড়ে পালিত হবে এই উৎসব।প্রভু জগন্নাথ দেব তার ভাই বোনকে সাথে নিয়ে যাবেন মাসীর বাড়ি।রথ বলতেই আমাদের উড়িশ্যার পুরী ধাম এর কথা মনে এলেও আমাদের বাংলা রথযাত্রায় কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। শ্রীরামপুব় এর মাহেশ হোক, মেদিনীপুর এর মহিষাদল হোক, মায়াপুর এর ইস্কন হোক, অথবা গুপ্তিপারা কেউ কোন অংশে কম নয়।সব জায়গাতেই অতি সুপ্রাচীন রথ যাত্রা পালিত হয়।আজ আমি আপনাদের গুপ্তিপাড়ার রথ সম্পর্কে কিছু কথা বলবো।গত বছর আমি গেছিলাম গুপ্তিপাড়া রথ যাত্রার সাক্ষী থাকতে।
#ইতিহাস
১৭৬০ সালে বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজার প্রচলন গুপ্তিপাড়ায়, এটি বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী পুজা নামে প্রচলিত। কিন্তু গুপ্তিপাড়ায় রথ এর প্রচলন আরো আগে।যতদূর জানা যায় ১৭৪০ খ্রী মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের সময় এই রথ যাত্রা সূচনা করেন শ্রী মধুসূদানন্দ মহারাজ।পুরীর রথের সাথে গুপ্তিপাড়ার রথের প্রধান পার্থক্য হলো পুরীর রথ কে জগন্নাথ দেব এর রথ বলা হয়, কিন্তু গুপ্তিপাড়ার রথ বৃন্দাবন জিউ এর রথ নামে পরিচিত।পুরীর পর সবচেয়ে বেশি দূরত্বের পথ অতিক্রম করে এই গুপ্তিপাড়ার রথ।বছরের বাকি সময় বৃন্দাবন চন্দ্রের মঠ এর পাশে এই রথ অবস্থান করে ।রথযাত্রার দিন বৃন্দাবন চন্দ্রের মঠ থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা কে দেড় কিলোমিটার দূরে গোঁসাই গঞ্জ বড়বাজার এ মাসীর বাড়ি বা গুন্ডিজা মন্দিরে নিয়ে আসা হয়।
#আকৃতি
গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত রথ নির্মিত হয়েছে নবরত্ন মন্দির এর আদলে।যেখানে আমরা মোট নটি চুড়া দেখি।বর্গাকৃতির রথটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান, ৩৪ ফুট।চারতলা বিশিষ্ট এই রথ এর উচ্চতা ৩৬ ফুট।রথে সর্বমোট ১৬ টি চাকা আছে।রথ এর সামনে থাকে ৪ টি রশি, প্রতিটি রশি প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের।রথ এর পেছনে দেখা যায় ওপর একটি রশি , যা রথকে থামাতে সাহায্য করে।সামনে এই রসিগুলির একটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার এই রথ এর যথেষ্ট সুনাম। ৪০০ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। মেলা উপলক্ষে বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ 1 km পথের দু ধারে মেলা বসে। এছাড়া উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয়।
গুপ্তিপাড়ায় রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ‘কালী মির্জা’র জন্ম। এছাড়া বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা, বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লালের জন্মস্থান। বাংলার মিষ্টি গুঁপো সন্দেশ উদ্ভব হয় গুপ্তিপাড়াতে।সব মিলিয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত এই রথ সত্যি সবার মনে ভক্তিরস সঞ্চার করে।
#পথনির্দেশ
গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব হাওড়া (কাটোয়া লোকাল) থেকে রেলপথে ৭৫ কিলোমিটার ও ব্যান্ডেল থেকে ৩৫ কিলোমিটার। আসাম রোড দ্বারা সড়কপথে এই জায়গাটি কলকাতার সাথে যুক্ত। গঙ্গার অপর তীরে নদিয়া জেলার শান্তিপুরের সাথে জলপথে যোগাযোগ আছে। হাওড়া ও শিয়ালদা থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে সরাসরি পৌঁছোন যায় গুপ্তিপাড়া।এছাড়া ট্রেন এ ব্যান্ডেল পৌঁছে সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে গুপ্তিপাড়া আসতে পারেন। হাওড়া থেকে গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার।এছাড়া প্রাইভেট গাড়িতে g.t. road, দিল্লী রোড ধরে এসে ৬নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গুপ্তিপাড়ার রথতলা মোড়ে আসতে পারেন।
শুধু মাত্র রথযাত্রা নয়, গুপ্তিপাড়ার মন্দির নগরী হিসেবে খ্যাতি আছে।তাই এক যাত্রায় রথ দেখার সাথে সাথে কলা ব্যঁচাও হবে।
তাহলে আর দেরি কেন?যাঁরা সময়ভাবে কিংবা অন্য কোনো কারণে পুরি কিংবা মহেশ এ উপস্থিত হতে পারেন নি তাঁরা জয় জগন্নাথ বলে চাক্ষুষ করে আসতেই পারেন মন্দিরনগরী তথা জগন্নাথ দেব এর আপন শহর গুপ্তিপাড়া থেকে|©️শঙ্খচিল