আজও কি একলা বৈশাখ নাকি পয়লা বৈশাখ?

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
1407 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

স্বার্থের লোভে মিথ্যারে যেনো করিনা গো আশ্রয়ে..
সত্যের পথ হোক না দুঃখময়ে..
দুঃখ থাক মিথ্যা যাক..
আলো দেখাও….
সত্যের পথ মঙ্গলও পথ
তাই শেখাও..

বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কানে কানে এসে বলছে যেনো “ভুলিয়া যা রে আপন পর/পর কে নিয়ে আপন কর
বিশ্ব তোর নিজের ঘর/আবার তোরা মানুষ হ ” তাই পুরোনো বৈশাখের স্মৃতি-স্পর্শে এই রাবীন্দ্রিক সভ্যতা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লো।শহরে চলত ঘোড়ায় টানা গাড়ি , চিনে সিঁদুর ওলা ঘুরত নিস্তব্ধ দুপুরে। তখন কলকাতায় কত বড় বড় মহীরুহ, জলাশয়। গরমকালে টানা পাখার দরকারই পড়েনা বেশিরভাগ বাড়িতে। দিনের আলো মুছে গেলে ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে প্রদীপ, হ্যাজাক, লন্ঠন। রাস্তায় জ্বলে গ্যাসের বাতি। সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির ছাদে গিয়ে বসেন নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী। তাঁর সামনে বরফে ঠান্ডা করা তালশাঁস, জুঁই ফুলের গোড়ে মালা, তাঁর কনিষ্ঠ দেবর শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সামনে বসে বসে কখনও পড়ে শোনায় নতুন লেখা কবিতা, কখনও ধরে সদ্য সুর করা গান। একটা ফিনফিনে চাদর উড়িয়ে, হাতে রূপো বাঁধানো ছড়ি নিয়ে এসে হাজির হন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবির দাদা। অন্ধকার ছাদে হ্যাজাক জ্বেলে দিয়ে যায় ভৃত্যরা। জ্যোতিরিন্দ্র মহামূল্য ব্রান্ডির বোতল থেকে গ্লাসে পানীয় ঢালেন। স্বর্গের সুরসভার থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে জোড়াসাঁকোর ছাদ-বারান্দা।

পরদিন ভোরের আলো ফোটবার আগেই জেগে ওঠে ঠাকুর বাড়ি। অবশ্য শুধুই ভৃত্যদের ঘুম ভাঙে। বাড়ির আর কেউ জাগেনা। শুধু রবীন্দ্রর পিতা দেবেন্দ্রনাথ উঠে পড়েন ভোরের আলো ফুটবার আগে আগেই। তিনি কিছুদিন ধরে যেন কোনও বৈদিক ঋষির মতো জীবন যাপন করছেন। নিজের জীবনকে তিনি করে তুলেছেন নিপাট অনাড়ম্বর। ভৃত্যরা রুটির ওপর মাখন দিয়ে সেঁকতে বসে যায়। বাজারে যাবার তোড়জোড় শুরু হয়।

রবির পিঠোপিঠি দাদা সোমেন্দ্রনাথ এক ঝুড়ি বিস্কুট আর এক কলসি দুধ নিয়ে ঠাকুর বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ান। সারা পাড়ার কুকুর বিড়ালরা ছুটে আসে রবির সোমদাদার সামনে। একটি বিড়ালের পা ভাঙা। সে মুমূর্ষু, হাঁটতে পারছেনা। দূর থেকে মিউমিউ করছে। সোমদাদা দৌড়ে গিয়ে বেড়ালটাকে কোলে তুলে নেন। তারপর ডাক দেন রবি… ওই রবি, শিগগির অায়, দ্যাখ বেড়াল ছানাটার পা ভাঙা। রবীন্দ্র ছুটে আসে। সেকি কোনটার পা ভাঙল? রবীন্দ্র মুমূর্ষু বিড়ালটিকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। ওষুধ দেয়। কাদম্বরী চোখ পাকিয়ে বলেন। আবার একটাকে আনলে রবি? তুমি তো সবসময় থাকবেনা। সেইতো আমাকে দেখতে হবে রোজ। আমার ওপর আরও কত কী দায় চাপাবে বল দেখি? রবি প্রতিবাদ করে। বউঠান, একে সোমদাদা এনেছে।আমি বহু বারণ করেছিলুম, বলেছিলুম বউঠান রাগ করবে, সোমদাদা তবু দিয়ে গেল, কোনও কথা শুনলনে । কাদম্বরী রবিকে থামিয়ে দিলেন। থাক। সকালবেলায় এত মিথ্যে কথা বলতে হবেনা।আহারে দুধের শিশু।আয় আয় চু চু। জ্যোতিদাদা রবির ঘরে উঁকি দিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে যান। কাশ্মীরি কাজ করা পাঞ্জাবি অার তসরের জরিপাড় ধুতিতে কী সুন্দর দেখাচ্ছে জ্যোতিদাকে। রবি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।

কলকাতার দক্ষিণে গাছপালাঘেরা বিরাট একটা বাড়ি ভাড়া করে ঠাকুর বাড়ি থেকে আলাদা থাকছেন রবির মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনী। তাঁর স্বামী থাকেন দূর প্রবাসে। সত্যেন্দ্রনাথ ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম আই সি এস — ব্রিটিশ সরকারের এই মর্যাদাপূর্ণ চাকুরির কঠিন পরীক্ষায় ভারতীয়রা সহজে উত্তীর্ণ হতে পারেনা। তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী নিজের শিশুকন্যা শিশুপুত্রকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার সুনশান এলাকায় একা থাকেন। যদিও কাজের লোক থাকে। কিন্তু বাবা,স্বামী,শ্বশুর প্রভৃতি কোনও পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কোনও ভদ্রবাড়ির বঙ্গনারী শহরে একা বসবাস করছে এই ঘটনা কলতাতায় তখন অভাবনীয় । কলকাতার এলিট সোসাইটিতে তখন কানাকানি। সকলে বলছে এটা ঠাকুরবাড়ির পক্ষেই সম্ভব। ভদ্রঘরের কোনও বাঙালি যুবতী মেয়ে দুটি বাচ্চা নিয়ে একা থাকছে। তার শ্বশুড়বাড়িতে থাকার এলাহি জায়গা সত্ত্বেও সে থাকছে আলাদা বাড়িতে- এমন অদ্ভুত ঘটনা কলকাতা শহর সেই প্রথম দেখছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আকাশ হঠাৎ কালো হয়ে আসে, হু হু করে বাতাস বইতে শুরু করে। আজ জ্ঞানদানন্দিনী রবিকে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁর দক্ষিণের বাড়িতে। জ্যোতিদাদাও রাতে ওখানেই খাবেন। নতুন বউঠান যাবেননা। রবির দুই বউঠানের ভিতর পরস্পর একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব রয়েছে। কাদম্বরী একা একা বসে থাকবেন জোড়াসাঁকোর প্রকান্ড মহলে। হাওয়া এসে নিভিয়ে দেবে প্রদীপ। জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতে তখন উঠবে খুশির তুফান। জ্যোতিদাদা পানীয় নিয়ে বসবেন। রবিকে সবার পিড়াপিড়িতে মজার মজার গান করতে হবে; নাহলে পার্টি জমবেনা। কোনও বঙ্গললনা একা একা বাড়িতে পার্টি দিচ্ছে এটাও সেই প্রথম দেখল কলকাতা শহর। জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িটা যেন কলকাতার বুকে এক টুকরো লন্ডন। ওয়াইনের গ্লাসে গ্লাসে টুংটাং শব্দ ওঠে। নারী পুরুষ পরস্পর সাবলীল গল্প করে। রবীন্দ্রর ভাল লাগে এই মুক্ত পরিবেশ।

রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী ঠাকুরবাড়িতেও অনেক নতুন নতুন বিপ্লব করেছেন। স্বর্ণকুমারীর রূপের জৌলুস পূর্ণ চন্দ্রকে ম্লান করে দিতে পারে কিন্তু রূপ নয় স্বর্ণকুমারীর অহঙ্কার তাঁর নিজের জ্ঞান নিয়ে। ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত, অারবি ভাষা ছাড়াও সাহিত্য, গণিত ও পদার্থবিদ্যায় সুপন্ডিত রবীন্দ্রনাথেরর এই দিদিটি। শুধু মেয়েদের নিয়ে তিনি একটা অাড্ডা বসান প্রতিমাসে। শাড়ি গয়নার আলোচনা বা পরচর্চা সেখানে হয়না। যেকোনও সামাজিক রাজনৈতিক কাজের সমালোচনা হয়, সাহিত্য আলোচনা হয় স্বর্ণকুমারীর সেই আসরে। মেয়েদের সংসারের পরিমন্ডলের বাইরে কিছু করবার একটা মঞ্চ তৈরি করতে চান স্বর্ণকুমারী।

বাঙালি মেয়েদের লিখবার, রাজনীতি করবার প্রেরণা জোগান রবীন্দ্রর দিদি স্বর্ণকুমারী। জ্ঞানদানন্দিনী কলকাতার বাঙালি সমাজকে একটা সুস্থ ভোগবাদের রাস্তা দেখাতে চান। তিনি তাঁর জীবন যাপনে বলতে চান আমোদ প্রমোদ মানেই বেলাল্লা নয়। মদ্যপান করলেই মাতাল হয়ে ভুলভাল বকতে হবে তাও নয়। একটা বিলিতি কালচার তিনি নিজের কলকাতার বাড়িতে গড়ে তুলছেন।

কাদম্বরী এসব কিছুই করেননা। তিনি ঠাকুরবাড়ির গাছে জল দেন, মাতৃহারা রবিকে রেঁধে খাওয়ান, রবির কবিতা শোনেন। সকালে ভিস্তিওলা রাস্তা ধুয়ে দিয়ে যায়, সন্ধেবেলা গ্যাসের বাতি জ্বলে টিমটিম করে। নতুন বউঠান কাদম্বরী ধীরে ধীরে একেবারে একা হয়ে যান। কলকাতা শহর নিজের মত নতুন নতুন চিন্তা করতে শেখে, নতুন নতুন আমোদ করতে শেখে, কাদম্বরীর বিরাট ঘরে সন্ধেবেলা আলো জ্বলেনা।তাঁর ঘরের নম্র অন্ধকার থেকে একটা মৃদু সুগন্ধ ভেসে যায় বাতাসে। সেদিন বৈশাখ এক ছিলো কিন্তু সুস্থ ছিলো,শুভ ছিলো…

‘শুভ’ বলতে গেলেও কোথাও বাধছে।এই পয়লা বৈশাখে মিষ্টির প্যাকেট নেই,নতুন জামা নেই,পথেঘাটে ভিড় নেই- আছে শুধু আতঙ্কের প্রহর গোণা।কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। পয়লা বৈশাখে আসুন শপথ নিই, মহামারীর সঙ্গে এই রেসে পয়লা নম্বরে আমরাই থাকবো।সবাইকে তাই জোর গলায় জানাই ‘শুভ নববর্ষ’- ‘শুভ’ হবে সব!

চেয়েছিলাম প্রাণ ভোরে নিঃস্বাস নিতে
আটকে রাখলে ঘরে
চেয়েছিলাম মিলবো এক প্রাণে এই বৈশাখে
ফের দেখা হবে হয়তো চৈতি রাতে জ্যোৎস্না স্নানে

©️শঙ্খচিল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল