আমেরিকার অন্যতম বড় পুজো হয় আটলান্টা শহরে – জনপ্রতি 100 ডলারে লোপামুদ্রা সহ বিভিন্ন শিল্পীর শো দেখার সুযোগ থাকে সেখানে
শরতের শুভ লগ্নে চিন্ময়ী রূপী দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে নেমে এসে আমাদের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা ও অশান্তি দূর করে এ পৃথিবীতে শান্তির আলো বর্ষণ করেন। দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বের সমস্ত শান্তি ও চির মঙ্গল কামনা করতে আমরা মিলিত হই দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে । বিভীষিকাময় এই বিশ্বে দেবী দুর্গার আগমন হয়ে উঠুক শান্তি, কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধিময়। প্রবাসী বাঙালিরা মনের মনিকোঠায় লালন করে আসছে বাঙালীর আবেগমাখা শারদীয়া দুর্গোৎসব।আমরা যারা আমেরিকায় থাকি তারা সবসময় দুর্গাপুজোতে দেশে যেতে পারি না। আমাদের কাছে দুর্গাপুজোতে দেশে যাওয়া ওই ‘হাতে চাঁদ’ পাওয়ার মতোই দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য।অনেক বাঙালি এদেশে আছেন বহু বছর ধরে যাঁদের কাশফুল আর ঢাকের স্মৃতি আর তাড়া করে না। আবার অনেকে আছেন যাদের মনে এখনো বাঙালিয়ানা পূর্ণ মাত্রায় ভরপুর,তাদের কাছে দুর্গাপুজোর আবেগ এখনো অটুট ভাবে বন্টিত । প্রবাসে পুজো নিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা প্রত্যেকেরই আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হলো কাজের ব্যস্ততার কারণে তিথী-নক্ষত্র ধরে অনেক সময়ই পুজো না হওয়া। আর তাই, যারা নিয়মিত ইন্টারনেট অনুসরণ করেন, তারা জানেন যে উত্তর আমেরিকার কোনো কোনো শহরে ঢাকা বা কলকাতায় পুজো শুরুর আগেই বিদেশে পুজো শেষই হয়ে গেছে।
আমার জীবনের প্রথম পঁচিশটা বছর কেটেছে ভারতে। স্কুল পেরিয়ে এক দিন নিজের শহর থেকে পৌঁছে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে। সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে অবাধ স্বাধীনতার এক স্বপ্নের জগতে। সেখানে ব্রহ্মবাদের জায়গায় তেমন দুর্গাপুজো হয়না। তবে আমার পুজোর সময় গুলোতে বেশিরভাগই নিজের বাড়িতেই থাকা হতো। আমাদের সাহা বাড়ির পুজোই ছিল আমাদের একমাত্র আনন্দের বিষয়। সেই সময়ের দুর্গাপুজোর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে আমার শহরে । পুজোর আগে প্রকৃতির রূপ উপলব্ধি করতে পারতাম প্রকৃতির সবুজ পরিবেশে। বর্ষা শেষের রাস্তা ধরে স্কুলে যেতে যেতে শরতের সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম কবে দুর্গাপুজো আসবে! তার পর জীবনে-আবর্তে কালক্রমে এক দিন চলে এলাম আমেরিকায়।
শরৎকাল মানে হিমেল হাওয়ার পরশ আর ভোরবেলা শিউলি ফুলের স্নিগ্ধতা। আকাশে সাদা তুলোর মতোন মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো। আমেরিকায় এসব কিছুই তেমন অনুভব অনুভব হয়না। এখানে পুজোতে দেশের মতো কারো ছুটি থাকে না। এখানে দুর্গাপুজো ব্যাপারটা আসলে কি,আমেরিকানরা প্রায় কেউ জানেই না। আমেরিকার ছোট ছোট শহর, উপশহরে যেসব বাঙালি থাকে, যেমন সাউথ ক্যারোলিনা, নিউ মেক্সিকো, ওআয়ওমিং,আইহোয়া,আলাবামা বা মিসিসিপির মতো জায়গায়, তারা অনেক সময়ে দুর্গাপুজোতে কিছুই করতে পারে না। অনেক সময়ে পুজোর চারদিন কিভাবে কেটে যায় বোঝা যায়না, শুধু কল্পনায় ভেবে যায় আজ সপ্তমী, কাল অষ্টমী, তার পর নবমী, তার পর বিজয়া। আজ ভাসান হচ্ছে। ধরা যাক পুজোর দিন আমেরিকায় নিউ ইয়র্কের কোনো শহর বাফেলো বা কুইন্স নয়তো আলবানিতে সকাল এগারোটা এমন সময় অনেকে অফিসে বসে কাজ করছে । হয়তো কেউ কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে কিংবা গবেষণার কাজ করছে। হয়তো দোকানে কেউ কাজ করছে।
যাক সে সব কথা। কল্পনার কথায় আসা যাক একটু। কারণ, ইমাজিনেশনই আর্টের মাতৃস্বরূপা। হয়তো পুজোর কোনো সন্ধ্যায় বিদেশে বসে আমরা ভাবছি, এখন কলকাতায় সন্ধেবেলা। রাত আটটা। দশমীর রাত। এখন ঠাকুর ভাসান শুরু হচ্ছে। দেশপ্রিয়পার্কের জনসমুদ্র, হেদোর মোড়ে জনারণ্য। হাজার হাজার লোক— ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি, বাচ্চা ভীড় জমিয়েছে ঠাকুর ভাসানের প্রসেসন দেখবে বলে। একটার পর একটা ঠাকুর লরির ওপর চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব গঙ্গায় নিমতলা ঘাটের দিকে। উত্তর কলকাতার, মধ্য কলকাতার সব বিখ্যাত ঠাকুর— সাহিত্য পরিষদ, কারবালা ট্যাংক লেন, গোয়াবাগান, বিডন স্ট্রিট, কুমোরটুলি, গিরিশ পার্ক, মোহাম্মদ আলি পার্ক, হাতিবাগান সার্বজনীন, — সব ঠাকুর একে একে আসছে। দূর থেকে তাদের ব্যান্ড, তাদের ঢাক, তাদের আলো, তাদের আলোর গেট। সে কী রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! খুব হই হই ব্যাপার চারিদিকে।
এমন সময় আমরা পৃথিবীর ঠিক বিপরীত দিকে বসে কল্পনা করি শুধু। আমরা যেতে পারি না বছরের পর বছর। আমার বেশ কিছু বছরের আমেরিকার জীবনে আমি মাত্র একবারও পুজোর সময়ে দেশে যেতে পারিনি। প্রথম যখন আমেরিকায় এসেছিলাম আটলান্টা শহরে,। তখন আটলান্টার সবথেকে বড় দুর্গাপুজো যেখানে হয় সেটা আমরা দেখতে গেলাম। শুনলাম সেখানে সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র আসছে ভারত থেকে। দুর্গাপুজো হচ্ছে লরেন্সভিলের একটি এলিমেন্টারি স্কুলে। এই দুর্গাপুজো উৎসব এবং লোপামুদ্রার গানের অনুষ্ঠান সবমিলিয়ে জনপ্রতি 100 ডলার করে আটলান্টার দুর্গাপুজো
টিকিট ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলাম এ এক অন্য দুর্গাপুজো, যদিও দেবীর প্রতিমা বেশ বড় এবং সুকাঠামো সমন্বিত। আমরা পুজোমণ্ডপে প্রবেশ মাত্রই দেখলাম হলঘরের দুই ধারে সারিবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন হস্তশিল্প এবং বাঙালির ঐতিহ্য সম্পর্কিত নানান জিনিসের স্টল হয়েছে। বেশ কিছু খাবারের স্টল দেখলাম যেমন ফুচকা রসগোল্লা ঝালমুড়ি আলুকাবলি বিভিন্ন বাঙালি খাবারের কেন্দ্র। সব কিছু বাঙালিয়ানায় ভরপুর। বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা কুইজ কম্পিটিশন গান নাচের প্রতিযোগিতা ছিল আকর্ষণীয় বিষয়। পুজোর মন্ডপে পুরোহিত পুজো করছে চারিদিকে ঢাকের কাঠির আওয়াজ।এখানে আলাদা করে ঢাক বাজানোর লোক পাওয়া যায় না ফলে নিজেরাই পালাবদল করে ঢাক বাজায়। এসেছে অনেক কলেজ ছাত্র ছাত্রী অধ্যাপক অধ্যাপিকা আইটি চাকরিরত সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উপস্থিত হয়েছে। দুই বাংলার মানুষের ভিড়ে মেতে উঠেছে আটলান্টার সবথেকে বড় দুর্গাপুজোয় । এই দুর্গাপুজো অরগানাইজ করে ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেটার’ আটলান্টা সংক্ষেপে ওরা বলে ‘বাঘা’। আটলান্টা শহরে আরো কিছু গ্রূপ আছে যারা দুর্গাপুজো করে তার মধ্যে ‘বাঘা’ এবং ‘পূর্বাশা’ হল অন্যতম। স্কুল রুমের গোটা অডিটরিয়ামটি সেদিন বাঙালি মানুষে ভরে উঠেছিল কারণ দুর্গাপুজো হলো বাঙালির আবেগ তাই এই দুর্গাপুজোর সময় কোন বাঙালি ঘরে বসে থাকতে পারে না। আটলান্টা বেশ বড় শহর,এখানে অনেক বাঙালি আছে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মিলিয়ে আটলান্টা শহরের বাঙালির সংখ্যা অগণিত। আমরা সারাদিন পুজো মণ্ডপে কাটালাম। দেবীর আরতি দর্শন করে ধুনুচি নাচ দেখলাম। তারপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার পর আমরা বিশ্রাম নেয়ার জন্য আবার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেলাম।
আমার লোপামুদ্রার গানের অনুষ্ঠান দেখার খুবই আগ্রহ ছিল তাই সারাদিন পুজোর অনুষ্ঠান উপভোগ করার পর আমরা সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে সন্ধ্যাবেলায় আবার গেলাম। আমাদের টিকিট আগাম কাটা ছিল। অনুষ্ঠানের কিছু সময় আগে আমরা সেখানে পৌঁছে যায়। দেখলাম গ্রিন রুমে লোপাদি প্র্যাক্টিস করছে,সোজা চলে গেলাম দেখা করতে।গল্পের পর কিছু ফটো তুললাম লোপাদির সাথে,কথা প্রসঙ্গে সেখানে জানতে পারলাম হাসবেন্ড যখন আই আই টি তে পড়তো সেখানে একবার লোপাদি গিয়েছিলো প্রোগ্রাম করতে। লোপাদির সাথে এসব কিছুক্ষণ আলোচনার পর নিজ সিটে এসে বসলাম। লোপামিত্র মিত্র আটলান্টার দুর্গাপুজোতে
তারপর প্রায় দু’ঘণ্টা চলল সেই গানের অনুষ্ঠান। খুব চেনা পরিচিত গানগুলো করলো লোপামুদ্রা। এইভাবে বাংলা গানের মোহনায় একটি সম্পূর্ণ বাঙালি পরিবেশের মধ্যে দিয়ে সেই সন্ধ্যেটা উপভোগ করলাম। এটাই ছিল আমার আমেরিকার প্রথমবার দেখা দুর্গাপুজো । এরপর বিভিন্ন রাজ্যে যেমন বোস্টন, লুইসিয়ানার নিউ অরলিন্সে, অ্যালাবামা, মিসিসিপি এইসব জায়গায় দুর্গাপুজোর সময় থাকা হয়েছে আমার। কিন্তু সেই দুর্গাপুজো কখনোই আটলান্টার মত এত বড় নয়।খুব ছোট একটি ঘরে একদম ঘরোয়া পদ্ধতিতে হয় সেই সব শহরের দুর্গাপুজো।এই কয়েক বছরে বিদেশের কিছু টুকরো টুকরো দুর্গাপুজোর অভিজ্ঞতা কিছুটা অর্জন করেছি।
আমার হাজবেন্ডের কাছে গল্প শুনেছি যখন আমার হাজবেন্ড কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত তখন সবে সবে ভারত থেকে ছাত্র হিসাবে তার প্রথম আমেরিকায় আসা। প্রথম প্রথম ছাত্র অবস্থায় কারোর নিজস্ব গাড়ি থাকে না ফলে কোথাও যাওয়া প্রয়োজন হলে কোন প্রফেসর কিংবা কোনো সিনিয়র ছাত্রদের থেকে সাহায্য নিতে হতো। এই দুর্গাপুজোর সময় গুলো ছিল ভারত থেকে আসা ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এক অন্যরকমের দুর্গাপুজো। কানসাস রাজ্যের নিকটবর্তী একটি শহর উইচিতা। সেখানে হত একটি ছোট্ট করে দুর্গাপুজো।আমেরিকার সমস্ত ছোট দুর্গাপূজা গুলোর মধ্যে এটি একটি। হাসবেন্ড এর কাছে গল্প শুনেছি তারা বন্ধুরা মিলে কখনো কোন গাড়ি ভাড়া করত কিংবা কোন প্রফেসর তাদেরকে নিয়ে গেলে তার সাথে চলে যেত সেই দুর্গাপুজো দেখতে। সেখানকার দুর্গাপুজো কমিটি থেকে অরগানাইজ করা হতো পুজোর সমস্ত অনুষ্ঠান। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন জায়গার মানুষেরা সেখানে আসতো। খাবারের ব্যবস্থা ছিল অনেকটা পটলাক পার্টির মতো। পুজো কমিটি থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হতো কে কি খাবার বানিয়ে নিয়ে আসবে। পুরোহিত হিসেবে হয়ত থাকতো ডঃব্যানার্জি বা ডঃ মুখার্জী, যিনি হয়তো অমুক স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের প্রফেসর। তিনি তাঁর লেক্সাস বা ক্যামরি গাড়ি চালিয়ে এসেছেন প্যান্ট শার্ট পরে। এখানে এসে তিনি গাড়ির পেছনে রাখা পুঁটলি থেকে ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে চুপিসাড়ে পুজো করে আবার ফিরে যাবে ৪০ মাইল দূরে বাড়ি। আর যাঁরা পুজো দেখতে আসতো , তাঁরা পাজামা পাঞ্জাবির ওপরে জ্যাকেট আর ফুলপ্যান্ট চাপিয়ে। কারণ দেশি পোশাক পরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা, বলা তো যায় না, কী থেকে কী হয়ে যায়! কোন কোন বছর তারা যেত কাছাকাছি একটি বড় শহর কানসাস সিটিতে। কানসাস সিটির দুর্গাপুজো
এই কানসাস সিটিতে যে দুর্গাপুজো টা হয় সেটা আমেরিকার বড় পুজো গুলোর মধ্যে একটা। এখানে বলিউড তারকাদের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান হয়। ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সেখানকার বাঙালিরা দুর্গাপুজোতে মেতে ওঠে। এইভাবে ছাত্রজীবনে আমার হাজবেন্ড তার দুর্গাপুজো কাটিয়েছে। পরবর্তীকালে হাসব্যান্ড চাকরি সূত্রে ডালাস এবং হিউস্টন শহরে বেশকিছু দুর্গাপুজো দেখেছে। হিউস্টন শহরের দুর্গাবাড়ির পুজো আমেরিকার মধ্যে বিখ্যাত বড়ো দুর্গাপুজোর মধ্যে একটি। একবার শুনেছিলাম ডালাসে বিখ্যাত গায়িকা মোনালি ঠাকুর, অন্বেষা এরা এসেছিল অনুষ্ঠান করতে ,জনপ্রতি 100 ডলার করে টিকিট ছিল সেখানে।এই ছিল আমার হাসব্যান্ড এর দুর্গাপুজো দেখা আমেরিকায় এরপরে আমি আসার পর থেকেই সম্পূর্ণ অন্য রকম দুর্গাপুজো দেখা হয়েছে তার।
বোস্টন শহরে বেশ কিছু দিন ছিলাম হাসবেন্ডের কাজের সূত্রে । তারপর ওখানে থাকতে থাকতে নতুন নতুন অনেক বন্ধু হলো। মার্কিন বন্ধু, বাঙালি বন্ধু, ইন্ডিয়ান বন্ধু। আরো অনেক দেশের অনেক বন্ধু। সেখানে অনেক বাঙালি আছে, বেশকিছু দুর্গাপুজো হয় সেখান। বোস্টনের দুর্গাপুজো
বোস্টনের দুর্গাপুজোর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত পুজো হলো ‘বেঙ্গলিস অফ নিউ ইংল্যান্ড’ কমিটির দুর্গাপুজো । এছাড়া বোস্টন দুর্গাবাড়ি, ‘উৎসব অফ নিউ ইংল্যান্ড’, ‘প্রবাসী অফ নিউ ইংল্যান্ড’ এরকম অনেকগুলি দুর্গাপু জোর গ্রূপ আছে। সেখানে আমার এক বান্ধবীকে তার আমেরিকার প্রথম দিকের দুর্গাপুজোর অভিজ্ঞতা জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল “প্রথম এক দশক কেটেছিল জনবিরল অঞ্চলে। সেন্ট্রাল ইলিনয়, সাদার্ণ ইলিনয়, আর তারপর আপস্টেট নিউ ইয়র্ক’এর অলবানি। প্রথম দুটো জায়গায় থাকার সময় পুজো বোঝার কোনো উপায় ছিল না। আমার মনে আছে, লক্ষ্মী পুজোর রাতে আমি আমার স্টুডেন্ট এপার্টমেন্ট’এর সামনে ঝাউগাছের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম এই সময়ে কলকাতায় লোকজন কতই না হই হই করছে। দুর্গাপুজো কেটে যেত বছরের পর বছর। আমি কলকাতায় পুজোর দিনগুলোতে ফোন করে পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ শুনতাম।” এই ছিল আমার বান্ধবীর সাথে কথোপকথন। অনেকের কাছে শোনা যায় দুর্গাপুজোর টানে বাঙালিরা অনেক দূরে ড্রাইভ করেও পুজো দেখতে যেত।
আমেরিকায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের দুর্গাপুজোর কয়েকটি বেশিরভাগই সপ্তাহান্তে পালিত হয়। যেমন, সেবারে পুজোর চারদিন শেষ হয়ে যাবার পরে বোস্টনে তাদের দুই গ্রূপের একটির পুজো হয়েছিল অক্টোবরের এক সময় । আর একটা গ্রুপ বোধহয় পুজোর আগের উইকেন্ডে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নমো নমো করে পুজো সারেন উইকএন্ডে। হয়তো পুজো হয়ে গেছে আগেই দেশে। পুজোর দিন চলে গেছে দু সপ্তাহ আগেই। তখন হয়তো অলবানি বা লেক্সিংটনে বা জর্জিয়া রাজ্যের এথেন্স বা ওহায়ো রাজ্যের কলম্বাস শহরে পুজো হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের হিন্দুদের পুজো হচ্ছে পুজোর চার পাঁচদিন ধরে, নিয়ম মেনে। সেখানে হই হই, স্বতঃস্ফূর্ততা। চাঁদার জুলুম নেই। বিদেশে মা দুর্গার কাঠামো প্রতি বছর বিসর্জন হয় না।
নর্থ ক্যারোলিনার দুর্গাপুজো
প্রতিবছর একটি কাঠামো যত্ন করে রেখে দেওয়া হয় এবং প্রতিবছর সেইগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পুজো করা হয়। কারণ প্রতিবছর দেশ থেকে এত বড় পরিকাঠামো কার্গোর মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে আসা খুবই দুঃসাধ্য। তাই এখানকার বাঙালিরা একটি প্রতিমাকে যত বছর সম্ভব পুজো করে তারপর বছর দশেক পরে নতুন কোন কাঠামো আবার দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়।
আমেরিকার দুর্গাপুজো ভৌগোলিকভাবেও দুরকম — বড় শহরের দুর্গাপুজো, আর জনশূণ্যতাপূর্ন ছোট শহরের দুর্গাপুজো। আমেরিকায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হয় পশ্চিমি বাঙালি দুর্গাপুজো। এখানে ঢাক বাজে সিডিতে। বাইরে তার শব্দ যায় না। পুজোর ভাড়াকরা স্কুলবাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলে কেউ বুঝতেই পারা যাবে না, এখানে দুর্গাপুজো বলে একটা জিনিস হচ্ছে। একবার শুনেছিলাম নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে জোরে ঢাক বাজানোর অপরাধে এই গত বছরই পুলিশ এসে মাইক বন্ধ করে দিয়ে গেল। আমার এক পরিচিতির দুটো বাড়ি পিছনেই। কে নাকি রিপোর্ট করে দিয়েছে। আমেরিকায় দুর্গাপুজো অনেকই হয় এবং সেগুলির বয়সও বেশ কয়েক দশক ছাড়িয়ে গিয়েছে। এখানে বিখ্যাত হিউস্টনের দুর্গাবাড়ির পুজো, শিকাগোর পুজো, ওয়াশিংটনের পুজো, ক্যালিফোর্নিয়ার পুজো, ডালাসের পুজো, সিয়াটেল পুজো, মিশিগানের পুজো,মিনেসোটার পুজো ,এগুলো সবই আমেরিকার বড় দুর্গাপুজোর মধ্যে একটি। মিনেসোটার দুর্গাপুজো
শরতের নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘের দল ভেসে চলেছে দূর থেকে দূরান্তে। যেন লাগামছাড়া কোন আনন্দের বার্তা নিয়ে। দূরে কোথাও ঢাক বেজে ওঠে, মাথা দুলিয়ে নাচে কাশফুল, নীল আকাশে আপন মনে ভাসতে থাকে শরতে সাদা মেঘের ভেলা। প্রবাসে এ সব দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কিছু নয়। তবে আমেরিকাতে দূষণের অভাবে প্রকৃতি এখনও অনেক নির্মল, পরিবেশ এখন অনেক পরিচ্ছন্ন, তাই…সকালে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে ‘-র অনুভব হয়। আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে। পুজোর সময় আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে হাজির হতাম বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে। সেখানে আমাদের সাহাবাড়ির দুর্গাপুজো ছিল পারিবারিক পুজো । কাজের সূত্রে পরিবারের অনেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে। আমিও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছি। বিদেশে থাকাকালীন দুর্গাপুজোর অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় ঠিকই মন পড়ে থাকে সেই আমাদের সাহাবাড়ির পুজোর জন্য। আমেরিকার পুজো অনেক সাজানো গোছানো। সবটাই যেন বানানো গল্পের মতো। শরতের মতো প্রকৃতি আছে, মণ্ডপে পুজো-পুজো ভাব আছে, ধুনুচি নাচ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ঢাকের আওয়াজ সব আছে। কিন্তু, কি যেন নেই-নেই ভাব। অফিসে পুজোর ছুটি নেই, স্কুল-কলেজে পুজোবকাশ নেই,পুজোয় বেড়াতে যাওয়া নেই, প্রথম দেখায় প্রথম প্রেমের সেই মেয়েটি এরকম বিষয়ক কবিতা বা উপন্যাস নেই , আমরা এই সব নিয়ে আর ভাবি না। পুজোর ক’টা দিন নিজেদের স্বান্তনা দেই। এই তো আছে, সব আছে, আড্ডা আছে, খিচুড়িভোগ আছে, গানবাজনা আছে, শারদীয়া সাহিত্য সংখ্যা আছে, অনলাইনে পুজোসংখ্যা আছে । স্মৃতির মনিকোঠায় দেশের পুজোর গন্ধ আছে। আমাদের যেন কবিগুরুর ভাষায় ঠিক এরকম দশা… ‘তোমার পূজার ছলে আমি তোমায় ভুলে থাকি।’