সবার আগে জানতে হবে রাস কী? রাসযাত্রা না বলে কথাটা,রাসলীলা বলা ঠিক হবে।কার্তিক পূর্ণিমায় গোপী নারীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যোৎসব কে রাস লীলা বলে। তাই আজ তার সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম,ধৈর্য্য এবং সময় নিয়ে পড়বেন..আশা করি ভালো লাগবে।সবাই কে উৎসব মুখর এবং সৃষ্টিশীল থাকার শুভ কামনা জানাই
সংস্কৃতে রস শব্দের অর্থ একদিকে অমৃত‚ আবার অন্যদিকে রস মানে আবেগ বা সুমিষ্ট স্বাদ | লীলা শব্দের অর্থ অভিনয় | বৈষ্ণবরা রাসলীলাকে বলে থাকেন ভগবান কৃষ্ণের সুমিষ্ট নৃত্যগীত‚ যার রসাস্বাদন অমৃতসমান |
প্রসঙ্গত বৈষ্ণবদের রাসলীলা এই উপমহাদেশের আদি নৃত্যরূপের একটি | একে শুধু লোকনৃত্য ভাবলে ভুল হবে | কত্থক‚ কুচিপুড়ি‚ মেইতেই‚ ভরতনাট্যম‚ ওড়িশি-সহ বহু নৃত্যধারার উৎস এই রাসলীলা |
মথুরা‚ বৃন্দাবন-সহ উত্তর ভারতের বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্রে জন্মাষ্টমী‚ হোলির মতো উৎসবে রাসলীলা পালিত হয় | আবার উত্তরপূর্ব ভারতে বৈষ্ণব গাঢ় প্রভাবে রাস মহোৎসব পালিত হয় | অসমে তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব রাসলীলা বা রাস মহোৎসব |
উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে রাসলীলার সবথেকে বেশি প্রভাব মণিপুরে | তার অন্যতম কারণ কিংবদন্তিস্বরূপ রাজা রাজশ্রী ভাগ্যচক্র | মেইতেই বংশের এই রাজার সিংহাসনে অভিষেক হয় ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে | তিনি বৈষ্ণব ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন | রাসলীলাস্বরূপ তিনি প্রবর্তন করেন মণিপুরি নৃত্যকলার |
পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় বৃন্দাবনে রাসলীলার প্রবর্তন করেছিলেন স্বামী শ্রী দেবাচার্য | রাসের বেশিরভাগ গান রচিত ব্রজবুলিতে | কিন্তু বিদ্যাপতির সেই ভাষা অনেক ভক্তরই বোধগম্য হতো না | তাই শুধু গান না গেয়ে শুরু হল নাচের মাধ্যমে অভিনয় করে দেখানো | যাতে গানের ভাব প্রকাশ পেতে অসুবিধে না হয় |
কথিত‚ বৃন্দাবনের জ্যোৎস্নাস্নাত গহন কুসুম কুঞ্জমাঝে যখন রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়‚ যখন ভাবের ঘোরে বিভোর হয়ে যান শিল্পী-ভক্ত সবাই‚ তখন আবির্ভূত হন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ | স্বহস্তে শিরোভূষণ পরিয়ে দেন সেরা শিল্পীকে | অর্থাৎ এখন থেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ওই মুকুটের মাধ্যমে বর্ষিত হল তাঁর উপরে | রাসলীলায় রাধাকৃষ্ণ পূজিত হন শ্রী রাধা রাসবিহারী রূপে |
#শান্তিপুরের_রাস_উৎসব
======================================
নদীয়া জেলার সুপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক গঙ্গা তীরবর্তী জনপদ শান্তিপুর।শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যের সাধনপীঠ শান্তিপুরের বাবলাগ্রামে।
কথিত আছে,মহাপ্রভু ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা নেবার পর শান্তিপুরে এসে শ্রী অদ্বৈত আচার্যের গৃহে নিত্যানন্দ প্রভুর সহিত নাম-সংকীর্তন করেন।এবং এখানে শচীমাতার সহিত সাক্ষাত করেন।
আনুমানিক ৫৫০বছর আগে অদ্বৈত আচার্যের বশংধর বড়গোস্বামী(আদি নাম মথুরেশ গোস্বামী) বাড়ী থেকেই রাস উৎসবের সূচনা হয়েছিল।চৈতন্য পরবর্তী যুগে যখন শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়।সেই সময় এই রাস উৎসবেই দুই ধর্মের মিলন ঘটান বড় গোস্বামী।
একদিকে শাক্ত মতে কালিপূজা,অপরদিকে বৈষ্ণব মতে রাধাগোবিন্দ জীউর পূজা এক ই সাঙ্গে রাস পূর্ণিমা তিথিতে শান্তিপুরে অনুষ্টিত হতে থাকে।
ধর্মের নামে হানাহানি বন্ধ করতে মথুরেশ গোস্বমী যিনি বড় গোস্বামী নামে খ্যাত বাড়ীর কন্যার সাথে নবদ্বীপের তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের(বঙ্গদেশে দীপান্বিতা অমাবস্যায় মৃন্ময়ী মূর্তিতে কালি পূজার প্রচলন করেন) প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন।যার জন্য শান্তিপুরে’আগমেশ্বরী’ কালি মন্দির আজ ও বিদ্যমান।
মোট ২৪টি রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহপূজা হয়। এক এক বিগ্রহ এক এক নামে পূজিত।বড়গোস্বামী বাড়ীর শ্রী রাধরমন জীউ,মধ্যম গোস্বামী বাড়ীর শ্রী গোকুলচাঁদ জীউ,ছোট গোস্বামী বাড়ীর রাধাবল্লভ জীউ।এছাড়া আর এক মহা পুরুষ শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী(ইনিও অদ্বৈত আচার্যের বশংধর এবং শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর স্নেহধন্য )বাড়ীর বিগ্রহ শ্রী শ্যাম সুন্দর জীউ।
বিভিন্ন বারোয়ারী কমিটি বিভিন্ন পূজা করেন যেমন,রাসকালি,সত্যনারায়ন,নটরাজ,বজরংবলী,সন্তোষী মা। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়,এখানে দেশ মাতৃকার মুর্তি পূজা হয়।ভারতমাতা ক্ল্যাব এই পূজা করেন।
শান্তিপুরের রাস উৎসব তিন দিনের।প্রথম রাস,মাঝের রাস,ভাঙারাস।ভাঙারাসের দিন দুর-দুরান্ত থেকে জনসমাগম হয়।৪২টি বারোয়ারি কমিটি তাদের শোভাযাত্রা বার করেন।তার সাথে ২৪টি বিগ্রহ বাড়ী আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন।রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি হাওদায় বসিয়ে পথ পরিক্রমা করেন।আর সঙ্গে থাকে রাই রাজা।১৮বছরের কমবয়সী কন্যা রাই রাজা সাজে।বৈষ্ণবমতে শ্রীরাধিকা একদিনের জন্য বৃন্দাবনের রাজা সেজেছিলেন।কৃষ্ণ তখন রাধা সেজেছিলেন।সেই ধারায় অনুপ্রানিত হয়ে রাসের শোভাযাত্রায় রাই রাজার প্রচলন।
শান্তিপুরের রাস উৎসব বৈষ্ণব ও শাক্ত পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে ইতিহাসের পাতা থেকে আজ ও।
#নবদ্বীপের_রাসযাত্রা
=======================================
রাস নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। শরৎকালে শারদোৎসবের পরেই শুরু হয় উৎসবের বাড়বাড়ন্ত। কীর্তিকীপূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় নবদ্বীপের শ্ৰেষ্ঠ লোকায়ত উৎসব ‘রাস”। এখানকার রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে মূর্তির বিশালতা। অপরূপ মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে নানারূপে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মূর্তিতে কত কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী, কত বিচিত্র রূপকল্পনা, কত ব্যাপক ধর্মীয় ব্যঞ্জনা, কত পণ্ডিতের গভীর উপলব্ধির সুস্থিত বহিঃপ্রকাশ, কত শিল্পীর নিখুঁত চিত্রায়ণ—যা সম্মিলিত রূপে অসংখ্য মানুষের মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। নবদ্বীপের রাস তো শুধুমাত্র উৎসব নয়, ধর্মীয় দ্যোতনার এক ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি।
নবদ্বীপের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাস উৎসব।রাস যাত্রা কৃষ্ণভাবনায় অর্থবহ হলেও নবদ্বীপের রাস যাত্রার বিশেষত্ব হচ্ছে বৈষ্ণব শাক্ত শৈব।এই তিন সম্প্রদায়ের কল্পনাপ্রসূত অসংখ্য প্রতিমার পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রতিবছর রাসে।
দেয়ারাপাড়ার অলোক নাথ কালি বা এলানে কালী প্রথম রাসের কালী।সেই সমকালে এই বিভিন্ন মূর্তিতে পুজো শুরু হয় নবদ্বীপে।নবদ্বীপ ব্যাটারা পাড়ার আম পুলিয়া পাড়ার শবশিবা মাতা,তেঘরি পাড়ার বড়শ্যামা মাতা,ব্যানার্জি পাড়ার দেবী গোষ্ঠ মাতা,চারিচারা বাজারের ভদ্র কালী মাতা।এছাড়াও ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে রাসযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।গৌড় গঙ্গা বড় গঙ্গা মুক্তকেশী মহিষ মর্দিনী মেজ শ্যামা ছোট সামা রণচন্ডী মহিরাবন বধ বামা কালী মহানিশা ইত্যাদি প্রতিমা গুলি বৈচিত্র ও ঐতিহ্যের দাবি রাখে।
বর্তমানে রাসযাত্রা উপলক্ষে রাসের প্রথম দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহিলাদের নাচ সেই সাথে তাসা পার্টি ব্যান্ড পার্টির কানফাটানো বাজনা ঢোল সানাই বাজনা মেতে ওঠেন শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা।
পুজোর পরে আড়ং বা শোভাযাত্রা হয়।গোলাকারে চার চাকার মধ্যে দিয়ে প্রতিমাকে বসিয়ে নবদ্বীপ শহরের বিভিন্ন জায়গা পরিক্রমা করানো হয় এর জৌলুস প্রত্যক্ষ করেন লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী।গত বছর থেকে নবদ্বীপে রাসে প্রথম শুরু হয়েছে রাসযাত্রা কার্নিভাল।
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য : গুগল