অগ্নিকন্যা

পার্থ চক্রবর্তী
0 রেটিং
2159 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

তীব্র আপত্তি করলেন সূর্য সেন। এই বিপ্লবী দলে নারী নিও না। জানো তো আমাদের কী জীবন। এই লড়াই ছেলেখেলা নয় যে, যে কেউ শখ মেটাতে এসে যোগ দেবে। মহিলাদের নিলে তারা কাজ করবে কী, তাদের রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকতে হবে। তাছাড়া মেয়েদের নিলে দলের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। জানইতো বিপ্লবীদের আত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মহিলার সাথে মেলামেশা করা বারন। এর নাম তো শুনছি রানী। বাপ মায়ের আদুরে কন্যা। না না একে দলে এনো না। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়। তাছাড়া কতো রকম চাল আছে পুলিশের। এইভাবে গুপ্তচর ঢুকিয়ে দিতে পারে। পদবি শুনছি ওয়াদ্দেদার। কোথাকার বাসিন্দা কে জানে। দেশপ্রেমের শুধুই হুজুগ, নাকি অভিজ্ঞতা আছে কিছু? এক নিশ্বাসে টানা বলে গেলেন মাস্টারদা।

শুনতে শুনতে মুখটা ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠছিল বিপ্লবী নির্মল সেনের। খেয়াল করে আলতো হাসলেন মাস্টারদা। বললেন রাগ করলে নির্মল? নির্মল সেন বললেন, আমার ওপর আপনার কোন আস্থা নেই দেখে কষ্ট পেলাম।ভাবলেন কী করে আমি যাকে আনবো সে দলের শৃঙ্খলা নষ্ট করবে, বা পুলিশের চর হবে! আর যদি কারোর মহিলা দেখে পদস্খলন হয়, তার দায় তাকেই নিতে হবে। শুধু মহিলাদের দোষ দেখাটা আপনার কাছে শোভা পায়না। আমি যাকে আনবো সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জানবেন। মাস্টারদা বললেন শুনি তবে তার কথা।

শুরু করলেন নির্মল সেন। আমাদের দলের সাথী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সম্পর্কে বোন হয় রানী। ভালো নাম প্রীতিলতা।চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্ম। আসল পদবী দাশগুপ্ত। পূর্বপুরুষরা নবাবের কাছ থেকে ওহাদেদার উপাধি পান,তার থেকেই হয়েছে ওয়াদ্দেদার। কল্পনা দত্ত, আমাদের মহিলা সহযোগী, তার সাথে স্কুলে পড়তো সে। কল্পনার কাছে শুনেছি,স্কুলের সময় থেকেই তার ধ্যান জ্ঞান দেশের জন্য লড়াই করা। আই.এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয় সে। বি.এ পড়তে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হয়।তখন ছাত্রীদের মধ্যে বিপ্লবী ভাবধারা, আদর্শ, পুস্তিকা প্রচার করতে থাকে সে। তাই তার রেজাল্ট আটকে রাখা হয় অনেকদিন। ১৯২৩ সালে যখন আমরা রেলডাকাতি করেছিলাম, তখন পুলিশ আমাদের খোঁজে হন্যে হয়ে ওঠে। তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী রানী নিষিদ্ধ পুস্তিকা লিফলেট লুকিয়ে রাখতো। ক্ষুদিরাম কানাইলাল প্রমুখের জীবনী পড়ে তার দেশপ্রেমের আগুন তীব্র রূপ ধারন করে। লীলা নাগের দীপালী সংঘে যোগ দিয়ে লাঠি ছোরা খেলায় দক্ষ হয়ে ওঠে, পিস্তল চালাতেও শিখে নিয়েছে সে।

একটি ঘটনায় তার জীবনের মোড় পালটে যায়। চট্টগ্রামের ইনস্পেকটর জেনারেল ক্রেগকে হত্যা করতে গিয়ে আমাদের সাথী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস চট্টগ্রামের এস.ডি.ও তারিণী মুখারজী কে হত্যা করে এবং তার ফাঁসির সাজা হয়। তাকে আলিপুর জেলে রাখা হয়। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনা রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ির লোকেরা কেউ আসতে পারেনি। তা জেনে রামকৃষ্ণের কাজিন সেজে অমিতা দাস নাম নিয়ে প্রীতিলতা অনেকবার তার সঙ্গে দেখা করে। নিঃসঙ্গ ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের কাছে এই সাহচর্য ছিল পরম পাওয়া। সে বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষা দেয় রানীকে। তার ফাঁসির পর থেকে রানীর একমাত্র ইচ্ছা আপনার সাথে দেখা করে আমাদের দলে যোগ দেওয়া। তার কাছে আমি জানতে চাই, পরিবারের প্রতি তোমার কতোটা টান আছে? জবাবে সে বলে, টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারব। এই কথা শুনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মাস্টারদার মুখ। বলেন এনো তাকে। আমি কথা বলবো, এতো বড় দেশপ্রেমিক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

১৯৩২ সালের মে মাসের শেষের দিকে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রীতিলতা মুখোমুখি হলেন তাঁর আদর্শ পুরুষের। মাস্টারদাকে প্রনাম করে দাঁড়ালেন প্রীতি। মাস্টারদা বললেন তুমি ঘরে থেকেই আমাদের অস্ত্র,পুস্তিকা রক্ষা করো। দপ করে জ্বলে উঠলেন প্রীতি। বসে বসে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই। সে চায় direct action এ নামতে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণ করবে সে। তারপর তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র triggering এবং targeting এর উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। যা মুগ্ধ করলো সূর্য সেনকে। তিনি action squad এর সদস্যা করে নিলেন প্রীতিকে।

শুরু হোল রানীর নতুন জীবন। লড়াইয়ের প্রস্তুতি, এখানে ওখানে আত্মগোপন করে থাকা, কল্পনার সাথে বিস্ফোরক গান কটন বানানোর প্রশিক্ষন। ইংরেজরা তখন মরিয়া হয়ে খুঁজছে তাদের। মাস্টারদার মাথার দাম ঘোষণা হয়েছে ১০হাজার টাকা।১৯৩২ এর ১৩ই জুন রাত্রে যখন ধলঘাটে বিধবা সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে গোপন বৈঠক চলছে তাদের, তখন ক্যাপ্টেন ক্যামেরুনের নেতৃত্বে ১৭ জনের পুলিশ বাহিনী আক্রমন করলো তাদের। নির্মল সেন প্রথমেই গুলি চালালেন ক্যামেরুনকে লক্ষ্য করে। লুটিয়ে পরলেন অফিসার। পুলিশরা ঝাঁজরা করে দিলো নির্মল সেনকেও। বীরের মৃত্যু বরন করলেন তিনি। দরজা আগলে দাঁড়ালেন প্রীতিলতা, মুহুর্মুহু গুলিতে কেঁপে উঠলো ব্রিটিশ বাহিনি।এক নারীর কাছে এই আক্রমন প্রত্যাশা করেনি তারা। দিশেহারা হয়ে উঠলো সৈন্যদল। সেই সুযোগে প্রীতি মাস্টারদা সহ কয়েকজন পানা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পালিয়ে গেলেন। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হোল আরেক বিপ্লবী অপূর্ব সেনের। সাবিত্রী দেবীর বাড়ি থেকে পুলিশ পেলো প্রীতিলতার বিপ্লবী যোগ। পেলো রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথনের নথি। পরের দিনিই প্রীতিলতার বাড়িতে হানা দিলো পুলিশ। তার গানের খাতা নিয়ে মেলাল হাতের লেখা। তার পরেই প্রীতির জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হল সংবাদপত্রে। মাস্টারদার নির্দেশে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা জ্যেষ্ঠপুরা গ্রামে আত্মগোপন করলেন তাঁরা।

ইউরোপিয়ান ক্লাব নামটা মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিত বিপ্লবীদের। শ্বেতাঙ্গদের আমোদপ্রমোদের জন্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলির এই ক্লাবের গেটে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। এতো বড় সাহস, ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের এতো অপমান। শোধ নিতেই হবে। ১৯৩০ এর এপ্রিল থেকে বারবার ওই ক্লাব আক্রমনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছিলো। ১৯৩২ এর ১০ই আগস্ট শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি দল হামলা চালাতে যায়। সে অভিযান ব্যর্থ হয়। এরপর কল্পনা দত্তের ওপর ভার পরে গোপনে ক্লাবের খবর আনার। তা করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে যান। সতর্ক হয়ে যায় ইউরোপীয়রা।

১৯৩২ এর ২৩ সেপ্টেম্বর শনিবার। রাত্রি ৯টা। প্রীতিলতা নিজেকে সাজালেন পাঞ্জাবি পুরুষের বেশে। মালকোঁচা দেওয়া ধুতি,শার্ট, মাথায় পাগড়ি, হাতে লাঠি,কোমরে পিস্তল।সঙ্গে আরও ৮ জন পুরুষ বিপ্লবী।কিন্তু আজ নেতা প্রীতিই। মনে আসছে স্কুল জীবনে দিদিমনিদের কাছে শোনা ঝাঁসির রানীর কাহিনী, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে বলা আদর্শ, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীনের আত্মত্যাগের কাহিনী। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে,কিন্তু স্নায়ু অচঞ্চল। এতদিনের অ্যাকশনের স্বপ্ন পূরণ হবে আজ।

১০.৪৫। ক্লাবে তখন ৪০ জন নারী পুরুষ গান বাজনা নেশায় মত্ত। পূর্বদিকের দরজা দিয়ে আক্রমন শুরু করলেন প্রীতি। আচমকা আক্রমনে দিশাহারা হয়ে গেলো ইংরেজরা। উত্তর ও দক্ষিনের দরজা দিয়ে গুলি বোমা নিয়ে আক্রমন করলো আরও দুটি দল। এবার পুলিশও জবাব দিলো। ক্লাব হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। একটি গুলি লাগলো প্রীতির শরীরের বামদিকে। রক্তক্ষরণের মাঝেও অবিচল তিনি। হুইশেল বাজিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন দলকে। ১জনকে নিহত ও ১১ জনকে আহত করে পালাতে চাইলেন তারা। কিন্তু প্রীতিকে ঘিরে ফেললো পুলিশ। পালাবার কোনই পথ নেই। সঙ্গীদের বললেন, ভারতমাকে স্বাধীন করার জন্য অনেক পুত্র প্রান দিয়েছে কন্যাদের প্রাণ দেওয়ার দ্বারটা উন্মুক্ত করতে আজ আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ। চোখ বুজে মা বাবাকে স্মরন করলেন প্রীতি, স্মরন করলেন দলনেতা সূর্যসেনকে। তার পর পোশাকের মধ্যে থেকে পটাশিয়াম সায়নাইডের শিশি খুলে ঢেলে দিলেন গলায়। তীব্র বিষ জ্বালিয়ে দিলো ভেতরটা কিন্তু মুখে তাঁর স্বপ্নপুরনের হাসি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আদরের রানী, ইতিহাসের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইলেন পথের ধুলায়।

আজ সেই ২৩শে সেপ্টেম্বর।সেই বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগের দিন। যিনি বুঝিয়েছিলেন নারীদের দেশপ্রেমের আগুনের কতোটা তেজ। প্রনাম জানাই সেই মহীয়সী প্রাণকে। বাংলার মা এর অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কে।

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল