প্রতিবার এই ৮ ই জুলাই আসে, আর ফিরে ফিরে যাই দিন গুলোয়। স্মৃতির মেঘ ভিড় করে আসে চেতনা জুড়ে। আবেগের মেঘে ঢাকা পড়ে যায় সব যুক্তি, তথ্য, বাস্তব। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে একটা নাম। সৌরভ গাঙ্গুলি। আজ যে তাঁর জন্মদিন। এতো আবেগ কেন? আসলে কৈশোর পেরোনোর পর জীবনের ঝঞ্ঝাময় টালমাটাল দিনগুলোতে যে লোকটা দিয়েছিল লড়াই এর প্রেরণা, তাকে ভুলি কি করে? সে মিশে আছে প্রতিটি কোষে, রক্তবিন্দুতে। হৃদয়ে আজও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।
যতোই বলি নেশা, প্রতিভা আর চুলকানি চেপে রাখা যায়না। তবুও দেখি প্রতিভার প্রতি অবিচার বঞ্চনা কম নয়। যে সুভাষ চন্দ্র সারা জীবন দেশের জন্য লড়ে গেলেন, তাঁর অন্তর্ধানের তদন্তটাও হলো না ঠিক করে। জ্যোতি বসু কে প্রধানমন্ত্রী হতে দিলো না পলিটব্যুরো। ক্রিকেট টিমে সুব্রত ব্যানার্জি, উৎপল চ্যাটার্জি দের সেভাবে সুযোগ দেওয়াই হলো না। বাঙালি নিজেকে বঞ্চিত ভাববে এতে অবাক হওয়ার কি আছে? সেই বঞ্চিত বাঙালিদের মধ্যে থেকে লোকটা শুধু খেলে গেলো না, রাজ করে গেলো কয়েকটা বছর। তাকে নিয়ে আবেগে ভাসবো না তা কি হয়?
মনে পড়ছে শুরুর দিনটা। সম্বরণ বন্দোপাধ্যায়, কোচ ক্যাপ্টেন, অন্য নির্বাচকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ইন্ডিয়া টিমে গুঁজে দিলেন তাঁকে। তার নামে কতো অভিযোগ। উদ্ধত, টিমম্যান নয় একেবারেই, ফাস্ট বল তো দেখতেই পায়না। সব খবরই গিয়েছিল তার কানে। কিট ব্যাগ গোছানোর সময় সে জেনেই গেছিল টিমে সে নিতান্ত অবাঞ্ছিত, কেউ চায়না তাকে। হয়তো ব্যাটটাকে চুমু খেয়ে সে বলেছিল তুই আমার তলোয়ার, তোকে দিয়েই কাটবো সব অভিযোগের তীর। অথবা ব্যাটটাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিল, তুই আমার কলমকালি, তোকে দিয়ে লিখবো নতুন উপন্যাস।
উপন্যাসের শুরুটা সবার জানা। সবাই জানতো টিমের সাথে জল বইতে গেছে, কোথায় নামাবে ওকে? তারপর সেই দিন, সেই লর্ডস, সেই হুহু হওয়া, বলের এলোমেলো সুইং, সিধুর অসুস্থতা। আর ওয়ান ডাউনে সবাইকে অবাক করে আজহারের শত্রুকে দিয়ে বাঘ মারতে পাঠানো। সবুজ পাতায় উপন্যাসের প্রথম লাইনটা ছিলো একটা রাজকীয় কভার ড্রাইভ। দুই ফিল্ডারের মধ্যে দিয়ে ছিটকে বেরোনো এক জবাব। তারপর ৫০ করলো। ভগবানকে প্রণাম করলাম। যাক বাবা মান রেখেছে। আর সে দেখছিল অনেক দূর। এমন কিছু করতে হবে, যাতে সেলোটেপ লাগে সমালোচকদের মুখে। সেঞ্চুরির পর সে ব্যাট তুলেছিল। কার জন্য জানিনা। ড্রেসিংরুমে বসে থাকা একপাল হায়নার উদ্দেশ্যে? তবে সেই তোলা ব্যাটে চোখে ঝাপসা দেখছিলাম আমি। জানিনা সম্বরণ বাবু কতোটা সংবরণ করতে পেরেছিলেন নিজেকে।
সমালোচনা তার কম হয়নি। অফ সাইডে ভগবান, লেগ সাইডে অজ্ঞান। ইডেনে টেস্ট শুরুর আগে প্র্যাকটিস সেশনে দেখেছি উঠতি বোলারদের দিয়ে শুধু লেগে বল করানো। তিনি জানতেন, কেউ নেই তাঁর,টেকনিক ও ততোটা না। অতএব ট্রাই এন্ড ট্রাই। এই লড়াইটাই তো শিখিয়ে গেছেন জীবনভর। নুয়ে পড়া বাঙালিকে দেখিয়েছেন এক নতুন জীবনদর্শন। গৌতম ভট্টাচার্যের ভাষায় যার নাম দাদাতন্ত্র।
কী নেই সেই দাদাতন্ত্রে। আজও চোখের সামনে কোলাজের মতো ভেসে ওঠে ছবি গুলো। অফসাইডে একের পর এক লিখে যাওয়া কবিতা। সব অপমান, সমালোচনার জবাব ছিটকে বেরত যেন। বেদি, ভোগলে, শাস্ত্রীরা মুখ লুকোতেন সেই রাজকীয় কভার ড্রাইভ এর সামনে। স্টেপ আউটে মারা ছয় গুলো উড়িয়ে দিতো বাঙালির সব বঞ্চনা। মনে পড়ে পাকিস্তানের সাথে সাহারা কাপ।যে পাকিস্তানকে দেখলে হাঁটু কাঁপত, সেই পাকিস্তান বল ফেলার জায়গা পাচ্ছে না। ৪-১ এ সিরিজ জিতল ভারত। ৪টে তেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ আমাদের ভেতো বাঙালি। চিমটি কাটতাম গায়ে। স্বপ্ন দেখছি না তো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা কাপ। তিন ম্যাচের ফাইনালে ভারত পাকিস্তান ১-১ হয়েছে। এবার থার্ড ফাইনাল। পাকিস্তানের বড় রানের ইনিংস। শচিন আউট। তারপর তিনি। আজও চোখের সামনে দেখতে পাই দিনটা। মাঠে আলো কম। এই প্রথম দেখলাম ফিল্ডিং করা দল আলো কমের জন্য খেলা বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছে। আর ব্যাটসম্যান চাইছে খেলতে। আসলে তার ব্যাট অন্ধকার করে দিয়েছিল পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। তাঁর মহারাজকীয় সেঞ্চুরি ভাসিয়ে দিয়েছিল শুধু বাংলা নয় গোটা ভারতকে। কানিতকার চার মেরে জিতিয়েছিলেন দেশকে। মনে পড়ে পাকিস্তান সফর।সেখানেও তিনি। বাঘের গুহায় গিয়ে সেঞ্চুরি করে বাঘ মেরে আসা, ভাবতে পারেনি আগের রথি মহারথিরা।
তিনি ভেবেছেন, করে দেখিয়েছেন।তাই তো তিনি দাদা। মনে পড়ছে টনটনের সেই বিশ্বকাপের ইনিংস। সেই ১৮৩। জিওফ্রে বয়কট চেঁচাচ্ছেন ,”মাই প্রিন্স অফ ক্যাল্কুটা”। গাভাস্কার বলছেন, ” ইয়োর প্রিন্স অফ ক্যাল্কুটা!!!!” আমি চিৎকার করে সবাইকে বলছি, দেখ দেখ আমাদের সৌরভকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। কমেন্টেটর চিৎকার করছেন, আবার একটা বল হারিয়ে গেলো!! আমি খুঁজছি সেই সমালোচকদের। তাদেরকেও গ্যালারি পার করে দিলেন দাদা। বললেন, “বাপি, বাড়ি যা”। দেখিয়ে দিলেন সচিন আউট মানেই সব শেষ নয়। ম্যায় হু না।
তারপর সেই দিন। সেই কালো অধ্যায়। বেটিং পাঁকে নিমজ্জিত ভারত। ক্রিকেট থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে দেশবাসির। কোকাকোলা ঘোষণা করে দিল আমরা কোন ক্রিকেটারকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করাবো না। কারন জাদেজা তাদের মুখ পুড়িয়েছে। সচিন আর নেতৃত্বের বোঝা বইতে নারাজ। আবার ডাক পড়লো তার। এবার আর কোটায় নয়। যোগ্যতায়। নির্বাচকরা বুঝলেন পারলে এই পারবে। দ্য রয়াল বেঙ্গল টাইগার।
ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণ হয়েছিলো সেদিন। বিভিন্ন লবিতে ভাগ হয়ে থাকা টিমটা বাঁধা পড়েছিল এক সূত্রে। লড়াই শুরু তার। নাম নয়, পারফরমেন্স চাই। কোনো কোটা না, লবি না চাই লড়াকু যুবক। তার হাত ধরে এলো একপাল তাজা রক্ত। জহির,যুবি,ভাজ্জি,শেহবাগ,কাইফ দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ,দাদার জন্য জান লড়িয়ে দিতে পারে। তাদের চেষ্টা পূর্ণতা পেলো দাদার ভরসায়। খোলকে খেল, ম্যায় হূ সাথ। গঠিত হলো টিম ইন্ডিয়া। মাঠের মাঝে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ানো, যেন পতাকা থেকে অশোক চক্র নেমে এলো মাঠের মাঝে। এক নতুন ভারত। টিমে আদ্দি কালের নিয়ম ভেঙে এলো বিদেশি ফিটনেস ট্রেনার, মনোবিদ। টিমের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ গেলো বদলে। চোখে চোখ রেখে লড়তে শিখল সেই ভারত। অস্ট্রেলিয়ার বিজয় রথ গেলো থমকে।
ইংল্যান্ডের মাঠে উড়লো স্পর্ধিত জার্সি। টেস্টে ৭ নম্বর থেকে উঠে এলো দুই নম্বরে। বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠলো দেশ। সবাই দেখলো ভারতীয় দল। আমি দেখলাম এক কারিগর দুর্গম পথের খানা খন্দ ভরাট করে বানাচ্ছেন এক রাজপথ। যে পথে বিজয় রথ ছোটাবে পরবর্তী প্রজন্ম। ” দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলাম রাতে, সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে হাতে।” কি করে ভুলবো আজকের ধোনির সেই শুরুর দিন গুলো। সেই কম কম রানের ইনিংসের পরও তার প্রতি আস্থা রেখে যাওয়া। ধোনি হয়ত ভুলেছেন, কিন্তু আমরা ভুলিনি।
কি করে ভুলবো তাঁকে। তিনি আমার কাছে কোন ক্রিকেটার নন, ব্যাটসম্যান নন, ক্যাপ্টেন নন। আমার দেখা এক লড়াইয়ের নাম সৌরভ গাঙ্গুলি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বোম্বাইয়ের মাঠে নামলেন তিনি। চান্স পেয়েছেন কাম্বলির জায়গায়। প্যাডে বল লাগলো গোটা মাঠে উল্লাস। না আউট দিলেন না আম্পায়ার। তারপর তিনি ১৭৩। গোটা মাঠ উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালো। এর নাম লড়াই, বিরুদ্ধকে ঘাড় ধরে নতজানু করা। ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট।বাদ পড়লেন তিনি। পরের প্র্যাকটিস ম্যাচে ১০০। কে বাদ দিবি দে? ওয়ান ডে তে জায়গা পাকা হয়নি। ৩ থেকে ৭ নম্বর সব জায়গায় নামানো হল তাকে। প্রতিটি জায়গায় রান করলেন। ব্যাটা ফাস্ট বলে দুর্বল। ওপেন করাও। লেখা হোল ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের নব অধ্যায়। তাঁর ছোটবাবুকে সাথে নিয়ে গড়লেন ইতিহাস। সে আনফিট। গ্রেগ চ্যাপেল বাদ দিলেন তাঁকে। কিন্তু তাঁর জায়গা নেবে কে? আবার ডাকতে হোল তাকে। পাঠাও দক্ষিন আফ্রিকা। বাঙালি ভাবে কি? সৌরভ অপরিহার্য? নে দক্ষিন আফ্রিকা যা। বুঝবি মজা। নড়বড়ে ডিফেন্স ফেটে যাবে এবার। সাংবাদিকরা বললেন, দক্ষিন আফ্রিকায় কাম ব্যাক, কঠিন হয়ে গেল না ব্যাপারটা? চোয়াল শক্ত করে তিনি বললেন, যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলতে চায়, তার কোন অপশন থাকে না। যেখানে চান্স পাবো, পারফর্ম করবো। করলেন তিনি। প্রথম টেস্টে দলের হায়েস্ট রান তাঁর ব্যাট থেকে। চ্যাপেলিয় থিয়োরি তাঁর কাছে থুবড়ে গেল। তিনি আনফিট। আজো ইউ টিউবে আছে গাঙ্গুলির সেই সময় নেওয়া ক্যাচ গুলি। দেখলে চমকে যাবেন এখনও। তিনি পারেন। তিনি দেখিয়ে গেছেন, কোটা নয়, গডফাদার নয়, টেকনিকও নয়। আসল হল মানসিকতা। লৌহ কঠিন দৃঢ়তা, আর বুকের পাটা। তার জোরেই সব ওভারকাম করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ থাকলে বলতেন, আমি আজও অবাক হয়ে ভাবি কয়েক কোটি বাঙালির মধ্যে একটি গাঙ্গুলি কিভাবে বানিয়ে ফেললেন ঈশ্বর!
আজো তাই আমার আদর্শ ওই মহারাজা। তিনি যতবার জিতেছেন, ততবার জিতেছি আমি। তিনি শিখিয়েছেন কেমন করে সব প্রতিকুলতার মধ্যেও জ্বালিয়ে রাখা যায় লড়াইয়ের আগুন। কিভাবে টেকনিকে সমস্যা থাকলেও করা যায় দ্রুততম ওয়ানডে ৯০০০ রান। দাপিয়ে খেলা যায় টেস্ট। তাঁকে সামনে রেখে ব্যর্থতা ভুলে আবার তৈরি হয়েছি লড়াইয়ের জন্য। তিনি সেই লোকটা সবাই মিলে যাকে গর্তে ফেলে দেয়, আবার উঠে আসেন তিনি। বারবার প্রতিবার। তিনি সেই আগুন যাকে পা দিয়ে পিষে দিলেও আবার জ্বলে ওঠে নতুন করে। সেই লোকটাকেই যখন সবাই ঘাড়ে করে মাঠের বাইরে দিয়ে এলো তখন রক্তাক্ত হয়েছি আমি। যার মাঠে দাপিয়ে খেলার সময়, তাকে বাধ্য করানো হোল অবসর নিতে। সেই দুঃখ সেই রক্তক্ষরন আজো বন্ধ হয়নি।
আমি যে সেই লোকটা, যে প্রতিটা বল খেলত তার সাথে।তার আনন্দে কলজে লাফিয়ে উঠত, হারলে খাওয়া বন্ধ। আমি সেই লোকটা যে দাদাকে দেখবে বলে ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো বরিষার পুজো প্যান্ডেলে।আমি সেই লোক যে শুধু সৌরভের জন্য প্রদেশিকতার গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারলো না। এক ক্যান্সার রুগি যখন চিঠিতে লিখলেন সৌরভের লড়াই আছে তাই আজও বেঁচে আছি, তখন আবেগে ভেসে যাওয়া লোকটা এই আমি। দাদাগিরির মঞ্চে যে লোকটা সৌরভের সাথে হ্যান্ডশেক করার পর কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আমি এই হাতে কিচ্ছু টাচ্ করবো না, ছেলেকে গিয়ে বলবো ছুঁয়ে দেখ, এক লড়াই ছুঁয়ে এসেছি আজ। সেই লোকটার সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া মানুষটা আমি।
আজ দাদার জন্মদিনে শ্রদ্ধা ভালোবাসার আবেগে ভরিয়ে দিলাম তাঁকে। স্কোর বোর্ড গাধা, গাধাই থেকে যাবে। কোন মাপকাঠিতে মাপবে সে বঞ্চনার পারদ, লড়াইয়ের ডিগ্রি,আর মানসিকতার গভীরতা। সে দেবে কিছু তথ্য, আসল কথা লেখা থাকবে হৃদয়ের গভীরে, আবেগের অনুভূতিতে। তাকে মাপে কার সাধ্য। সেখানেই একাধিপত্য বজায় রাখবে এক মহারাজ। বেহালার বাঁহাতি।
চিত্র সৌজন্য : গুগল