“মাসিমা মালপো খামু” খ্যাত ‘সাড়ে চুয়াত্তর ” ছবির গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার;
১৭ জুলাই, সেই মানুষটার জন্মদিন।
যেকোনো একমাত্রিক ভাবনাই প্রগতির অন্তরায়। আর এটা বোঝেন তাঁরাই যাঁরা সমকালকে স্পর্শ করে চিরকালের হওয়ার পথে এগোন; খুঁজে নেন চিরন্তন আবহমানতাকে।
এই মানুষটাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আর ছিলেন না বলেই কোনো খোপে আটকে থাকেন নি।
এই খোপে আটকে থাকা বড় ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপার। শিল্প সাহিত্যে নান্দনিকতার তত্ত্ব আওড়ানো চশমা সাঁটা পন্ডিতদের তাই আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি ভয়ে।
যেমন ধরুন। মানিক। পার্টি সদস্য পদ নেওয়ার আগের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর পরের মানিক, এভাবেও দেওয়াল তোলার প্রবণতা দেখেছি। আবার প্রয়াত আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অরিজিৎ বাবু( নকশাল নেতা) তাঁকেও বলতে শুনেছি,”ওই ‘সাতটি তারার তিমির’ থেকেই নাকি জীবনানন্দের কাল চেতনা ধরা পড়ে,তার আগে থেকে নয়।”
ভূমি থেকে ভূমা,কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রাতিগ অবাধ বিচরণ রবি ঠাকুরের মতো ক’জন পেরেছেন। কিন্তু চেষ্টা করেছেন অনেকেই। সতত সে চেষ্টা শিল্প সাহিত্যকে টিকে থাকার হাত থেকে বাঁচতে শেখায়।
তাই ‘নবান্ন’ তে যে ন্যারেটিভ তৈরি করলেন বিজন ভট্টাচার্য তাকে ভেঙে বেড়িয়ে আসলেন পরবর্তী সময়ে।
শম্ভু মিত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য।ভাগ্যিস গণ নাট্যের ঘেরা টোপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন,নইলে একটা ‘চাঁদ বণিকের পালা’ পেতাম না আমরা। বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক এঁদের ক্ষেত্রেও সত্য সমানভাবেই।
এই যে ‘পোষ্ট নবান্ন পিরিয়ডের’ বিজন,তা কিন্তু আবহমানের খোঁজে পথ চলা বিজন ভট্টাচার্য। আবহমান মাতৃ চেতনা চলে আসে তাঁর লেখায়,কাজে। চলে আসে লোকায়ত এবং দেশজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রবণতা।
‘নবান্ন’ এ যে আঞ্চলিক উপভাষার প্রয়োগ করলেন বিজন তা ক্রমশ সাব অর্লটার্ন ক্লাসের মুখের কথা কে শিল্প সাহিত্যে জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলো। সমান্তরালভাবে একই কাজ করে গিয়েছেন তুলসী লাহিড়ী, শচীন সেনগুপ্ত রা।
পরবর্তী কালে সেই সাব অর্লটার্ন সাহিত্য যোগ্য হাতে পরলো। ব্যাটন তুলে নিলেন নবারুণ।
এই যে সমান্তরাল একটা ধারা। তাকে কখনো সেভাবে স্বীকৃতি চায়নি সাহিত্যের ইন্দ্র মিত্র বরুণ সম জাত কুলীন গোষ্ঠী। সেই ট্রাডিশন আজও।
উল্টো দিকে আর এক বিপদ রেজিমেন্টেড ফোর্সদের নিয়ে। সে আরো গোলমেলে ব্যাপার। ঋত্বিক, বিজনদের ‘ট্রটস্কি পন্থী’ বলে গাল দেওয়াটা হয়ে উঠেছিলো ফ্যাশন।
মেইন স্ট্রীম ভাবনা চিন্তা কখনো সমান্তরাল ভাবনা কে জায়গা দিতে চায় না। আমাদের শিল্প সাহিত্যের জগতেও তাই। উল্টোদিকেও তাই। তুমি আমায় কাউন্ট করো না,আমি ও তোমায় কেন কাউন্ট করব?
একটা লেখায় নবারুণকে লিজেন্ড বলেছি বলে, রে রে করে লোকজন আমার দিকেও তেড়ে এসেছিলো। এখন বাপু তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে যদি আমায় দ্যাখা না যায়,সে দোষ কী আমার হয়?
বাদল সরকার তখন মেইন স্ট্রীম প্রসেনিয়াম থেকে অনেক দূরে। একজন প্রথিতযশা নাট্যকার বাদল বাবুকে বললেন, ” বাদল দা আপনাকে তো আর দেখছি না! কাজ কর্ম কী বন্ধ? “
বাদল সরকার তাঁকে বললেন,” না। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে হয়ত আমায় দেখতে পারছেন না।”
এখন বাদল সরকারকেও যদি লিজেন্ড বলি তাহলেও হজম হবে না কারো কারো; নবারুণের ক্ষেত্রেও তাই। মূল ব্যাপারটা হলো কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছো তুমি…
যেকোনো খোপে আটকে গেলেই বিপদ। বিশ্ব সাহিত্য তার ফর্ম আর কনটেন্টে ক্রমশ গতিশীল। এক জায়গায় থেমে নেই। একজায়গায় থেমে নেই বলেই লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা সামনে আনছে। অন্যদিকে ক্লাসিক ইংরেজি সাহিত্য বলতে যা বুঝি,তা একজায়গায় এসেই থেমে গ্যাছে।
ওপার বাংলার গদ্য সাহিত্য ( এ নিয়ে পরে কখনো লিখব) ফর্ম আর কনটেন্টে আজ যেখানে পৌঁছে গ্যাছে, এপার বাংলায় আমরা তা থেকে অনেক যোজন দূরে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব ঘরানা থেকে আজও বেরুতে পারলাম না। সন্দীপন, কমলকুমার, নবারুণ এমন হাতে গোনা কয়েকজন বাদ দিলে ‘অফ বিট’ গদ্য বলতে যা বোঝায়, এখানে তা কই?
নবারুণের একমাত্র অনুবাদ গ্রন্থ ‘বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে’। পড়লে দেখবো, কেবল ভাল গোল গোল কিছু লেখা অনুবাদে পড়ানোই লক্ষ্য ছিলো না অনুবাদকের। বরং কী কবি, কী গদ্য, কী নাটক নির্বাচনে একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেন।
মার্কিন প্রতিবাদী কব কার্ল স্যান্ডবার্গ, নিকারাগুয়ার যুবক কবি ফার্নান্দো গর্দিনো সারভান্তেস, সোভিয়েত কবি লেভ ওজেরভ (হায় সোভিয়েত!), জাপানী কবি ইসসা, চিলির পাবলো নেরুদা, মাও সে তুং আর আন্না আখমাতোভার কবিতা আরো কিছু কবির যাঁরা কবিতাকে পুতু পুতু গোল গোল আবেগের প্রকাশ ভাবেবনি… গদ্যেও সেই ওয়ান অ্যান্ড অনলি মিখাইল বুলগাকভ দিয়ে শুরু তারপর লোরকার বন্ধু স্প্যানিশ কবি রাফায়েল আলবের্তি…
এখন ব্যপার টা হলো তোমার দ্যাখার। কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছ? আর কী দেখছো? অনেক ক্ষেত্রে এই দ্যাখা শোনাটা তোমার হাতে থাকে না। আর থাকে না বলেই, যে ‘সাড়ে চুয়াত্তর ‘ ছবিটা দেখে এখনো বাঙালি শনিবারের বিকেলে চা সহযোগে মুড়ি- বেগনী চিবিয়ে নষ্টালজিক মেস বাড়ি দেখে আরো নষ্টালজিক হয়ে ওঠে; মধ্যবিত্তের জীবন যন্ত্রণার অন্তঃসলিলা ধারাকে অনাবিল হাসির মোড়কে যিনি লিখেছিলেন,সেই মানুষটার নামও তো বিজন ভট্টাচার্যই; সেই ‘ নবান্নে’র বিজন আর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এর বিজনের মধ্যে কী দেওয়াল তোলা যায়?
ক’জন এখনো জানেন যে,’সাড়ে চুয়াত্তর ‘ বিজন ভট্টাচার্যের লেখা! ছবির চিত্র নাট্যও নির্মল কুমার দে’র সাথে যৌথ ভাবে লিখেছিলেন বিজন।
আবার ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা ‘ ছবিতে এই মানুষটা যখন হরপ্রসাদ হয়ে ওঠেন। তখন?
ঈশ্বর সমস্ত লজ্জা-গ্লানি ও পরাজয়ের ভারে পর্যুদস্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে যান। এই সময় ঘরে প্রবেশ করেন ঈশ্বরের বহুদিনের বন্ধু হরপ্রসাদ। ভেসে ওঠে সেই শিহরণ-জাগানো সংলাপ —
“রাত কত হল? উত্তর মেলে না’।”
© অশোক ভট্টাচার্য (রাজা)
চিত্র সৌজন্য : গুগল