আজ তাঁর জন্মদিন। যিনি দেশমাতৃকার রক্ষাকল্পে নিয়োজিত এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। যিনি দেশের জন্য প্রথমে কলেজ ছেড়েছেন,তারপর লোভনীয় চাকরী ছেড়েছেন, সুখি জীবনের স্বপ্ন ছেড়েছেন,কংগ্রেস সভাপতির গৌরবময় পদ ছেড়েছেন, নিজ গৃহ ছেড়েছেন, এবং দেশের মুক্তির জন্য নিজের দেশও ছেড়েছেন। সব শেষে সব ঠিকানা ছাড়িয়ে হারিয়ে গেছেন নক্ষত্রলোকের কোন অজানা ঠিকানায়।
আজ তাঁর জন্মদিন, যিনি বিশ্বাস করতেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে। যারা অন্যের দেশ দখল করে, শোষণ করে নিয়ে যায় সবকিছু,তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়,কোন মানবিকতা নয় দরকার পাল্টা মার,আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বড় বড় নেতারা যখন গোলটেবিলে বসছেন, দাবিপত্র পেশ করছেন, শুভবুদ্ধি জাগ্রত হবার আশা করছেন। তখন তিনি বুকের পাঁজরে জ্বালিয়ে নিচ্ছেন প্রতিশোধের আগুন। যারা দেশকে শোষণ করছে,ক্ষুদিরাম ভগত সিং থেকে সূর্য সেনদের চরম অত্যাচারে জর্জরিত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে,রক্তে রাঙিয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি তাদের লাথি মেরে তাড়াতে হবে। দুর্বলচিত্ত অনুগ্রহপ্রিয় নেতারা তাঁর ভাবনায় বিশ্বাস করা দূরের কথা, তার মতো করে ভাবতেও ভয় পেয়েছেন। তাইতো তিনি ব্রাত্য। তাই তিনি বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলেছেন, কিন্তু আপস করেন নি কখনো।
আজ তাঁর জন্মদিন। জাতীয় নেতারা যখন ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছেন, তিনি তখন সুদূর জার্মানিতে সংগ্রহ করছেন যুদ্ধের রসদ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে পাড়ি দিচ্ছেন সাবমেরিনে। গড়ে তুলছেন দেশরক্ষার সংকল্পে অটল এক সেনাদল। যারা ছিনিয়ে আনবে স্বাধীনতার স্বপ্ন। তাইতো তিনি নেতাজি।
আজ তাঁর জন্মদিন। যার হাত ধরে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম জাতীয় সরকার। আজাদ হিন্দ সরকার। ১৯৪৩ সালের এই সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। ইতিহাস লেখেনা সে কথা। তিনিই ছিলেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর হাত ধরেই ভারতের মনিপুর সীমান্তের মানুষ পেয়েছিলেন ব্রিটিশমুক্ত ভারতের স্বাদ। তাঁর হাত ধরেই ভারতের বুকে প্রথম উড়েছিল ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা, আপন বিজয়গৌরবে।
আজ তাঁর জন্মদিন। যিনি দেশের জন্য সর্বস্ব দিয়েও নিঃস্ব। তাঁর লড়াইতে ঠকঠক করে কেঁপেছ ব্রিটিশ সিংহ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ভারতের স্বাধীনতার একমাত্র কারণ হিসাবে নিয়েছেন তাঁর নাম। আর ভারতীয় নেতারা ক্রমাগত বিরোধিতা করে গেছেন তাঁর সংগ্রামী অভিযানের।তাঁকে সমর্থন দূরের কথা, তাঁর বিরোধিতায় সরব হয়েছেন অনেক মহামানব। প্রথম প্রধানমন্ত্রী করার প্রতিদানে নেহেরু তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন যুদ্ধাপরাধী হিসাবে, সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর ছবি সরিয়ে ফেলার নির্দেশিকা জারী হয়েছে।স্বাধীনতার দিন একবারও ভুলেও উচ্চারিত হয়নি তাঁর নাম। তাঁর পরিবারের ওপর দীর্ঘদিন গোপন নজরদারি চালানো হয়েছে। তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের সঠিক তদন্ত করার হিম্মত দেখায়নি কোনও সরকার। এই প্রতিদানই বোধয় প্রাপ্য ছিল তাঁর।
আমরা, আমরা কী দিয়েছি তাঁকে? তাঁকে নিয়ে রাজনীতি করেছি, প্রচার করেছি, সিনেমা করেছি, সিরিয়াল করেছি, আলোচনা করেছি, কিন্তু তাঁর সাধনা করিনি, তাঁকে আদর্শ করিনি। তাইতো তাঁর আপোষহীন মানসিকতাকে সরিয়ে রেখে আপোষ করেছি অন্যায়ের সাথে। মেনে নিয়েছি সব দুর্নীতি, দলীয় আনুগত্যে গলা ফাটিয়েছি দুর্নীতিবাজদের পক্ষে। হায়রে নেতাজি, সত্যিই তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন, হেরে যাচ্ছেন, রোজ, প্রতিদিন।
কিন্তু সবের পরেও তিনি নেতাজি। তিনি মহামানব নন, তিনি এক জাতীয় আবেগ, স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত সূর্য। তাইতো ইতিহাসও অক্ষম তাঁর পরিনতির কথা বলতে। তাঁর মৃত্যু নেই, তাঁর শেষ নেই। যতদিন স্বাধীন ভারত থাকবে, দেশপ্রেম থাকবে, তিনি থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। স্বাধীনতার পর অনেকেই হয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রী, কেউবা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাজা হওয়া হয়নি কারোর। কারন রাজা একজনই। আমাদের হৃদয়ের রাজা। সুভাষচন্দ্র বোস। আজ সেই রাজার জন্মদিন।
মহারাজা আপনাকে প্রণাম। জয়হিন্দ।
চিত্র সৌজন্য : গুগল , ফেসবুক