ইনক্লুশনের ভাবনা ঃ জনগণমন

অশোক ভট্টাচার্য
5 রেটিং
2046 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 3 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

সমকালের হাতে সমকালের সঠিক বিচার কোনোকালেই বোধহয় হয় না; সমকালের চোখে যা উপলক্ষ সেটা আবার কালের বিচারে নস্যাৎ হয়ে যায়,ধরা পড়ে অন্য কোনো অভিপ্রায়ের সারণী। আমাদের জাতীয় সংগীত সম্পর্কেও এই কথা ভীষণ রকম সত্য।

  ১৯১১।  ২৬-২৮ ডিসেম্বর চলছিলো কংগ্রেস অধিবেশন। যার দ্বিতীয় দিনে শুভ সূচনায় গীত হলো ‘জনগণমন অধিনায়ক..’। কিছুদিন পরে কোলকাতার আদি ব্রাহ্মসমাজে মাঘোৎসবে গীত হয় সেই গান। গানটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দ ( ইং ১৯১২) মাঘ মাসের ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় ব্রহ্মসংগীতের আখ্যায় প্রকাশ পয় ‘ ভারতবিধাতা’ শিরোনামে। কংগ্রেস অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ  ২৮ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে আবার এই গান গাওয়া হলে, তা শুনে দেশবন্ধু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠেন–” It is a song of the glory and victory of India.” অনেকপরে জার্মানিতে গড়ে ওঠা ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’তে সুভাষচন্দ্র এ গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিলেন।

 রাগ ইমন কল্যাণ। ‘সা’ থেকে    ‘সার্’…সপ্তকের বুনোট মিশ্রণে এ গান। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন একদা, ” গানের কাগজে রাগ রাগিণীর নাম নির্দেশ না থাকাই ভালো। নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে,রূপের মধ্যে না।…নামের সত্যতা দশের মুখে, সেই দশের মধ্যে মতের মিল না থাকতে পারে। কলিযুগে শুনেছি,নামেই মুক্তি। কিন্তু গান চিরকালই সত্য যুগে।”

সত্যি অবাক ব্যাপার। ‘জনগণমন..” গানটি  শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন না যে, এটা বাংলা গান! সুরেরও কোনো ঠিকানা ঠাওর করা যাবে না নির্দিষ্টভাবে। ‘পূর্ব পশ্চিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ” যাহা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যাহা সকলের চেয়ে পূর্ণ, যাহা চরম সত্য, তাহা সকলকে লইয়া..”। এই যে সর্বব্যাপী এক ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা অন্তর্ভুক্তির ধারণা তা রবীন্দ্রদর্শনের মূল সুর,যে সুর বেজে ওঠে ‘ জনগণমন অধিনায়ক.. ” গানে। আবহমান অখণ্ড ভারতের যে রূপ,তা ই রূপ পেল রবীন্দ্রনাথের রচিত গানে।যে গান ভারতের জাতীয় সংগীত তাকে তো সকল খন্ডতার উর্ধে উঠতেই হবে, এবং তা হলোও। সেই কারণে এ গানে বর্ণিত পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত, মারাঠা, উৎকল কিম্বা বঙ্গ শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক এলাকা বা সীমারেখা দ্যোতিত করে তা নয়। ধরা যাক ‘সিন্ধু’, তা অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ কে চিহ্নিত করার পাশাপাশি হয়ত  বহু শতাব্দী আগের গৌরবময় সভ্যতার আলোকশিখাকে আরো একবার উঁচুতে তুলে ধরে..কিম্বা ‘বঙ্গ’ হয়ত অতীশ দীপঙ্করের আলোর সন্ধানের যাত্রা শুরুর উৎস কেন্দ্রকেই দ্যোতিত করে। এগুলো আসলে ওই ‘ সকলকে লইয়া’ চলারই এক উদার ভাবনা,এক চিরশাশ্বত জীবন সত্য। সে ভাবনা ‘ বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি’।

এই গানেরই আর একটা স্তবক যেটি আমাদের জাতীয় সংগীতের অংশ নয় সেটিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ কোরেছেন–হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন,পারসিক,মুসলমান, খ্রিস্টান–এইসব সম্প্রদায়ের কথা যারা ‘ পূরব পশ্চিম’ থেকে আসে এবং গ্রথিত করে ‘ প্রেমহার’। অথচ এই প্রেমহারের সবকটি ফুলই নিজ নিজ বর্ণ গন্ধ নিয়েই মালায় থাকে; আবার আলাদা আলাদা থেকেও একটা গোটা মালার ছবির জন্ম দ্যায়। এটাই তো আমার ভারত,যুগ যুগের ভারত। যে কিছুই ত্যাগ করে না,গ্রহণ করে আপন করে সবটা ঃ

” দিবে আর নিবে,মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে।”এ হলো সেই অন্তর্ভুক্তির ধারণা।

  একবার রবীন্দ্রনাথ সখেদে বলেছিলেন, ” দেশের মানুষ তাঁকে যত কষ্ট দিয়েছে, নেহাত বিধাতার কৃপায় মজবুত শরীর নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই তিনি সে সব সহ্য করতে পেরেছেন।” জাতীয় সংগীত নিয়ে যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে এখনো ক্ষত- বিক্ষত হতে হয়,  সে প্রসঙ্গে এ কথা বলাই যায়। পঞ্চম জর্জের বন্দনা করে নাকি এ গানের জন্ম! একথা ঠিক সম্রাট বন্দনার অনুরোধের পরই এ গান লেখা, কিন্তু গীতিকারের উদ্দেশ্য কখনোই তা ছিলোনা। অনেক পরে ‘ বিচিত্রা ‘ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন–“পতন -অভ্যুদয়- বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিতা যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, তিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্য রথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জ কোনোক্রমেই হতে পারেন না…।”

  ইদানিং শুনছি, দেখছিও জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিয়ে ফতোয়া জারি চলছে। কিন্তু চোখ রাঙিয়ে জাতীয় সংগীতকে ভালোবাসা যায় কী? তাকে মরমে নিতে হবে। তার বড় অভাব আজ। বর্তমান ভারতের সমস্যাগুলির অনেকগুলিই হলো ‘এক্সক্লুশন’ -এর ভাবনার বিষ। পাশের মানুষটাকে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমেত নিজের করে নিতে আজ পারছি কই? নিজ নিজ সংস্কৃতি,আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্মিতা দিয়ে গ্রাস করার চেষ্টা হচ্ছে অন্যকে। বহুত্ববাদের যে মূল সুরকে ‘জনগণমন অধিনয়ক…’ বীণার তারে বাঁধার কথা শেখায়,তাকে নস্যাৎ করে একটিই ভাবনা,একটিই রং, একটিই মত কে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী মনোভাব আজ আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে।

হে কালদর্শী, তুমি আবার আমাদের শোনাও ‘ জনগণমন অধিনায়ক.. ‘…বহুত্ববাদের রামধনুতে নিজেদের সাজিয়ে জাতীয় সংগীতের বিচিত্র রং বাহারের সুর কে যেন আমরা মর্মে লাগাতে পারি…সেই শক্তি দাও।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল