তুমি আমাকে বলো,’উত্তমকুমার’..এই….ই বলো না..”
‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির সিধুর এই মনোবাঞ্ছা কমবেশি সব বাঙালি ছেলেদেরই একসময় ছিলো।
মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে টেরি বাগিয়ে নিজেকে উত্তম ভেবে প্রেম নিবেদন.. অন্তত নয়ের দশকের প্রথম দিকেও বাঙালি ছেলেদের একটা অংশ এমন ভাবে ভাবত।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম প্রেমে পড়ার চিত্রনাট্য টা ‘সপ্তপদী ‘ দ্যাখার পরপরই মনে মনে ভেবে ফেলেছিলুৃম। তবে, উল্টো দিকের রীনা ব্রাউন যে সব সময় সাড়া দ্যায়না,এ হিসাব বুঝতে পারিনি। গোলমালটা সেখানে পেকেছিলো। অতএব, পরবর্তী পর্যায়ে নিজেকে ‘শুন বর নারী’র উত্তম ভাবা শুরু।
সমাজ সেবার ভুত চেগেছিলো বোধহয় ওই ‘শুন বর নারী’ দেখেই।
আভিজাত্যের অহংকার ছিলো বটে লোকটার। তবে সেই অহংকার কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেননি কখনো উত্তম।
খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এই আভিজাত্য আর রুচির সাথে আপোষ করতেন না পারতপক্ষে।
সম্রাট মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শোনা…
পিঁড়ি পেতে খেতে বসতেন। সে পিঁড়ি স্পেশাল ভাবে তৈরি ছিলো কাঁঠাল কাঠের। যে পদই থাকুক, বাটি চচ্চড়ি তাঁর চাই ই চাই। একদিন ময়রা স্ট্রীটের বাড়িতে সুপ্রিয়া দেবী পাত পেড়ে খেতে দিয়েছেন উত্তম কে,কিন্তু সেদিন বাটি চচ্চড়ি নেই। ব্যাস। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন উত্তমকুমার। ঝগড়া। অতঃপর সেই অবস্থাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অন্যদিকে উত্তম যত হাঁটছেন ততই চোখের সামনে,হাতের নাগালে স্বপ্নের মহানায়ককে দেখে বাড়তে লাগলো ভিড়। শেষ অবধি যানজট, পুলিশের আগমন…
এই ছিলেন উত্তম। সেলিব্রিটিসুলভ ওপর চালাকিটা ছিলো না। শুটিং ফ্লোরে টিফিন কেরিয়ার করে প্রভূত পরিমাণ খাওয়ার আসত তাঁর জন্য। নিজে সামান্য খেতেন, বাকিটা সহকর্মী মায় টেকনিশিয়ানরাও ভাগ করে খেতেন।
বাঙালির লড়িয়ে দেওয়া ইষ্ট বেঙ্গল – মোহনবাগান তো টালিগঞ্জকে কেন্দ্র করেও ছিলো। উত্তম না সৌমিত্র?
সিনেমার অ আা ক খ তখনো কিছুমাত্র বুঝিনা সেই সময় থেকেই আমার ভোট উত্তমেই।
কর্ণের প্রতি অদ্ভুত মায়ায় ভরে উঠতো অপুর মন। আমারও তেমনি ‘ঝিন্দের বন্দী ‘ কিম্বা ‘স্ত্রী ‘ দ্যাখার পর ক্যাথারসিস ঘটত,এখনো ঘটে। এবং যথারীতি সব সহানুভূতি ধায় মহানায়কের পানে… এর কোনো কার্য কারণ বিশ্লেষণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়৷ আর প্রেমের পড়ার কোনো কারণ হয় নাকি মশাই?
হিপোক্রেসি ছিলো না একেবারে। বড় বড় তত্ত্ব কথা আওড়াচ্ছেন উত্তম, এমনটি সচরাচর কখনো দ্যাখা যায়নি।
দায়বদ্ধতা, কমিটমেন্ট এই কথাগুলো ঢাক পিটিয়ে বলতেন না।
আবার সহকর্মী, কলা কুশলীদের ব্যক্তিগত বিপদে আপদে ‘বসু পরিবার’এর অভিভাবকের মতোই এসে পাশে দাঁড়াতেন, কিন্তু তা নিঃশব্দে।
বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চ যখন বিপদগ্রস্ত, অনটনে জেরবার। তখন অনেক তথাকথিত নাক উঁচু এলিট অভিনেতারা গা বাচিয়ে চললেও, স্রেফ বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য উত্তম মঞ্চাভিনয় করলেন ;না হলে ব্যক্তি উত্তম কুমারের এমন কোনো টাকার দরকার ছিলো না যে তাঁকে তাঁর ব্যস্ত সিডিউল ছেড়ে মঞ্চে অভিনয় করতে আসতে হয়। একেই বলে কমিটমেন্ট।
আজকের ‘শিল্পী সংসদ’ এর জন্মদাতা ছিলেন উত্তমকুমার। ডান- বামের দড়ি টানাটানি নয়, দুঃস্থ শিল্পী, কলাকুশলীদের পাশে ইতিবাচকভাবে দাঁড়ানোটাই ছিলো উত্তমের লক্ষ্য সমাজসেবা আর শিল্পীদের হয়ে লড়াইকে হাতিয়ার ক’রে নিজের রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ তাঁর লক্ষ্য ছিলো না। আর ছিলো না বলেই ‘শিল্পী সংসদ’ কে রেখেছিলেন সব রাজনীতির বাইরে।
আজ চালশে রোগে আক্রান্ত হয়েও আমার ইচ্ছে হয় কাউকে বলতে…
“তুমি আমাকে বলো উত্তম কুমার..”
আর আমি ‘সন্ন্যাসী রাজা’র মতো বলব…
” রাজা সাজার শখ আমার আর নেই…. আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম চাই। “
মহানায়ক আপনি বিশ্রাম নিন।
©অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা)
চিত্র সৌজন্য : গুগল