বিগত পর্বের লিঙ্ক:-www.saabdik.com/kobi-katha-o-prem
(পর্ব- ২)
বিয়ের পর কাদম্বরী দেবীকে লেখাপড়া শিখিয়ে জ্যোতির উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সূচনা হয় তখন থেকেই। তিনি আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছিলেন খুব কম, কিন্তু সে তুলনায় শিখেছিলেন অনেক বেশী। রীতিমত সাহিত্যের সমঝদার হয়ে উঠেছিলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে বড়ো হয়েছিলেন ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে। তিনি ছিলেন একটু বন্ধুত্ব, একটু ভালোবাসার কাঙাল। সেই একাকী, নিঃসঙ্গ, কালো হরিণ চোখ মেয়েটি বাইরের বাড়ি থেকে হঠাৎ অন্তঃপুরে উপস্থিত হলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনো তাকে আগে দেখেছেন বলে জানা যায় না। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত, কাদম্বরীর থেকে এক বছর নয় মাসের ছোটো। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্নেহের প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ আর হীণমন্যতায় কাতর ও নিঃসঙ্গ কাদম্বরী দুজন দুজনের খেলার সাথী হয়ে উঠলেন। বালক রবি স্কুল থেকে ফিরেই তার ঘরে উপস্থিত হতেন। ধীরে ধীরে দুজনেই কৈশোরে পৌঁছে গেলেন। তাঁদের বন্ধুত্বের চরিত্র খানিকটা বদলে যেতে আরম্ভ করলো। সেই ভালোলাগা, ভালোবাসা নানা পর্যায়ে, নানা রূপে প্রকাশ পেয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি, সাহিত্যে ছিল কাদম্বরী দেবীর অদম্য কৌতূহল। তিনি রবির সাহিত্য সঙ্গিনীতে পরিণত হলেন। তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল কাব্যে, গানে, উপন্যাসে। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার মাপে নয়, তিনি ছিলেন সত্যিকারের সাহিত্য রসিক। সুচারু রূপে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে শিখেছিলেন আর সেই রস গ্রহণের ক্ষমতাই তিনি সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন তাঁর স্নেহের দেবরের মধ্যে। সাহিত্য, সঙ্গীত নিয়ে তাঁরা নিজেদের একটি কুঞ্জ সাজিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র একজন লেখক, পাঠকও একজনই। কাদম্বরী দেবী চাইতেন না, রবির লেখা সত্যিকারের পরিণত হওয়ার আগে প্রকাশিত হোক, অন্য কেউ তা পড়ুক। এ ছিল কেবলমাত্র তাঁদের দুজনার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা যতই পরিণত হতে শুরু করলো, ততই তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন আত্মপ্রকাশের জন্য। রবি আর একমাত্র কাদম্বরী দেবীর থাকলেন না। এটা কি রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠুরতা…!!! আর নিজের এই নিষ্ঠুরতার ক্ষত ঢাকতেই কি তিনি ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন…??
কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে। সেখানেই সময় কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় খেলার সাথী আর একমাত্র বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন কাদম্বরী দেবী। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় যুত হলো না, তাই দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন রবিকে বিলেত পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করবেন। আর তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে রবীন্দ্রনাথ আহমেদাবাদ যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে তারপর গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসাবে সেখানে তিনি থাকেন আত্মারাম পান্ডুরঙের পরিবারে। যিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে কাদম্বরী ছাড়া এই প্রথম তিনি অন্য কোন নারীর সান্নিধ্যে এলেন। ইংরেজি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজদের সংস্কৃতি ও তাদের আদবকায়দা শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পান্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন, তিনজনে কেবল বিলাত ভ্রমণই করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটোটির নাম আনা তরখড়। তার ওপরেই দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইংরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু’বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার দেরী হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইংরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরং কবিতা লিখে, গান রচনা করে আনাকে “নলিনী” নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশী আগ্রহ দেখালেন। মুগ্ধ করলেন, এবং তাঁর নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথী এবং এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী পরস্পরের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছিলেন। একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নব নব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছিল। আনার সাথে সেরকমের কোন ঘনিষ্ঠতা রবির হল না। তবে ‘নলিনী’ যে তাঁর হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সেকথা তিনি শুধু মাত্র তাঁর গান আর নাটকের ভাষাতেই নয়…… বন্ধুদের কাছেও পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক আনুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্যটিপ্রসাদ আর অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তাঁর সম্পর্ক কিভাবে কতটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [০১.০১.১৯২৭]…..
“আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই না ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে। এ কথা আমি মানব যে, আমি টের পেতাম ঘটবার মত একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু হায় রে, সে হওয়াটাকে উসকে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোন রকম তৎপরতা, না কোন প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। …. একদিন সন্ধ্যাবেলা,…. সে আচমকা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত…. চারিদিকে সে যে কি অপরূপ আলো হাওয়া…!! কিন্তু আমি কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছু।….. সে বলে বসলো আহা কি ভাবো আকাশপাতাল…?? তার ধরণধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্ন করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ার খাটের ওপরেই এসে বসল। ….. আচ্ছা আমার হাত ধরে টানো তো, টাগ অব ওয়ারে দেখি যে জেতে…!! শেষে একদিন বলল তেমনি আচমকা : জানো কোন মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার…?? বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সে চাইলো তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করেনি।”
[প্রশান্ত পালের ‘রবিজীবনী’ দ্বিতীয় খন্ডে উদ্ধৃত]
এ থেকেই বোঝা যায়, ভালোবাসাকে দৈহিক করে তোলার মত স্থূল রুচি তাঁর গড়ে ওঠেনি। তাঁর বউদিকে তিনি তেমন করে ভালোবাসতেন বলেই মনে হয়। সাত বছর বয়স থেকেই কাদম্বরী দেবী ছিলেন তাঁর খেলার সাথী, সখী, বন্ধু।
আনার সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়েছিল, পল্লবিত হয়নি। কিন্তু আনা অথবা রবীন্দ্রনাথ কেউই ‘নলিনী’ নাম কখনো ভোলেননি। “নলিনী” নামে তিনি গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মনে রেখেছেন। এ তো প্রেমই…!! আনাও যে তাঁকে ভালোবেসেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবারের কাছে তিনি বিয়ের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিলেত চলে যান। এরপর তাঁদের দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়েছিল কিনা, সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় নি।
©️শঙ্খচিল
ক্রমশঃ