কবিকথা ও প্রেম (পর্ব- ৪)

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
4.5 রেটিং
1519 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 2 , গড়ে : 4.5]

পাঠকদের পছন্দ

নতুন প্রেম দানা বাঁধছিলো। স্থান বদলে যাওয়ার পরেও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে অন্তত পরবর্তী দু’বছর। এবং এই সময় কাদম্বরী – রবীন্দ্র প্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিল।

পরের বছর পুজোর সময় দু’জন মিলে দার্জিলিঙ বেড়াতে যান। শুধু দু’জন নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথও তাঁদের সাথে ছিলেন, সেকথা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রেমের উচ্ছ্বাস পূর্ণ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি লেখেন –

“সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।”

এ লেখা প্রকাশিত হবার পর দেবেন্দ্রনাথ সহ গোটা ঠাকুর পরিবার সচকিত হয়ে উঠল। এর মাস ছয়েকের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন একটি নিরক্ষর গ্রাম্য মেয়েকে দক্ষিণডিহি থেকে (এখনকার খুলনার কাছে)। যাকে বিয়ে করলেন, তার নাম ভবতারিণী। কেউ কেউ দাবী করেছেন যে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, দক্ষিণডিহির ধারেকাছে কোন প্রাইমারী স্কুল ছিল না। সুতরাং তিনি স্কুলে যাননি অথবা কোন পরীক্ষায় অংশ নেননি।

নিরক্ষর ছিলেন কিনা, সেটা নিয়ে বিতর্ক করলে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হবার যোগ্য ছিলেন না, এ বিষয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ ছিল না। তা সত্ত্বেও আধুনিকা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নেতৃত্ব দিয়ে এই কন্যাকেই পছন্দ করে আনেন। কাদম্বরীকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করতেন। সেই কাদম্বরী-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের ওপর শোধ নেবার জন্যেই হয়তো তিনি ভবতারিণীকে বেছে নিয়ে এসেছিলেন। আর কাদম্বরীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মেয়ে পছন্দ করার কাজেও তাকে সঙ্গে নিয়ে যান। মানে এর থেকে বোঝা যায় যে, সিরিয়ালের নাটকীয়তা রবীন্দ্রনাথের জীবনেও কম ছিল না।

বিয়ের পর ভবতারিণীকে একটা আধুনিক নাম দেওয়া হলো মৃণালিনী দেবী। তাছাড়া তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে তরুণ কবি, গায়ক এবং অত্যন্ত সুদর্শন ‘রবীন্দ্রনাথের’ উপযুক্ত করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে মেয়েমহলে। বিয়ের পরের মাসে হিসাবের খাতায় বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, শ্লেট ইত্যাদি কেনার তথ্য উল্লেখ করেছেন প্রশান্ত পাল।

ওদিকে কাদম্বরী দেবী আরো একবার নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে করলেন। বিষন্ন হলেন, যাকে এখন বলা হয় ডিপ্রেসড….!! তা সত্ত্বেও নিজেকে জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পরের সাড়ে চার মাস। এরপর ৮ই বৈশাখ তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মারা যান পরের দিন রাতে অথবা তার পরের দিন সকালে। চিকিৎসাও করানো হয়। কিন্তু সেটা সম্ভবত কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য।

কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন। কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা বেঁচে রইলো যতদিন তিনি নিজে বেঁচেছিলেন। কত গান, কত কবিতায় তাঁর এই ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে আজ একশত আটান্ন বছর পরেও কাদম্বরী দেবী আজও অমর হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাঁদের রোমান্টিক প্রেমের ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর তাঁর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন তাঁর বউদি। বউদির অভাবে তাঁর হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠল। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে পারলেন না। বস্তুতঃ মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর এ সময় কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, বন্ধু এবং সাহিত্য-সঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তিনি একদা নির্মলকুমারী মহালানবিশকে বলেও ফেলেছিলেন, “বউদিটির আত্মহননের জন্যেই আজো তাকে নিয়ে এতো কবিতা আর গান লিখে ফেলেছি, তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে মামলা করতুম।”

মৃত্যুর আগের বছর রবীন্দ্রনাথ মংপুতে বসে রচনা করেছিলেন “ছেলেবেলা”। সেখানেও তিনি লিখেছিলেন, “বউঠাকরুণ রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে তিনি আমাকে হাজির পেতেন। ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তাঁর আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সাথে পান্তাভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না। মাঝে মাঝে যেদিন আত্মীয় বাড়িতে যেতেন, ঘরের সামনে তাঁর চটিজুতো জোড়া দেখতে পেতুম না, তখন রাগ করে ঘরের থেকে একটা কোন দামী জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার পত্তন করতুম। বলতে হত, ‘তুমি গেলে তোমার ঘর সামলাবে কে?? আমি কি চৌকিদার…??’ তিনি রাগ দেখিয়ে বলতেন – ‘তোমাকে আর ঘর সামলাতে হবে না, তুমি তোমার হাত সামলিয়ো।’ “

©️শঙ্খচিল

ক্রমশঃ

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল