দেবকীনন্দন ও যশোদানন্দন

ডঃ মনোরঞ্জন দে
5 রেটিং
2398 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর নন্দন এবং যশোদারও নন্দন । একথা শুনে অনেকেই চীৎকার করে উঠবেন । এ কি করে সম্ভব ? কৃষ্ণ মথুরায় কংসের কারাগার থেকে ব্রজে এলেন । তাই তিনি আবার কেমনকরে নন্দের পুত্র হতে পারেন? শ্রীল জীব গোস্বামী তাঁর বৈষ্ণব – তোষণী টীকায় এর একটি সুন্দর এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে নন্দ – পুত্র অসম্ভব হলেও তত্ত্বতঃ কৃষ্ণ নন্দেরও পুত্র । আসলে বসুদেব – দেবকী হলেন সাধন সিদ্ধ পিতা – মাতা । আর নন্দ – যশোদা হলেন নিত্য সিদ্ধ বাবা – মা । 

১. বসুদেব-দেবকী কিভাবে কৃষ্ণের সাধন সিদ্ধ বাবা – মা হলেন?

ব্রহ্মার এক পুত্র ছিলেন অত্রিমুনি । তার স্ত্রীর নাম অনুসূয়া । তাদের পুত্রের নাম ছিলো সোম – অর্থাৎ চন্দ্র । চন্দ্রের ছেলের নাম বুধ । বুধ থেকে বংশ পরম্পরায় এক সময় এক শক্তিশালী ক্ষত্রিয় রাজা নহুষ  এর উৎপত্তি হয় । নহুষের পুত্রের নাম ছিল যযাতি । যযাতি এর  জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন যদু । এখন এই চন্দ্র বা যদু বংশের এক রাজা ছিলেন দেবমীড় । তার দুই স্ত্রী ছিলঃ একজন ক্ষত্রিয় এবং একজন বৈশ্য । ক্ষত্রিয় স্ত্রী থেকে শূরসেন নামে এক পুত্র এবং পৃথা ( কুন্তি নামে বেশী পরিচিত ) নামে এক কন্যা  হয় । শূরসেন – এর পুত্র বসুদেবের সাথে মথুরার রাজা উগ্রসেন এর ভাই দেবকের কন্যা দেবকীর বিয়ে হয় । রাজা উগ্রসেন এর পুত্র কংস দেবকীকে রথে চড়িয়ে গৃহে যাওয়ার সময় দৈববাণী হয় – দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তান তাকে হত্যা করবে । তা শুনে কংস দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলে বসুদেব কংসকে বলেন যে দেবকীর গর্ভে যতো সন্তান হবে সবই তাকে দিয়ে দেওয়া হবে যাতে কংস তাদেরকে হত্যা করতে পারেন । 

এভাবে কংসের কাছে প্রতিজ্ঞা করা সত্তেও বাস্তবে বসুদেব তাঁর অষ্টম সন্তানকে গোপনে নন্দালয়ে রেখে এসেছিলেন । এতে স্বভাবতই মনে হবে যে বসুদেব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন । বসুদেব বলেছিলেন, যতস্তে ভয়মুত্থিতম্ – অর্থাৎ যে পুত্রদের থেকে তোমার ভয় আছে তাদেরকে তোমার হাতে অর্পণ করবো । এখন যতস্তে এবং ভয়মুত্থিতম্ এই দুই শব্দের মধ্যে একটি লুপ্ত ‘অ’ আছে । তবে উচ্চারণে কোন পার্থক্য দেখা যাবে না । অথচ অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত হবে । এখন যতস্তে অভয়মুত্থিতম্ বললে  অর্থ দাড়ায় , যাদের থেকে তোমার অভয় – অর্থাৎ ভয় নেই তাদেরকে তোমার হাতে তুলে দেব । পরোক্ষভাবে বলা হয়, যেই পুত্র থেকে তোমার ভয় আছে তাকে তোমার হাতে দেব না । কংস সহজ অর্থই গ্রহণ করেছিলো । এরপর যথাসময়ে দেবকী ও বসুদেবের পুত্ররূপে ভগবান, কংসের কারাগারে একসময় আবির্ভূত হন ।

সেই শিশু পদ্মপলাশলোচন, চতুর্ভুজ, শঙ্খ – পদ্ম – চক্র – গদাধারী, বুকে শ্রীবৎসচিহ্ন এবং তাঁর গলায় কৌস্তুভ মণি শোভা পাচ্ছিল । পীতাম্বর পরিহিত তাঁর শরীরের বর্ন ছিল নবজলধর শ্যাম । তিনি মহামূল্যবান বৈদুর্য্ – মণিমুক্ত কিরীট ধারণ করে ছিলেন । এমন অদ্ভুত শিশুকে বসুদেব এবং দেবকী অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে লাগলেন । এক সময় তারা তাঁর স্তব করতে আরম্ভ করেন । কৃষ্ণ তখন দেবকী ও বাসুদেবের ঐশ্বর্য্ মিশ্রিত বাৎসল্যভাব দেখে তাঁর উপরোক্ত রূপে আসার কারণ বললেনঃ অনেক পূ্র্বে স্বায়ম্ভুব মনুর রাজত্ব মনুর রাজত্বকালে বসুদেব ও দেবকী ছিলেন প্রজাপতি সুতপা এবং তাঁর স্ত্রী পৃশ্নী । তাঁরা ভগবানকে পুত্ররূপে পাওয়ার জন্য ১০ হাজার বছর তপস্যা করেন । সেই সময় তাদের তপ্যায় খুশি হয়ে ভগবান চতুর্ভুজ মূর্ত্তিরূপে আবির্ভূত হলে তারা সেই রূপেই তাঁকে পুত্ররূপে কামনা করেন । ফলে সেই সময় ভগবান পৃশ্নীগর্ভা রূপে আবির্ভূত হন । তারপর আবার অদিতি ও কশ্যপমুনির পুত্ররূপে বামনরূপে আবির্ভূত হন । সর্বশেষষে তিনি স্বরূপে দেবকী ও বসুদেবের পুত্ররূপে আসেন । এজন্য তাদেরকে ভগবানের সাধন সিদ্ধ বাবা – মা বলা যায় । 

২. নন্দমহারাজ এবং যশোদা হলেন কৃষ্ণের নিত্য সিদ্ধ বাবা- মা ঃ

শ্রীমদ্ ভাগবত – এর দশম স্কন্ধের ৫ম অধ্যায়ের ১ম শ্লোকে শুকদেব গোস্বামী নন্দত্ত্বাত্মজ উৎপন্নে  শব্দ দুটি ব্যবহার  করে নন্দের নিজস্ব পুত্র হয়েছে বলে ইঙ্গিত করেছেন, সরাসরি বলেননি যে বসুদেবের মতো তাঁরও পুত্র হয়েছে ।
আত্মজ শব্দের অর্থ হলো আত্মা থেকে , দেহ থেকে জাত – অর্থাৎ নিজের ঔরসজাত পুত্র । কিন্তু ভগবানের জন্মতো সাধারণ জীবের মতো হবে না । ভগবান যখন তাঁর ভক্তদের সাথে লীলারস আস্বাদনের জন্য নিজের নিত্যসিদ্ধ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ জগতে প্রকট করেন তখন আমরা তাঁর জন্ম আখ্যা দেই । তাই কারোও  আত্মজ  হওয়া – অর্থাৎ কারো পুত্ররুপে আবির্ভূত হওয়ার মধ্যে বিশেষ রহস্য থাকে তাই বাৎসল্য – প্রেমময় ভক্তের হৃদয়ে প্রকাশিত হওয়াকেই ভগবানের পক্ষে আত্মজ হওযা বলে । অপরদিকে লোকচক্ষুর সম্মুখে আবির্ভূত হওযাকেই ভগবানের জন্ম হওয়া বলে । জীবের মতো আত্মজ হওয়া অথবা জন্মগ্রহণ করা ভগবানের পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ তিনি অজ এবং নিত্য   সচ্চিদানন্দস্বরুপ ।
শ্রীভগবান বসুদেব ও দেবকীর ঐশ্বর্য্ মিশ্রিত বাৎসল্যভাবের জন্য তাদের সামনে চতুর্ভজ মূত্তিতে প্রকট হয়েছিলেন এবং পরে স্বাভাবিক বা প্রাকৃত শিশুরূপ ধারণ করেছিলেন । অন্যদিকে নন্দ – যশোদার শুদ্ধ বাৎসল্যভাবের জন্য ভগবান মাধুর্য্ময় দ্বিভুজরূপে – অর্থাৎ তাঁর স্বয়ংরূপে তাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন । বসুদেব ও দেবকীর মতো নন্দ ও যশোদার মনে এই ধারণা একেবারেই ছিল না যে স্বয়ং ভগবান তাঁদের পুত্ররূপে এসেছেন । এজন্য্ যেখানেই যে সময়েই পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণ তাঁর লীলা করতে চেয়েছেন সেখানেই সেই সময় নন্দ এবং যশোদা তাঁর  তাঁর পিতা-মাতারূপে পূর্বেই আবির্ভূত হয়েছেন বা হন । এজন্য তাদেরকে ভগবানের নিত্য সিদ্ধ বাবা – মা বলা যায় ।  শ্রীল জীবগোস্বামীপাদ তাঁর গোপালচম্পু  বইতে নন্দালয়ে কৃষ্ণের জন্মের কথা বর্ণনা করেছেন । পূর্বেই বলা হয়েছে যে দেবমীড়ের পুত্র ছিলেন পর্যন্য । তাকে একসময় তার দাদু – অর্থাৎ মায়ের বাবা নিজের কাছে নিয়ে যান এবং পরিণত বয়সে তিনি গোপদের রাজা হন । পর্যন্য, মরিয়সী নামের এক গোপীকে বিবাহ করেন । তাদের ৫টি ছেলে এবং ২টি কন্যাসন্তান হয় । এই ৫টি ছেলে ছিলেন উপানন্দ, নন্দ, নন্দন, অভিনন্দন এবং সুনন্দন । পরিণত বয়সে জ্যেষ্ঠ উপানন্দ নিজে উদ্যোগী হয়ে ছোটভাই নন্দকে রাজা করেন । নন্দ একসময় সুমুখ গোপীর কন্যা যশোদাকে বিবাহ করেন । তাদের কোলে সন্তান না হওয়ায় একসময় উপানন্দ গোপ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করান । এই যজ্ঞের পর একদিন নন্দ ও যশোদা উভয়ই স্বপ্নে দেখেন যে নীলপদ্মের মতো দেখতে এক অতি সুন্দর ছোট্ট শিশু বলছেন যে পূ্র্বের জন্মে তোমরা দ্রোন ও ধরা নামে পরিচিত ছিলে । বহু  তপস্যা করেছিলে আমাকে তোমাদের ছেলে হিসেবে পাওয়ার জন্য । তাই স্বপ্নে যে রূপে আমাকে দেখলে সেভাবেই আমি তোমাদের পুত্ররূপে আবির্ভূত হবো ।

Lord Krishna Comes to Earth
যোগমায়া


একসময় অবন্তীনগর থেকে সান্দিপণী মুনির মা পৌর্ণমাসী সন্ন্যাসিনীরূপে নন্দালয়ে আসেন । নন্দ মহারাজ তাদেরকে যথাযথভাবে অভ্যর্থনা করেন । পৌর্ণমাসী তখন আশীর্বাদ করে বলেন যে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুসন্তান লাভ করবেন ।  এরপর কোন এক ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে নন্দ মহারাজের হৃদয়ে জ্যোতিরূপে স্বয়ংরূপ ভগবান প্রবেশ করে পরে যশোদা মায়ের গর্ভে আশ্রয় নেন । পরে নন্দালয়ে আবির্ভূত হন । কিন্তু পূর্বেই ভগবানের নির্দেশে যোগ-মায়া মেয়ে রূপে যশোদার গর্ভে আশ্রয় নেনন । যোগমায়ার প্রভাবেই যশোদা মোহাচ্ছন্ন থাকায এসব বিষয় জানতে পারেননি । আর বসুদেব যোগমায়ার প্রভাবেই শুধুমাত্র মেয়েরূপী যোগমায়াকে দেখতে পেযেছিলেন ।

৩. জ্যোতিষিক বিচারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঃ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সিংহলগ্নে রোহিনী নক্ষত্রে হর্ষণ যোগে বুধবার মধ্য রাত্রিতে প্রাকৃতিক দুযোর্গের সময় কংস কারাগারে এবং নন্দালয়ে একইসাথে আবির্ভূত  হয়েছিলেন । কংস কারাগারে চতুর্ভুজরূপে এবং নন্দালয়ে দ্বিভুজরূপে । পরে এই চতুর্ভুজ মূত্তি দ্বিভুজ রূপ ধারণ করে নন্দালয়ে গিয়ে সেই দ্বিভুজ মূত্তি তাঁর স্বয়ংরূপে মিশে বা বিলীন হযে যান ।
ভাদ্রমাসে জন্ম নিলে জ্যোতিষ বিচারে জাতক সিংহরাশির হন । গীতায় ভগবান নিজেই বলেছেন যে নক্ষত্রের মধ্যে তিনি সূর্য্, গাছের মধ্যে অশ্বত্থ, নদীর মধ্যে গঙ্গা, পশুর মধ্যে সিংহ ইত্যাদি । তিনি অসীম শৌর্য্ এবং বীর্যের অধিকারি ছিলেন বলেই সিংহ লগ্নে সিংহ রাশিতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলা যায় । আর অষ্টমী তিথিতে জন্মগ্রহণে জাতক খুবই সুন্দর এবং শক্তিশালী হন, যা কৃষ্ণের বৈশিষ্ট্যই বটে । আবার রোহিণী নক্ষত্র হলো ২৭টি নক্ষত্রের মধ্যে প্রধান । ব্রহ্মা নিজে তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন । বুধবার বুধ গ্রহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । বুধ গ্রহ হলো  সমস্ত ধরণের বুদ্ধির প্রতীক এবং প্রদায়ক । ভগবান যে সর্বোত্তম চতুর তা জন্মদিন থেকেও বোঝা যায় । হর্ষণযোগ দ্বারা বুঝায় যে তিনি সর্বোত্তম আনন্দ বিলাস করবেন । আর মধ্যরাত্রির দুর্যোগপূর্ণ প্রাকৃতিক অবস্থা দুস্কৃতিকারীদের সতর্ক করে তাদেরকে বিনাশের ইঙ্গিত বহন করে । 

৪. ভগবানের আবির্ভাবের পর পরই কোন্ কোন্ রসের সৃষ্টি হয়েছিলো?

Krishna Birth - Krishna Janmashtami

শাস্ত্র অনুযায়ী ১২টি রস আছে । তার মধ্যে ৫টি মুখ্য রস হলো শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর । আর ৭টি গৌণ রস হলো রৌদ্র, করুণ, অদ্ভূত, ভয়ানক, বিভৎস, হাস্য, এবং বীর রস । দুর্যোগপূর্ণ মধ্যরাত্রি প্রত্যক্ষভাবে ভয়ানক রস পরোক্ষভাবে ভগবানের দিক থেকে রৌদ্র রস সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে । কংসের কারাগারে চতুর্ভুজরূপে নিজেকে প্রকাশ করে তিনি বসুদেব এবং দেবকীর হৃদয়ে অদ্ভূত রসের সৃষ্টি করেন । পরে ঐশ্বর্য্-রূপ বাৎসল্য রসও তাদের প্রদান করেন । অন্যদিকে কংসের হাতে অর্পণ করতে হবে বলে বসুদেব এবং দেবকী করুণরসে আপ্লুত হয়েছিলেন । আবার প্রার্থনামত দ্বিভুজরূপ ধারণ করলেও বসুদেব এবং দেবকীর মনে অদ্ভূত রসের সৃষ্টি হয়েছিলো । অন্যদিকে নন্দালয়ে নন্দ মহারাজ এবং যশোদা কেবলমাত্র অদ্ভূত রস এবং পরে শুদ্ধ সত্ত্বময় বাৎসল্য রস আস্বাদন করেছিলেন । 

৫. এই বছর (২০২০) ভগবানের কততম আবির্ভাব তিথি?

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০১ সালে কলিযুগ আরম্ভ হয় । ভগবান অন্তর্নিহিত হওয়ার পরপরই এই যুগের সূচনা হয় । এখন ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ । ভগবান এই জগতে ১২৫ বছর প্রকট ছিলেন । তাই ৩১০১ + ২০২০ + ১২৫ = ৫২৪৬ তম বছর হলো কৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি । 

।হরেকৃষ্ণ।

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল