পর্ব-২:-#দোতলা_বা_আড়াইতলা_বাস
বাঙালির ঐতিহ্য আর শহুরে ভালোবাসায় আজও নস্ট্যালজিয়া।আসলে শহরটা আগা গোড়াই একটু নস্ট্যালজিক।তাই রাস্তায় গোছিয়ে ওঠা ক্যাফে ছেড়ে আজও সাবেক বাঙালির মন পাড়ার চায়ের দোকান।শহরটা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।আর সাক্ষী শহুরে রাস্তার বুক চিরে চলা এই দোতলা বা আড়াইতলা বাস।শহরের রাস্তা বরাবর ঐ বাস শহুরে গল্প,শহুরে প্রেম,শহুরে বিচ্ছেদ সবকিছুতে সামিল।নিরব সাক্ষ্য প্রমাণের উপাসক হিসাবে…তারা জানে ঠিক ভোরবেলা ময়দান কি ভাবে রৌদ্রের আদর মাখে।তারা জানে কি ভাবে এগিয়ে চলেছে আমার আপনার সকলের শহর কোলকাতা।নতুন-পুরানোর দ্বন্দ্বেও কলকাতা বুকে নিয়ে চলে তার এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে।
পোশাকি একটা নাম হয়তো ছিল।বাসটা কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত চলতো।কিন্তু বড়রা বলতেন আড়াই তলা বাস।কলকাতার রাজপথ থেকে আজ বিলুপ্ত।ছোটবেলায় দেখেছি এই বাস গুলোকে রাস্তায় চলতে।এ হেন নামকরণের কারণ,বাসগুলোর একতলার সামনের দিকের কিছুটা অংশ একতলার থেকে উঁচু। অনেকটা বাড়ির ম্যাজানাইন ফ্লোরের মতো। বর্তমানে কলকাতার রাস্তায় যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভলভো বাসগুলো চলে, সেই বাসগুলোর পিছনের অংশটা খানিকটা উঁচু থাকে। ওই আড়াই তলার বাসগুলোর একতলার সামনের অংশের উচ্চতা এর চাইতে অনেকটাই বেশি থাকত। এই বাসগুলোর ইঞ্জিন বাসের মধ্যে থাকত না। ওই বাসগুলোর সঙ্গে জোড়া ট্র্যাক্টর ট্রেলর বাসগুলোকে টেনে নিয়ে যেত।
এল নাইন রুটে গোলপার্ক থেকে ডানলপ পর্যন্ত চলত সেই আড়াই তলা বাস। এ ছাড়া, সেই সময় গোলপার্ক থেকে ডানলপ অবধি আরও একটি বাস চলত – দরজা লাগানো এস-৯। আড়াই তলা বাসটি যেত সেন্ট্রাল এভিনিউ হয়ে এবং এস-৯ যেত শিয়ালদহ হয়ে। এই দুটি বাসের জন্য গোলপার্ক-সাদার্ন এভিনিউ ক্রসিংয়ে (রামকৃষ্ণ মিশনের উল্টোদিকে) একটি বাস শেডও করা হয়েছিল। সেই বাস শেড আজও আছে। এস-৯ রুটের বাস এখন যাদবপুর থেকে করুণাময়ী (সল্টলেক) অবধি চলে। কিন্তু চিরকালের জন্য ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে সেই আড়াইতলা বাসগুলো।
আর, এই বাসগুলোর দোতলার একবারে সামনের আসনটিতে বসলে নিজেকে যেন রাজা মনে হত। সামান্য উচ্চতা থেকে আমার প্রিয় মহানগরীকে পর্যবেক্ষণ করা – এর স্বাদটাই যেন অন্যরকম ছিল। সত্যি সত্যিই নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য। বাঁদিকের সামনের আসনে বসলে একটি সমস্যাও ছিল। পথ চলতে যদি কোনও গাছের সঙ্গে ঘষাঘষি লাগত তাহলে জানলা দিয়ে গলে সেই গাছের পাতা আপনার গায়ে পড়তে বাধ্য। তবে, সব মিলিয়ে সে ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
শুধু আড়াইতলা নয়, একটা সময় মহানগরীর মুখ্য আকর্ষণ ছিল দোতলা বাস। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালে ব্রিটিশরা কলকাতায় চালু করেছিল এই ডাবল ডেকার বাস। প্রায় আট দশক ধরে এই বাসগুলো রাজত্ব করেছে মহানগরীর বুকে। অবশেষে ২০০৫ সালে শহরের শেষ দোতলা বাসটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিএসটিসি। বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে যে দোতলা বাসগুলো চলে তার সিংহভাগই এই শহরের বাতিল বাস।
নতুনের মাঝে পুরাতনগুলোকে ভুলতে চাইছে না এই শহর।তাই বোধহয় এই দোতলা বাস ফের চালু করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। পরিবহণ দপ্তর মূলত পর্যটনের কথা ভেবে এই বাস চালু করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আপাতত পর্যটনের জন্যেই চার-পাঁচটি দোতলা বাস চালু করা হবে। পর্যটকদের এই বাসে করে কলকাতার বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এই বাস চালানো হবে। নিঃসন্দেহে, অনবদ্য উদ্যোগ।
কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।অবশ্যই সেগুলো ভেবে দেখলে যুক্তিসঙ্গত-
॰ কলকাতার মতো শহরে যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময় প্রচন্ড গরম থাকে তার উপর মাস দুয়েক বর্ষা থাকে সেখানে এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তব সম্মত হবে। শুধুমাত্র শীতকালীন পর্যটকদের কথা ভেবে এই বাস নামাতে গেলে অহেতুক ঝুঁকি হয়ে যাবে না তো?
॰ এই বাসগুলো শ্লথ গতিতে চলে, অনেকখানি জায়গা দখল করে থাকে এবং বাঁক নিতে অনেকটা বেশি জায়গা লাগে। পর্যটনের জন্য ব্যবহার করতে গেলে এই বাস নিয়ে উত্তর ও মধ্যে কলকাতায় যেতেই হবে যেখানে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থানগুলো রয়েছে। কর্মব্যস্ত সময় সেই জায়গাগুলোতে এই বাস নিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তি সম্মত হবে?
॰ তার উপর শহর জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ব্রিজ আর নতুন নতুন ফ্লাইওভার জনিত সমস্যা।
কিন্তু যাদের কখনো চড়া হয়নি,কিংবা কলকাতার নস্ট্যালজিয়ার সাথে যে আধুনিক প্রজন্মের এখনও পরিচিত নেই তাদের কথা ভেবেই আশা করি এই উদ্যোগ সফল হবে এবং আবার দোতলা বাসে চড়ে পুরোনো সেই দিনে ফেরা……
©️শঙ্খচিল
তথ্যসূত্র:-ব্যক্তিগত,গুগল
(ক্রমশঃ)